বিজ্ঞাপন

আজ শোকের দিন, আজ প্রতিজ্ঞার দিন

August 14, 2018 | 8:58 pm

।। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।।

বিজ্ঞাপন

“Some are born great some achieve greatness, and others have greatness thrust upon them.” – William Shakespeare

শেক্সপিয়েরের কথা অনুযায়ী, কেউ কেউ মহান হয়েই জন্মায়, কেউ তা অর্জন করে আর কারও কারও উপর তা অর্পিত হয়। বাঙালির সব ক্ষুদ্রতাকে দূর করতে একজন মহান শেখ মুজিব একাই বড় হয়ে উঠেছিলেন।

বছর ঘুরে ১৫ আগস্ট আসে। প্রতিবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের স্মরণ করে বাঙালি। দিবসটি ফিরে, ফিরে আসে জনকের মুখ। কিন্তু বাংলাদেশে আর ফিরেনা সেই রাজনীতি, যে রাজনীতি সাহস আর সততার। যে রাজনীতির একমাত্র দর্শন ছিল মানুষের প্রতি ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধু বড় রাজনীতি করতেন, যে রাজনীতি কেবল ভাগাভাগির হিসাব করেনি, যে রাজনীতিতে ছিলনা কেবল ক্ষমতা দখলের কৌশল। তিনি এমন রাজনীতি করেছেন, যে রাজনীতি সমাজের নানা অংশের মধ্যে, এমনকি যারা সাংঘাতিকভাবে প্রতিহিংসাপরায়ণ তাদের প্রতিও কখনো বিরূপ আচরণ করেনি। বাঙালি আজীবন ক্ষুদ্রের সাধনা করেছে। যে কারণে সে বড়কে গ্রহণ করতে পারেনা্ আর পারেনা বলেই এমন এক নেতাকেও সপরিবারে খুন করতে পেরেছে। এমন দিনে আকস্মিকভাবে কোন এক জাতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জন্মিদনও আবিষ্কার করতে পারেন।

বিজ্ঞাপন

‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনুপস্থিত। সে সময় দুই অসম শক্তি এক ভয়াবহ নিষ্ঠুর সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। বাঙালির জীবনে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই ছিলেন সেই প্রতীক, যার চারদিকে নিঃসহায় এক উদ্দেশ্যের সমর্থকরা এক সঙ্গে জড়ো হয়েছিল। কিন্তু এটা কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল না। ওই অন্ধকার দিনগুলোতে, ওই অগ্নিপরীক্ষার দিনগুলোতে, যে কোটি কোটি মানুষ, যারা ভবিষ্যতের জাতিকে সৃষ্টি করবে তাদের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি বা দ্বিধা ছিল না। বঙ্গবন্ধু একাই ছিলেন প্রতীক’ – জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ‘মোজাফফর আহমদ চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা ১৯৮০, বাংলাদেশ জাতির অবস্থা’ শীর্ষক প্রবন্ধে।

বঙ্গবন্ধু একজন সাধারণ কর্মী থেকে নেতা হন। দলের নির্দেশনা মেনেছেন, রাজপথে থেকেছেন, জেল-জুলুম সয়েছেন এবং তাঁর জীবনের প্রতিটি স্তরে তিনি সততা, নিষ্ঠা আর মানুষের জন্য ভালোবাসার প্রমাণ রেখেছেন। আর এ কারণেই কতিপয় উগ্রবাদী ছাড়া তার রাজনীতির সমর্থক নয় তারাও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে সমীহ করে কথা বলেছেন। ‘বাংলাদেশ: এরা অব শেখ মুজিবুর রহমান’ গ্রন্থে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবের আবির্ভাব বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা। শেখ মুজিবের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তাঁর সমাধি রচিত হয়নি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি রূপকথার নায়কের মতোই ভাস্বর হয়ে থাকবেন।

এমন মানুষের মৃত্যুতে তাই বাঙালির হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আজও থামেনি। কারণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গেই ভিন্ন পথচলা শুরু হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের। মুখ থুবড়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বাংলাদেশ হাঁটতে শুরু করে প্রত্যাখ্যাত পাকিস্তানি ভাবধারায়। প্রশাসন থেকে রাজনীতি, সব জায়গায় জেঁকে বসে পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের ভূত। জাতির জনককে হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশ বেতার হয়ে গিয়েছিল রেডিও বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে রণধ্বনি জয় বাংলার বদলে পাকিস্তান জিন্দাবাদের আদলে হয়ে যায় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।

বিজ্ঞাপন

বছর না ঘুরতে জেলখানা থেকে স্বদম্ভে বেরিয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, যাঁরা বিশ্বাস করতেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ তাঁদের জন্য শুরু হয় অন্ধকার কাল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর থেকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা ছিলেন তাদের কাছে মৃত মুজিব ছিলেন ভয়াবহ আতঙ্কের। বিভিন্নভাবে তারা চেষ্টা করেছেন বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই একটানা চেষ্টা চলে বঙ্গবন্ধুকে ভুলিয়ে দেওয়ার। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে ফেলা হয় বঙ্গবন্ধুর নাম। খুন করা হয় জাতীয় চার নেতাকে, নির্বাসনে পাঠানো হয় বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে, ছুঁড়ে ফেলা হয় উদারতার সব আয়োজন, ফিরিয়ে আনা হয় পাকিস্তানি ধর্মীয় উগ্রবাদকে। আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চলে ধারাবাহিক নির্যাতন।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষায় বাংলাদেশের সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এই কালো অধ্যাদেশটি জারি করা হয়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরে আসার আগ পর্যন্ত প্রতিটি সরকার বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কৃত করেছে, লালন করেছে।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ- একে অপরের পরিপূরক। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমানের পুরো জীবনই সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের রাজনীতি। কিশোর বয়স থেকেই সাহসী মুজিব শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো তার রাজনৈতিক গুরুদের জানান দিয়েছিলেন যে, এই মাটিতে শুধু নন, বিশ্ব দরবারে তিনি হয়ে উঠছেন বড় রাজনীতির প্রতীক।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে একটি কলোনি হিসেবে বিবেচনা করত পাকিস্তানি শাসকরা। সেই থেকে এ দেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাহসী মুজিব দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছেন, যৌবনের একটা দীর্ঘ সময় জেলে কাটিয়েছেন। তিনি মানুষের অধিকার আদায়ে প্রতিটি সংগ্রামে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করেছেন, সফল হয়েছেন। ক্ষুদ্রের সাধনা ছিল না বলেই তিনি তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী ও সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানের মতো সৎ ও মহান দেশপ্রেমিকদের।

বিজ্ঞাপন

সাহসের সঙ্গে তাঁর ছিল বিচক্ষণতা। আর তাই তিনি মোক্ষম সময়েই স্বাধীনতা আর মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন, উচ্চারণ করেছিলেন যে, এদেশের মানুষকে আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। এসবই তাঁর সাহস আর সততার প্রেরণা থেকে উচ্চারিত।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দুইবার পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন শেষে এবার তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আইনের নিয়মিত প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও চালিয়ে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের যে শপথ ছিল, সেই শপথের পথ থেকে মাঝে অনেকটাই ছিটকে পড়েছিল বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার লড়াই ছিটকে পড়া বাংলাদেশকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক মহাসড়কে তুলে দেওয়ার।

তবে সেই পথ অনেক বন্ধুর। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টসহ ১৯ বারের বেশি তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের শত্রুপক্ষ জানে শেখ হাসিনা আছেন মানে বঙ্গবন্ধু আছেন, বাংলাদেশ আছে। বঙ্গবন্ধু নাম মানেই সাহসের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। আগস্ট এলেই শোকাতুর হয় বাঙালি, রক্তক্ষরণ হয় প্রতিটি হৃদয়ে, কিন্তু সাহসের শপথও উচ্চারিত হয় একই সঙ্গে। কারণ বাংলাদেশকে ভালোবাসা প্রতিটি বাঙালির কাছে তাঁর দেশের আরেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু দিন শোকের দিন। কিন্তু একইসাথে প্রতিজ্ঞা করার দিন। আজ বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসে আমরা দেশের প্রতি, আমাদের পরম ভালবাসার মাতৃভূমির প্রতি, সুপ্রাচীন, শাশ্বত এবং চিরনবীন স্বদেশের প্রতি আমরা সশ্রদ্ধ প্রণতি জানাই এবং তার সেবায় নিজেদের নতুন করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করি।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: এডিটর ইন চিফ সারাবাংলা.নেট, দৈনিক সারাবাংলা ও জিটিভি

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন