বিজ্ঞাপন

ছাত্র আন্দোলন: গুজব ও মূলধারার গণমাধ্যমের ভূমিকা

August 7, 2018 | 12:46 pm

সাইদুল ইসলাম ।।

বিজ্ঞাপন

দুই বাসের প্রতিযোগিতার দুর্ঘটনায় রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে ঘিরে ছাত্র আন্দোলনে এবারে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে ফেসবুকে ছড়ানো গুজব আর মূলধারার গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রসঙ্গ। লেখাটির শুরুতেই আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু তুলে ধরবো এরপর চলমান পরিস্থিতি তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

আন্দোলনের সপ্তম দিন অর্থাৎ শনিবার বিকেলে যখন জিগাতলায় শিক্ষার্থীদের ওপর ‘সরকারি দলের ক্যাডাররা’ হামলা করল… ঠিক সেই সময়ই ফেসবুকে দ্রুত কিছু গুজব ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ‘চারজন শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। চারটি মেয়েকে রেপ করা হয়েছে।’ আরেকটি মেয়ে কাপড়ে মুখ ঢেকে দেয়া ভিডিও বার্তায় বলছে- ‘আওয়ামী লীগ অফিসে মেয়েদের আটকে রাখা হয়েছে। রেপ করা হচ্ছে।’

এসব গুজব যখন একের পর এক আসতে থাকে তখনকার ছবিগুলো, ভিডিগুলো কিছুটা বিশ্লেষণ করতে থাকি। কিন্তু যেই ঘটনা যেভাবে বর্ণনা করে বলছে তা মেলাতে পারছিলাম না। এরমধ্যেই অনেক পরিচিতজন, শুভানুধ্যায়ী জানতে চাইল ঘটনাগুলো আসলে সত্য কিনা। আমি বললাম আমি বিশ্বাস করি না।

বিজ্ঞাপন

জিগাতলায় সংঘাত চলছিল, কী ঘটছিল তা সহকর্মীরা ইনবক্স করে জানাচ্ছিলেন। শিক্ষার্থীদের ওপর ওই হামলাকারিরা যেভাবে প্রকাশ্যে গণমাধ্যমের ওপর চড়াও হচ্ছিল তার খবরও পাচ্ছিলাম। কিন্তু সবকিছু যেন ঢেকে যাচ্ছে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া গুজবের আড়ালে। এসব দেখে ফেসবুকে নিজের ওয়ালে একটি স্ট্যাটাস দিলাম। স্ট্যাটাসটি ছিল এমন-

“নতুন প্রজন্মের এত বড় একটা অর্জনকে শেষ করে দিচ্ছে আবার সেই হেফাজত স্টাইলের গুজব ছড়ানো গোষ্ঠিটি। গুজব থেকে সবাই সাবধান।”

স্ট্যাটাসটি দেয়ার পর সাংবাদিকতার দুজন ছাত্র যাদেরকে আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টেলিভিশন সাংবাদিকতা শেখাই তারা আমাকে দলকানা বলেই সাব্যস্ত করে বসলো। একজনতো পাবলিকলি লিখেই দিলো আমার মত সাংবাদিক তার শিক্ষক এটা ভাবতে তার লজ্জা হয়। আমি পরিস্থিতি বুঝতে পারলাম। চুপচাপ থাকলাম।

বিজ্ঞাপন

পরে সাংবাদিকতা বিভাগের আরো কজন ছাত্র অনেক ঘেটে ও্বই ভিডিও এবং ছবির লিংক বের করে দেখিয়ে দিলো এসবই ভুয়া গুজব। এরপরতো একের পর এক নানা গুজব। এখন সবাই বুঝতে পারছেন এই গুজবগুলো কীভাবে কোথা থেকে ছড়ানো হয়েছে।

এই যে গুজবগুলো ছড়ানো হলো তাতে কী হলো? তাতে সবচয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হলো আমাদের নতুন প্রজন্মের, ছোট ছোট ভাইবোনদের এক সপ্তাহ ধরে রাজপথে থেকে অর্জন করা একটি সাফল্য। ম্লান করে দেয়া হলো তাদের এতবড় একটা অর্জনকে। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনটি তারা বানিয়ে ফেললো ছাত্রলীগবিরোধী আন্দোলনে। যেকারণে এরপর দেখবেন আন্দোলনের ধারা বদলে গেছে। মূল ম্লোগান বদলে গেছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের জায়গা নিয়ে ফেলেছে অন্য ধান্দাবাজরা।

এ বিষয়ে আমার দেখা একটি পর্যবেক্ষণ বলছি। উত্তরায় শনিবার পরিস্থিতি দেখতে সাধারণ নাগরিক হিসেবে প্রায় ঘন্টা দুয়েক বিমান বন্দর সড়কে ঘুরেছি। নানারকম আলামত দেখেছি। দুপুর দুইটার দিকে যখন আজমপুর সড়ক ধরে হাঁটছিলাম তখন চোখে পড়লো আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা রাজপথ ছেড়ে ধীরে ধীরে ঘরে ফিরছে। সেই সময় দেখলাম হাউজ বিল্ডিং এর দিক থেকে একটা মিছিল আসছে। তাদের মুল শ্লোগান ছিল জ্বালোরে জ্বালো… আগুন জ্বালো। অথচ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মূল শ্লোগান ছিল উই ওয়ান্ট জাস্টিস।

চলতে চলতেই মিছিলটি যখন কলেজ শিক্ষার্থীদের আরেকটি মিছিলের সামনে পড়লো তখন তারা শ্লোগান বদলে ফেললো। আর যারা মিছিলটি করছিল তাদের পরনে কোনও ইউনিফরম ছিলনা। সাথে দুই চারটা টোকাই টাইপও চোখে পড়েছে। কাজেই বুঝলাম শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটির পরিণতি কী হতে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করলে দেখবেন, আন্দোলনের ৬ষ্ঠ দিন থেকে আন্দোলনের ছবি তুলতে বা ভিডিও করতে বাধা দিচ্ছিলেন অনেকেই। সাংবাদিকদেরতো বটেই এমনটি সাধারণ উৎসাহী মানুষকে মোবাইলে ভিডিও করতে দিচ্ছিলেন না আন্দোলনে থাকা একটি গ্রুপ।। এক্ষেত্রে কাউকে কাউকে দেখেছি খুব মারমুখিভাব নিয়ে তেড়ে আসতে। এর কারণ কী কেউ বুঝতে পারছেন? যে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই এই কদিন ভিডিও করে করে ঘন্টায় ঘন্টায ফেসবুকে ছড়াল, গণমাধ্যম কেন বেশি করে তাদের কাভারেজ দিচ্ছে না তার জন্য ক্ষোভ ঝাড়ল তারা হঠাৎ কেন এমন প্রচারবিমুখ হয়ে গেলো। নাকি তাদের মাঝে তৃতীয় কেউ ঢুকে এই নিয়ন্ত্রণটি করতে চাচ্ছে?

এবার আসা যাক মুল ধারার গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশ্নে। এই দুর্ঘটনা যেদিন ঘটে তার পরেরদিন ছিল দেশের তিনটি সিটিতে নির্বাচন। সংগত কারণেই অধিকাংশ টেলিভিশনের মনোযোগের কেন্দ্র ছিল সেদিকেই। তারপরও প্রথমদিনই কিন্তু ঘটনাটিকে অধিকাংশ গণমাধ্যম গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে। আমাদের টেলিভিশনতো (জিটিভি) সেদিন নির্বাচন ছেড়ে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুকেই প্রধান খবর করেছিল।

এরপরদিন ছিল নির্বাচন। ফলে গণমা্ধ্যমের দৃষ্টিও ছিল সেদিকে। পাশাপাশি দিনভর এই আন্দোলনের খবরও কিন্তু টেলিভিশনগুলো সরাসরি সম্প্রচার করেছে। তারপর কী ঘটেছে এবং ঘটছে তা বোধ করি সবাই বুঝতে পেরেছেন।

যারা বলেন, মুলধারার গণমাধ্যম কোন খবর দিচ্ছেনা তারা কী একবার ভেবেছেন, ছোট ছোট স্কুল কলেজের ছাত্ররা ইচ্ছামত গাড়ি ভাংচুর করছে এই দৃশ্য বারবার দেখালে কতটা দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা হতো? এই বাচ্চারা বাবার বয়সী, মায়ের বয়সী মানুষদের সাথে রাস্তায় যে ধরণের আচরণ করছে তা সরাসরি দেখাতে থাকলে কতটা দায়িত্বশীলতা হতো?

একেকজন সংবাদকর্মীরে সাথে এই শিক্ষার্থীরা যে ধরণের উগ্র আচরণ করেছে, অনেককে যেভাবে আক্রমন করেছে তা যদি গণমাধ্যমগুলো ফলাও করে প্রচার করতো তাহলে কতটা ভালো হতো বুঝতে পারছেন?

তাই বলছি, ফেসবুক, ইউটিউব আর মুলধারা গণমাধ্যম এক জিনিস না। মূলধারার গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা থাকে। নানারকম সীমাবদ্ধতা থাকে, বিভিন্ন দিকের চাপ থাকে (শুধু সরকারি চাপ না)। মৗলধারার একজন গনমাধ্যমকর্মী যা খুশি বলতে পারেন না, যা খুশি লিখতে পারেননা। দেশ, সমাজ, রাষ্ট্রে বড় ধরণের অস্থিরতার জন্ম দেয় এমন উস্কানি দিতে পারেননা। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি বিশ্বের কোন দেশেই সম্ভব না।

অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সরকারি দলের কর্মীদের হামলার খবর গণমাধ্যম সেভাবে দেয়নি। ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে শ্রমিক আন্দোলন, বাস ধর্মঘট এসব খবর বেশি একটা প্রাধান্য পায়নি। আমার প্রশ্ন, আপনারা কী বলতে পারবেন বাংলাদেশের একটি গণমাধ্যমও আন্দোলনকারি ছাত্রদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে? একটি গণমাধ্যমও কী নৌমন্ত্রীর পক্ষে কোন কথা বলেছে? কোন গণমাধ্যম কী সড়কে দুর্ঘটনার নামে হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ শাস্তির আইনের বাইরে অন্যকোন দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে? তাহলে কেন গণমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ বানাচ্ছেন?

শেষে বলবো একবার ভাবুনতো, চলমান ছাত্র আন্দোলকে ঘিরে স্যোশাল মিডিয়ায় যে গুজবটা হলো তাতে যদি মূলধারার মিডিয়া পা দিতো তবে পরিস্থিতি কী হতো? এতে একটি অংশ অনেক বড় সাফল্য পেয়ে যেত। কিন্তু আন্দোলনকারী ছোট ভাইবোনদের জীবনে আরো বড় ক্ষতি হয়ে যেতো। মুলধারার গণমাধ্যম এটি করতে দিতে পারেনা। তাই স্কুল কলেজের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের ন্যায্য একটি আন্দোলনকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে যারা নিজেদের রাজনৈতিক সাফল্য অর্জনের প্লাটফরম বানাতে চান মূলধারার গণমাধ্যম তাতে পা দিতে পারেনা। তাই গুজব থেকে সাবধান থাকুন।

সাইদুল ইসলাম : সিনিয়র রিপোর্টার, জিটিভি

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন