বিজ্ঞাপন

অভিযানের পর অভিযান, তবু থামছে না ভেজাল পণ্যের সরবরাহ

September 7, 2018 | 8:48 am

।। সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ৪ সেপ্টেম্বর, দুপুর দেড়টা। চল্লিশোর্ধ বয়সী রিকশাচালক আব্দুল মাজেদ মিরপুরের ২ নম্বর সেকশনের ৪ নম্বর রোডে যাত্রী নামিয়েই সড়কের পাশে থাকা একটি চায়ের দোকান থেকে ১ টাকার বিনিময়ে এক গ্লাস ফিল্টারের পানি পান করেন। একই সময় একটি বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিভ রিয়াজও ওই দোকানে এসে ওই ফিল্টার থেকেই এক গ্লাস পানি পান করেন।

দোকানটির ঠিক বিপরীতে একই সময়ে সোনালী বেভারেজ নামের একটি পানি বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠানে চলছিল বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) ও র‌্যাবের ভেজালমুক্ত খাদ্যের বিশেষ যৌথ অভিযান। অভিযান শেষে ওই কারখানা থেকে কয়েকশ পানি ভর্তি জার বের করে রাস্তায় ভেঙে ফেলা হয়। এ সময় রিয়াজ বা আব্দুল মাজেদ বুঝতে পারেন, ফিল্টার পানির নামে তারা যা পান করেছেন, তাতে ছিল ওয়াসার পানি যা কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই বাজারজাত করা হয়েছে।

খানিকট হতাশা রিকশাচালক মাজেদ সারাবাংলাকে বলেন, আমরা তো এত কিছু বুঝি না, জানিও না। টাকা দিয়েই তো কিনে খাই। এর মধ্যে যে এত বড় প্রতারণা, সেটা আমরা বুঝব কিভাবে?

বিজ্ঞাপন

কেবল পানি নয়, ভেজালবিরোধী এমন অভিযান চলে বিভিন্ন খাদ্য পণ্য উৎপাদনকারী কারখানায়, হোটেল-রেস্টুরেন্টে। এসব অভিযানে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জেল-জরিমান, সিলগালা এমনকি কারদণ্ডও দেওয়া হয় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে। তবুও থেমে নেই ভেজাল পণ্যের উৎপাদন। বার বার অভিযান চালিয়েও এ অপরাধের লাগাম টানা সম্ভব না হওয়ায় নিশ্চিত হচ্ছে না বিশুদ্ধ পণ্যের উৎপাদন। ফলে এসব অভিযান কতটুকু কার্যকর, তা নিয়েই সংশয় জানিয়েছেন ক্রেতা ও ভোক্তারা। যদিও অভিযান পরিচালনায় সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, অভিযানের পাশাপাশি মনিটরিং ব্যবস্থা থাকায় এসব অভিযান অনেকটাই সফল।

বিজ্ঞাপন

ভোক্তারা বলছেন, পণ্যের মান নিয়ন্ত্রনকারী সংস্থা যেন সবসময় বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা উৎপাদন কারখানাগুলোকে মনিটরিং করে। একই কথা বলছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংশ্লিষ্ট বিশেজ্ঞরাও। তারা বলছেন, বিশেষ অভিযানের পাশাপাশি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি বাজারজাত প্রতিষ্ঠান বা কারখানাগুলোকে প্রতিনিয়ত নজরদারিতে রাখে, তাহলে এসব অপরাধ প্রবণতায় লাগাম টানা সম্ভব।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরে বিএসটিআইয়ের ভেজালমুক্ত অভিযানে প্রায় ৭৮টি কারখানাকে সিলগালা করা হয়েছে। এসব কারখানার ৫৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রায় ৪১ লাখ টাকাও জরিমানা করা হয়েছে।

ওই ৪ সেপ্টেম্বরেই বিএসটিআই ও র‌্যাবের যৌথ অভিযানে মিরপুরের লালমাটিয়ায় নদী বেভারেজ ও তাবাসসুম ড্রিকিং ওয়াটার, মিরপুর-১০-এ সেফ ড্রিকিং ওয়াটার ও মিরপুর-২-এ সোনালী ড্রিকিং ওয়াটার নামের পানি বাজারজাতকারী চারটি প্রতিষ্ঠানের দুইটিকে ৩ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে, তিনটিকে সিলগালা করা হয়েছে এবং দুইটির বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আইন কর্মকর্তা সারোয়ার আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময় বিএসটিআই ও ওয়াসাসহ বিভিন্ন সেবাসংস্থার সহযোগিতায় এ ধরনের অভিযান চালিয়ে আসছি। যতদিন পর্যন্ত এসব অপরাধ চলবে, ততদিন আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’ কোথাও এ ধরনের অপরাধের খবর পেলেই অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।

র‌্যাবের এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আরও বলেন, ‘মানুষ অপরাধ করলে একটা শেল্টার খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এখানে কোনো ক্ষমতার আশ্রয় নিয়ে অপরাধ করার সুযোগ নেই। আমরা কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব না করে প্রতিটি খাতে অভিযান পরিচালনা করছি। কোন প্রতিষ্ঠান কে চালায়, কার আত্মীয়— সেগুলো আমাদের দেখার বিষয় নয়। অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধী কিনা— সেটিই আমাদের একমাত্র বিবেচ্য। তাই অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই।’

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ও বিশেষজ্ঞ জাব্বার মণ্ডল সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভোক্তারা যেন ভেজালমুক্ত পণ্য ব্যবহার করতে পারেন, সেজন্য বিশেষ অভিযান নিঃসন্দেহে ভূমিকা রাখে। কারণ এতে জরিমানা ও শাস্তির কারণে অপরাধ প্রবণতা কমে যায়। কিন্তু এটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অবশ্যই বিএসটিআই বা সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থাগুলোর কড়া নজরদারি বাড়াতে হবে। সেইসঙ্গে সিটি করপোরেশনকেও লাইসেন্স দেওয়ার আগে ভাবতে হবে, ওই প্রতিষ্ঠানটি লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্য কি না। তা না হলে সেসব অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ম মেনে কাজ করবে না। এতে ভোক্তার অধিকার চরমভাবে ক্ষুণ্ন হবে।’

জানতে চাইলে বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালক সরদার আবুল কালাম সারাবাংলাকে বলেন, আমরা বাংলাদেশের ১৯৪টি পণ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে কাজ করি। বিভিন্ন কারখানা বা প্রতিষ্ঠানকে সার্টিফিকেট দিয়ে থাকি। এর মধ্যে পানিও আছে। তবে সিটি এলাকায় এখন বোতল ও জারে পানি বাজারজাত করা হচ্ছে। এর জন্য যারা অনুমোদন নিয়েছে কিন্তু নিয়ম মানছে না কিংবা অনুমোদনই নিচ্ছে না, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান ও কড়া নজরদারি চলছে, চলবে।’

সরদার আবুল কালাম আরও বলেন, আগে আমাদের সীমাবদ্ধতা ছিল। আমাদের জনবল সংকট ছিল। সেই সংকট আমরা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। দেশের প্রতিটি জেলাতেই আমাদের কার্যক্রম চালাতে আরও এক হাজার জনবল বাড়ানো হবে। এতে করে অনুমোদিত কারখানাগুলোয় আমরা ২৪ ঘণ্টা নজরদারি রাখতে পারব। আবার যেসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে বা জরিমানা করা হয়েছে, তাদেরও মনিটরিং করা হচ্ছে। এ কার্যক্রম ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।’

সারাবাংলা/এসএইচ/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন