বিজ্ঞাপন

ভরা মৌসুমেও তিস্তায় জেগে আছে চর

August 26, 2018 | 9:54 am

।। উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

লালমনিরহাট থেকে ফিরে: গত বছরের এই সময়টাতে তিস্তার যৌবন দেখেছিল লালমনিরহাটবাসী। হাজার হাজার একর ফসলি জমি, গবাদি পশু, মাঠ-ঘাট সব ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বানের পানি। শত বছরের ইতিহাসে বন্যার পানির তীব্র স্রোতে প্রথমবারের মতো ভেঙে গিয়েছিল রেললাইন। মাস খানেকেরও বেশি সময় পানিবন্দি ছিল লাখ লাখ মানুষ। অথচ এ বছর বন্যা তো দূরের কথা, ভরা মৌসুমেও তিস্তা ব্যারেজের সামনে চর পড়ে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিস্তা ব্যারেজের মূল প্রবাহ আসে মূলত উজান থেকে নেমে আসা ভারতীয় পানির মাধ্যমে। এই ব্যারেজের সামনে ভারতীয় অংশে আরও একটি ব্যারেজ রয়েছে। সেখানকার গেটগুলো আটকানো থাকলে পানি প্রবাহ বন্ধ থাকে। আবার ওইসব গেট খোলা রাখলে বেড়ে যায় পানির প্রবাহ।

জানা যায়, বৃষ্টির পানি বাড়লে গজলডোবা ব্যারেজের সবক’টি গেট খুলে দেওয়া হয়। তখন বাংলাদেশ অংশে বন্যা দেখা দেয়। এ সময় তিস্তা ব্যারেজের ৫২ গেট খুলে দিয়েও ঢল আটকাতে হিমশিম খেতে হয়। এমনকি ওই সময় বাইপাস কেটে দিয়ে পানি ছেড়ে দিতে হয়। আর এবার পানি না থাকায় তিস্তা ব্যারেজের সামনের অংশে চর পড়েছে। পানি ছেড়ে দেওয়া দূরের কথা, সামনে বোরো মৌসুমে ওই অঞ্চলে আবাদ নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (২১ আগস্ট) সরেজমিনে দেখা যায়, তিস্তা ব্যারেজের ৫২টি গেটের মধ্যে পুরোপুরি খুলে দেওয়া আছে মাত্র চারটি গেট। এর বাইরে অর্ধেক খুলে দেওয়া আছে ২০টি গেট, আর আরও আটটি গেট আংশিক খুলে দেওয়া আছে। বাকি ২০টি গেট পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। ব্যারেজের উজান অংশেই পড়েছে বড় আকারের একটি চর। পানি খুব একটা নেই। পানিকে ঘিরে মানুষগুলোর আনাগোনাও নেই। নদী থাকলেই যেমন নদীর বুকে মানুষের কর্মকাণ্ড থাকে, তেমন কোনো কর্মকাণ্ডই চোখে পড়ে না। ব্যারেজের দুই দিকে বিশালাকৃতির পর্যটন স্পট থাকলেও অবকাঠামোর অভাবে গড়ে উঠতে পারেনি পর্যটন কেন্দ্রও।

দীর্ঘ দিন ধরে তিস্তা ব্যারেজের পর্যটন নিয়ে কাজ করছেন সাংবাদিক আসাদুজ্জামান সাজু। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, তিস্তা ব্যারেজকে কেন্দ্র করে বড় একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারত। তবে দুই জেলার (নীলফামারী ও লালমনিরহাট) রেষারেষির কারণে সেখানে কিছুই গড়ে উঠতে পারছে না। পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলে কোন জেলার মানুষ বেশি লাভবান হবে, সেটা নিয়ে ঠেলাঠেলি চলছে। নীলফামারীর প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে, পুরো ব্যারেজটি যেহেতু লালমনিরহাট অংশে পড়েছে তাই যা করার সেখানকার প্রশাসনই এটা চিন্তা করুক। আবার লালমনিরহাট প্রশাসন বলছে, দুই জেলার মধ্যবর্তী অংশে ব্যারেজটি হওয়ায় সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হচ্ছে। নীলফামারী প্রশাসন থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা করা হয় না। ফলে দীর্ঘদিন ধরে পর্যটন অবকাঠামোর তৈরির কাজটি পড়ে রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

তিস্তা ব্যারেজ এলাকার বাসিন্দা মতিউর রহমান। দীর্ঘ দিন তিনি এই ব্যারেজের যৌবনের উত্থান-পতন দেখেছেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগের মতো তিস্তা ব্যারেজের কিছু নেই। বছরের প্রায় বেশিরভাগ সময়ই স্রোতহীন থাকে এই ব্যারেজ। আগে স্রোতের গর্জন অনেক দূর থেকে শোনা যেত। স্রোতে পুরো ব্যারেজ কাঁপত। আর এখন পানির প্রবাহই থাকে না। আগে যেরকম মাছ পাওয়া যেত, এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। এই ব্যারেজের পানি দিয়ে তিনটি জেলার বোরো আবাদ হত। এখন পানি পাওয়া যায় না। বর্ষার সময় মাঝে-মধ্যে পানি ছেড়ে দেওয়া হয়। তখন বন্যা দেখা দেয়। আবার পুরো বছর পানির দেখা মেলে না।’

তিস্তার মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন আলিমুদ্দিন। মাছের দেখা না পাওয়ায় কয়েক বছর ধরে অটোরিকশা চালান। তিস্তা ব্যারেজের ওপর দিয়েই তিনি অটো চালিয়ে টাকা আয় করেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, তিস্তা ব্যারেজ যখন তৈরি হয়, তখন থেকেই এই এলাকায় বাস করি। কত বন্যায় ভেসেছি, কত রোদে পুড়েছি, আর কত তিস্তার হাসি কান্না দেখেছি— তার ইয়াত্তা নেই। তবু এই এলাকা ছাড়তে পারছি না। এই এলাকার মায়ায় পড়ে গেছি। চোখের সামনে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। আগে প্রাণ ছিল এই ব্যারেজকে ঘিরে। আর এখন সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কারও কোনো উদ্যোগ নেই।’

জানতে চাইলে তিস্তা ব্যারেজের বির্বাহী প্রকৌশলী মো. সামছুজ্জোহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভারতের গজলডোবা অংশে বাঁধ নির্মাণ করে এক তরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। এতে তিস্তা অংশে প্রয়োজনের সময় পানি পাওয়া যায় না। আবার হঠাৎ করে পানি ছেড়ে দিলে সতর্ক অবস্থানে যাওয়ার আগেই বন্যা দেখা দেয়। এবার পানি ছাড়ছে না গজলডোবা অংশে। তাই ব্যারেজের উজান অংশে চর পড়েছে। ড্রেজিং করে এই চর সরাতে হবে।’ প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পেলে ড্রেজিংয়ের কাজ শুরুর হবে বলে জানান তিনি।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন