বিজ্ঞাপন

রোহিঙ্গারা কি আসলেই মিয়ানমারে ফিরতে চায়?

August 25, 2018 | 5:33 pm

।। আন্তর্জাতিক ডেস্ক ।।

বিজ্ঞাপন

মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে একবছর পার করেছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। জাতিসংঘ যে নির্যাতনকে জাতিগত নিধন বলে স্বীকৃতি দিয়েছে।

গত বছরের আগস্টে মিয়ামারের আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশ অার্মি (আরসা) মংডুর একটি সীমান্ত চেকপোস্টে হামলা চালালে সেখানকার ১২ জন নিহত হয়। এরপর সমগ্র রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চলতে থাকে হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মতো নির্যাতন। মিয়ানমার সরকার যাদের কখনোই অালাদা জাতিসত্ত্বা বা নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতিই দেয়নি।

রোহিঙ্গারা এখন স্থানীয়দের জন্য বিষফোঁড়া

ইন্টার সেক্টর কোঅর্ডিনেট গ্রুপের তথ্য মতে, এ পর্যন্ত ৯ লাখ ১৯ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। উদ্বাস্তু হওয়া রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের টেকনাফ ও ‍উখিয়ার ৩২টি ক্যাম্পে বসবাস করছে, যেখানে আগে থেকেই ৩ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বসবাস করত।

বিজ্ঞাপন

উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে গত বছরের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও কার্যত কোনো প্রত্যাবাসনই হয়নি রোহিঙ্গাদের। এখন পর্যন্ত ফেরত যায়নি একজন রোহিঙ্গাও।

অনেক রোহিঙ্গা মনে করছেন, তাদের নিজ দেশে ফেরত দেওয়া হলে আবারও তাদের জোর করে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলা হবে।রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন, মিয়ানমারের নাগরিকত্ব, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হলে তারা সেখানে আর ফিরে যাবে না।

নিজ জন্মভূমিতে ফিরে যাবে কি না এ ব্যাপারে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে তাদের মতামত জানিয়েছেন বিভিন্ন একাধিক রোহিঙ্গা শরনার্থী।

বিজ্ঞাপন

তাদেরই একজন আলী জোহর। ভুটিয়াডাং শহরের তাংবাজার এলাকায় খাবারের ব্যবসা করতেন। গত বছরের আগস্টে সে জামতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

অালী বলেন, ‘প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়েছে কি না জানি না। তবে আমাদের দাবিগুলো আদায় না হওয়া পর্যন্ত সেখানে ফিরে যেতে চাই না। সেখানে ফিরত গিলে সবার আগে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দিতে হবে এবং আমাদের ওপর হামলায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’

বিজ্ঞাপন

জামতলী ক্যাম্পের আরেকজন রোহিঙ্গা গুলশাহার তার স্বামী মোহাম্মদ শফি ও পাঁচ সন্তানসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস করছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি আমার মেয়ে ও ভাগ্নে-ভাগ্নিকে হারিয়েছি। মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের হত্যা করেছে। আমি ঠিক করেছি আমার যতদিন মৃত্যু না হয় ততদিন আমি জামতলী ক্যাম্পেই থাকতে চাই। বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার কাছ থেকে সাহায্যে পেয়েছি। বাংলাদেশ সরকার যদি সাহায্য বন্ধ করে দেয়, তাহলে আমি এখানে না খেয়ে মরবো, তবু সেখানে (মিয়ানমারে) ফিরে যাব না।’

‘আমার তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। বড় মেয়ের বয়স ২০ বছর। আমরা তার জন্য একটা ভালো পাত্র খুঁজছি।’

‘মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছে ধর্ষিত হওয়ার ভয়ে সাধারণত অল্প বয়সে রোহিঙ্গা নারীদের বিয়ে দেওয়া হয়। বিবাহিত নারীদের প্রতি সেনাবাহিনী আগ্রহ কম থাকে’ বলেও জানান তিনি।

মংডুর রাবাল্লা শহর থেকে এসেছেন মোহাম্মদ ইউনিস। সাত ভাই-বোনের মধ্যে ইউনিস সবার বড়। সে এবং তার অবিবাহিত ভাইয়েরা নওয়াপাড়া শালবাগান রিফিউজি ক্যাম্পে মায়ের সঙ্গে বসবাস করছেন।

তিনি বলেন ‘যেকোনো ভাবেই হোক আমি ফিরে যেতে চাই। আগে আমি কুলির কাজ করতাম। এখন এখানে কিছুই করি না।একটুখানি খাবার জোগাড় করতে সারাদিন আমাদের বহু ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। এখন আমরা সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। তা ছাড়া এখানে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা পর্যন্ত নেই। আমাদের ফেরার ব্যাপারে কী চুক্তি হয়েছে সে বিষয়েও খুব একটা জানি না।’

মংডুর ফুকিরা বাজার থেকে এসেছেন মীর আহমেদ। মিয়ানমার থাকতে তিনি কৃষি কাজ করতেন এবং সেখানে তার ১০ কানির মতো জমি ছিল। এখন তিনি বালুখালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস করছেন।

তিনি জানান, ‘আমার দুই ছেলে এবং এক মেয়েসহ এখানে এসেছি। মিয়ানমার সরকার যদি আমাদের দাবি মেনে নেয় তাহলে আমরা সেখানে ফিরে যেতে ইচ্ছুক। আমি এখানে খাবার ও আশ্রয় পাচ্ছি। তার চেয়ে বড় কথা নিরাপত্তা। কিন্তু এখান থেকে ফিরে যেতে চাই। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে মর্যাদা। আমি সেখানে গিয়ে মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।’

হুজ্জাতুল ইসলাম মংডু থেকে এসে তার বাবা-মার সঙ্গে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস করছে। সে জানায়, ‘আমি সেখানে ক্লাস থ্রিতে পড়তাম। এখানে মাদ্রসায় শুধু কোরান পড়ার ব্যবস্থা আছে। আমরা কবে ফিরে যেতে পারবো সে ব্যাপারেও কিছু জানি না।’

নুরুল আমিন ও সাঈদ আহমেদ। তারা সম্পর্কে একে অপরের চাচাতো ভাই। আমিনের ১০ সন্তান ও সাঈদের আট সন্তান।

নুরুল আমিন বলেন, আমদের ফিরে যাওয়ার বিষয়ে এখনো কোনো কথা ‍শুনিনি। যদি আমাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে চাই তাহলে আমাদের কিছু দাবি-দাওয়া আছে, সেগুলো পূরণ করলে তবেই ফিরে যাবো। আমাদের সেখানে নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, আমরা আশা করছি কোনো ধরণের নিশ্চয়তা ছাড়া আমাদের সেখানে ফেরত দেওয়া হবে না। আমরা বৌদ্ধদের দেশে মরতে চাই না, আমরা মুসলিমদের দেশেই মরবো।’

‘এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো আমরা দেশ ছাড়া হলাম। এর আগে ১৯৭৮ এবং ১৯৯১ সালেও রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। প্রতিবারই আমরা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পরে সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছি।’

‘সেখানে আমরা মাছ ধরে ও কৃষিকাজ করে জিবীকা নির্বাহ করতাম। যদিও মিয়ানমার আমাদের দেশ তবুও সেখানে কোনো নিরাপত্তা নেই। নিরাপত্তা ছাড়া আমরা সেখানে যেতেও চাই না। বাংলাদেশ তার চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ আমাদের কাছে।’

সারাবাংলা/এমআই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন