বিজ্ঞাপন

ওরা ১১ জন বিদেশের মাটিতে ওড়াল লাল সবুজের পতাকা

January 1, 2018 | 8:31 am

জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

জিনিয়া, সুজানা কিংবা সিয়ামদের দলে আছে মোট এগারজন। এদের বয়স ১৬ থেকে ২৭ এর মধ্যে। এই এগারজনের দল এ মাসেই হংকংয়ের মাটিতে উড়িয়েছে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা।

বিজ্ঞাপন

গত ১৬ থেকে ২০ ডিসেম্বর হংকংয়ের আন্তর্জাতিক অটিস্টিক দলীয় ট্যালেন্ট গালা তে ১৩ দেশের প্রতিযোগিতায় জয় ছিনিয়ে এনেছে তারা। কেমন ছিল জয়ী এই ১১ জনের হংকং- এ যাওয়ার অভিজ্ঞতা? কেমন করে এই অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হলো পিএফডিএ-র এই ১১ জন-সে অভিজ্ঞতা সারাবাংলাকে জানান, পিএফডিএ-ভকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের চেয়ারম্যান সাজিদা রহমান ড্যানি।

জাতীয় নাট্যমঞ্চে পাঁচবার এই দলটি নাটক করেছে, টিভিশো-রেডিও প্রোগ্রাম করেছে একাধিকবার। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে এই দলের দুই প্রথম অনুষ্ঠান সঞ্চলনার মতো কাজও করেছে। কিন্তু দেশের বাইরে কখনও এই সুযোগ আমাদের হয়নি বলে জানান সাজিদা রহমান।

এই গ্রুপটাকে তৈরি করা, একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে তারা পারর্ফম করবে- এটা অসম্ভব চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল। ১১ জনসহ মোট ১৫ জনের দলটিকে নিয়ে হংকং এ যাওয়ার বিষয়টি এত সহজ ছিল না, ছিল আর্থিক বিষয়টাও। তখন আমাদের পাশে দাড়ায় স্ট্যার্ন্ডর্ড চার্টার্ড ব্যাংক। স্ট্যার্ন্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের আর্থিক সহায়তা ছাড়া আমাদের পক্ষে এই জার্নি করা সম্ভব হতো না। তাই আমি বিশেষ ধন্যবাদ এবং আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই স্ট্যার্ন্ডাড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রতি বলেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, পিএফডিএ-ভকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের কালচারাল উইং কারিশমার সদস্য এই ১১ জন স্পেশাল পার্সন, তাদের ভিসা, প্লেন, নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, ভিন্ন আবহাওয়া-সবকিছু নিয়ে আমরা খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম তারা আসলে কতটুকু করতে পারবে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সেখানে গিয়ে বাংলাদেশের এই দলটি জিতে নিয়েছে দুটি অ্যাওয়ার্ড।

কথা বলে জানা যায়, হংকং- এর অ্যান অ্যান ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন ফাউন্ডেশন এই গালা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে আবেদন পাবার পর পর তারা প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করে কারা আসবে। নেওয়া হয় অটিস্টিক ব্যক্তিদের পরিবেশনার ভিডিও। পরে ভোটিং এর মধ্যেমে নির্বাচিত দল নির্বাচন করে।

বিজ্ঞাপন

পিএফডিএ-র কারিশমার এ দলটি ক্রিকেট নিয়ে একটি পরিবেশনা করে এবং এসময় এগিয়ে আসে বিসিবি (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড)। ভিডিওটি বিসিবি তাদের ওয়েবসাইটে দেয়। আর সেখানে ভোট পেয়ে পঞ্চম হয় কারিশমার এই দল। সাজিদা রহমান বলেন, বিসিবির প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ এবং এসব বাচ্চাদের প্রতিও তাদের দায়িত্ব রয়েছে সেটাও তারা এর মাধ্যমে দেখিয়েছে।
তিনি বলেন, ভোটিং এর পর আমরা নির্বাচিত হলাম বিশ্বব্যাপী। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চায়না, হংকং, মালদ্বীপ, ম্যাকাও, মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড এবং বাংলাদেশ এই ১৩ টি দেশ অংশ গ্রহণ করে এই প্রতিযোগিতা।

হংকং এ যাবার পর মূল অনুষ্ঠানে অন্য দেশের অটিস্টিক বাচ্চারাও অসাধারণ পরিবেশন করেছে জানিয়ে এই দলের ইনচার্জ মারিয়া সারা বলেন, কিন্তু অন্য দেশের অংশগ্রহনকারীরা প্রত্যেকে ইনডিভিজুয়াল পারফর্ম করছে, যেগুলো তাদের ব্যক্তিগত টেলেন্ট। কিন্তু আমরা বাংলাদেশের বায়োস্কোপ, কুড়েঘর -পুরো বাংলাদেশের একটি মিনিয়েচার যেন ওখানে হয় সে প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছিলাম আমরা। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য, বাঁশি বাজানো, পালকিতে করে বউ যাওয়া, দই ওয়ালাসহ গ্রামীণ পটভুমি এবং নাচ ও গানে অংশ নেয় এই ১১ জন।

সাজিদা রহমান জানান, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল, এই ১১ জনের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র তারা এক জায়গায় স্টেজে নিয়ে এসেছে। এবং সেটা বাংলাদেশকে উপস্থাপন করেছে। আমরা কিছুটা নার্ভাস ছিলাম, কিন্তু ওরা ছিল আত্মবিশ্বাসি। যে মুহূর্তে তারা স্টেজে উঠেছে সেই মুহূর্ত থেকে তারা অন্যরকম। ’আমারও দেশেরও মাটিরও গন্ধে’ গানের সঙ্গে তারা পুরো বাংলাদেশকে তুলে ধরেছে দৃঢ়তার সাথে।

বিজ্ঞাপন

‘হংকং এ এই বাচ্চাদের নানা ধরণের সমস্যা ছিল, তাদেরকে ম্যানেজ করতে হয়েছে কতোভাবে। কিন্তু এই বাচ্চারা যখন স্টেজে উঠেছে তারা তাদের প্রত্যেকের যার যা রোল সেটাকে ‘অ্যাবসুলেটলি পারফর্ম’ করেছে, বিন্দুমাত্র এদিক ওদিক হয়নি’- সাজিদা এসব কথা বলছিলেন হাসিমুখে কিন্তু কথার ফাঁকে তার চোখের কোনায় জমা পানি চিকচিক করতে থাকে। সাজিদা রহামান ড্যানি বলেন প্রত্যেকে প্রত্যেকের ক্যারেক্টার দেখিয়েছে অবিকল। যে কারনে আমরা ‘বেস্ট ভিজ্যুায়াল ইফেক্টেস’ এবং ‘এক্সিলেন্স পারফর্মেন্স অ্যাওয়ার্ড’ জিতেছি।

এর পুরোটা কৃতিত্ব আমার বাচ্চাদের- ইট ওয়াজ বিউটিফুল, চোখে পানি নিয়ে বলেন সাজিদা রহমান ড্যানি। এখানে আরেকটি বিষয় বলতে চাই, অন্য দেশের অংশগ্রহণকারীরা কিন্তু নিজের দেশকে উপস্থাপন করেনি, তারা নিজেদের ব্যক্তিগত ট্যালেন্ট উপস্থাপন করেছে।

কিন্তু আমাদের বাচ্চারা ব্যক্তিগত কিছু পারফর্ম করেনি,‘ ইটস নট ইনডিভিজ্যুায়লা, ইভেন ইটস নট প্রতিষ্ঠান’-এখানে যেন বাংলাদেশের পতাকা সামনে আসে, বাংলাদেশ হিসেবে যেন আমরা স্বীকৃতিটা পাই-সে চেষ্টাই ছিল আমাদের। আমাদের যতটুকুই কমতির জায়গা থাকুক, যতোটুকুই ননচার্মিং বিষয় থাকুক, যখন দেশ হিসেবে উপস্থাপন করা হবে তখন এর ভাবমূর্তি অনেক বেশি। দেশের গানের সঙ্গে গ্রামীন বাংলাদেশের উপস্থাপনা- অনুষ্ঠানে যারা ছিলেন, প্রতিটি মানুষ সেটা ফিল করেছে। তারা কেউ ভাষা বোঝেনি কিন্তু তারা ফিল করেছে। এমনকী যারা সংগঠক ছিল, তারাও ওদের পরিবেশনার পরে আমাদের কাছে এসেছে বলেছে ‘ চমৎকার পরিবেশনা।

বাংলাদেশ থেকে এর আগেও এখানে অংশগ্রহণ করেছে কিন্তু এত সুদিং পরিবেশনা আমরা এর আগে দেখিনি, আমরা খুব খুশি তোমাদের নিয়ে।’ যার কারনে পরবর্তী বছরের জন্যও তারা আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আর এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় ১১ জনের সবাই জানায়, তারা খুব আনন্দিত পুরষ্কার পেয়ে, এমনকি তারা তাদের পরিবেশনাও করে দেখায়।

চারজন শিক্ষক এবং সাজিদা রহমান ড্যানি সহ মোট ১৫ জনের এই দলটি হংকং- এ যান। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এই মানুষদের নিয়ে সাধারণ মানুষের যে প্রচলিত ধারণা ‘পার্সন ডিজঅ্যাবিলিটি’ মানে অনেক বেশি কমতি আছে এটা আসলে সবসময় সত্যি নয় বলে মন্তব্য করেন ড্যানি। বলেন, কমতি আছে আমি স্বীকার করি, কিন্তু তারা যে সবসময়ই অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবে এটা না, হংকং এ গিয়ে এই বাচ্চাগুলো প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাজগুলো নিজেরা করেছে।

সাজিদা রহমান বলেন, প্রতিটি বাচ্চা হংকং থেকে ফিরে এসেছ অনেক বেশি ম্যাচিউরিটি আর কনফিডেন্ট নিয়ে-আর এটাই আমরা চেয়েছি। এ প্রতিবেদক যখন পিএফডিএ থেকে বের হয়ে আসছে, তখনও জিনিয়া, সুজানা তালুকদার, সিয়াম উল করিম, চৌধুরী মিরান মোহাম্মদ সগীর, সাফওয়ানুল আমিন সাফোয়ান, রাহিব রহমান, মুনতাসিম তাজওয়ার স্বর্ণীল, ফেরদৌস শাহরিয়ার তন্ময়, তাবাসসুম মেহজাবীন, সাফওয়াথ নাসিফ, মইনুল ইসলাম সুপ্ত, সাকিব খান-এই ১১ জন গাইছে, ‘আমারও দেশেরও মাটির-ও গন্ধে ভরে আছে সারামন’….আর সেই সুর শোনা যাচ্ছিলো অনেকটা দূর পর্যন্ত।

সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন