বিজ্ঞাপন

ঘূর্ণিস্রোত দেখলেই বেশি ভয় পদ্মায়

September 12, 2018 | 3:44 pm

||মাহমুদ মেনন, নির্বাহী সম্পাদক||

বিজ্ঞাপন

সকালের দিকটায় সবাই বলাবলি করছিল- আজ একটু কম ভাঙ্গছে। একবেলা পদ্মার কিছুটা শান্তরূপ দেখে আশায় বুক বেঁধে সবার মুখেই একটা কথা- আজ একটু কম। আজ একটু কম।

সকাল থেকেই আকাশে কড়া রোদ। দুপুর নাগাদ সে রোদ আরও চড়া হয়ে গা পুড়িয়ে দিচ্ছিলো। তারই মধ্যে উদোম গায়ে নিজের বাড়ির ইটগুলো খুলে খুলে নিচ্ছিলেন রতন ব্যাপারী। বাড়ির সবাই কাজে লেগে পড়েছে। গাছগুলো কাটা হয়েছে, সেগুলো থেকে ডালপালা ছড়ানোর কাজে ব্যস্ত বাড়ির নারীরা। দু’জন ভেঙ্গে ফেলা বাড়ির কাঠ-টিন এগুলো মাথায় করে তুলছেন পদ্মার তীরে ভেড়ানো ট্রলারে। পরিবারটি দূরের কোনো গ্রামে চলে যাচ্ছে।

নড়িয়ার মোক্তারের চর, সাহেব বাজার, মুলফতগঞ্জ অংশে নদীর তীর ধরে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে একই চিত্র দেখা গেলো। আর দেখা গেলো অসংখ্য মানুষের আনাগোনা। এরা কেউ এসেছেন অদূরের গ্রামগুলো থেকে, মনে যাদের শঙ্কা, এভাবে ভাঙ্গন চলতে থাকলে তাদের গ্রামও পদ্মা গ্রাস করে নিতে সময় লাগবে না। কেউ এসেছেন দূর-দূরান্ত থেকে। আগ্রাসি পদ্মার কথা তারা শুনেছেন। নিজের চোখে দেখে যেতে চান। এরা কেউ এসেছেন বাসে চেপে, কেউ ইজি বাইকে, আবার কেউ পায়ে হেঁটে। এদের কেউ যুবক, কেউ তরুণ, কেউ মধ্যবয়সী, কেউ বয়ষ্ক নারী-পুরুষ।

বিজ্ঞাপন

নড়িয়া বাজার অংশে গিয়ে সারাবাংলা’র টিমটি গাড়ি থেকে নামতেই একটা ভিড় জমে যায়। মিডিয়াকে যেনো তাদের অনেক কথা বলার আছে। কারো কারো এমন আকুতি, এমনই মনোভাব এইক্ষণে কথাটি বলে দিলে, এখনই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আর ভাঙবে না পদ্মা। ডুবন্ত মানুষটি যেমন খড়-কুটোটিকে তার বাঁচার সম্বল মনে করে- এই মানুষগুলোর এখন সেই দশা। এক বেলা পদ্মার অপেক্ষাকৃত শান্ত চেহারা তাদের বুকে আশা জমায়।

কিন্ত দুপুর না গড়াতেই ইশান কোনে জমে মেঘ। পদ্মা ফুঁসতে শুরু করে। ক্রমেই রুদ্র হয়ে ওঠে। তাতে অবশ্য অবাক হয় না মানুষগুলো। তাদের বুকের গভীর থেকে কেবল বেড়িয়ে আসে গভীর নিঃশ্বাস। বিকেল নাগাদ সে কি চেহারা পদ্মার। মুলফতগঞ্জের অংশে ভাঙছে সবচেয়ে বেশি। ৫০০ বছরেরর পুরোনো এই বাজারটির ওপর যেনো পদ্মার আক্রোশ। এরই মধ্যে বাজারের হাজার দুয়েক দোকানপাট, স্থাপনা নিজের গর্ভে নিয়ে নিয়েছে পদ্মা। কিন্তু তাতেও থামার ইচ্ছা নেই।

বাজারের মাঝ দিয়ে নড়িয়ার দিকে যে পাকা রাস্তাটি গিয়েছিলো সেটি এখন পুরোই নদীর গর্ভে। মাঝখানে একটি সেতু সেই সড়কের সাক্ষী হয়ে টিকেছিল, তারও একাংশ ভেঙ্গে পড়েছে। ওদিকে নড়িয়া ছাড়িয়ে কীর্তিনাশা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত যে অংশ তারও অনেকটা নদী গর্ভে। কীর্তিনাশার ওপারে মোক্তারেরর চর শেরআলীর ডাঙ্গির ওপর দিয়ে যে পাকা সড়কটি আড়াইমাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো তারও দুই মাইলের বেশি নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

এরপরও কী পদ্মা থামবে না? না থামেনি। থামতে চায় না।

মুলফতগঞ্জ বাজারে পান-শাদা-সুপুরি-চুন-খয়েরের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন পিঞ্জির আলী ছইয়াল। বাপ-দাদার আমল থেকে প্রায় দেড়শ’ বছরের পুরোনো এই ব্যবসা তাদের। ছইয়ালদের সব ছিলো। বাজারের ওপাশটায় যে অংশ এখন পুরোই নদীর গর্ভে সেভানে ছয় ঘরের নিজস্ব বাড়ি ছিলো। পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে পিঞ্জির আলী আবারও তার পান-সুপুরির দোকান সাজিয়ে বসেছেন। এখন তিন হাজার টাকা ভাড়ায় একটি ঘর নিয়েছেন। সেখানে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে থাকেন। দুই রুমের একটি বাসা। পিঞ্জির আলী বলেন, ছয়টি ঘর ছিলো যার পুরোটা জুড়ে তার পরিবারটি বাস করতো। চমৎকার ছিলো সে বাড়ি কিন্তু সে কথা ভেবে আজ আর কোনও লাভ নেই। জীবনের নতুন সংগ্রামে নেমে পড়েছেন এই ষাটোর্ধ ব্যবসায়ী।

যেদিন তার ঘরগুলো নদীর গর্ভে যায় সেদিনের কথা বলছিলেন পিঞ্জির আলী। তিনি বলেন, ধারণা করেছিলাম দুই-চার দিনে ঘর নদীতে যাবে না। কিন্তু সেদিন সকাল থেকে শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। সে বৃষ্টি পেয়ে পদ্মা ফুঁসে উঠলো। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভেঙ্গে গেলো প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকা। চারিদিকে চিৎকার-শোরগোল। যে যেমনটা পারছে, নিজের সম্পদ রক্ষায় ব্যস্ত। পিঞ্জির আলীরাও কিছু টিন, কাঠ এগুলো বাঁচাতে পারলেন, বাকি সব গেলো নদীতে।

এই বৃষ্টি এলেই ভয় বেড়ে যায় পদ্মাপাড়ের মানুষগুলোর।

বিজ্ঞাপন

আর সে কারণেই দুপুরের পর ইশাণ কোনে মেঘ দেখে সবার মনে শঙ্কা বাড়তে থাকে। বিকেল নাগাদ পদ্মায় বাড়তে থাকে স্রোত। এসময় আবার ভাঙতে শুরু করে পদ্মা। মুলফতগঞ্জ বাজারের পাশেই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’র সীমানা প্রাচীর আগেই ভেঙ্গেছে। এই বিকেলে ভেঙ্গে পড়ল গ্যারেজের একাংশ।

এসময় শত শত মানুষ ভয়ডর উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন সেই ভাঙনের দৃশ্য। একেক বড় বড় গাছ ভেঙ্গে নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সেসব দেখে হাহাকার সবার কণ্ঠে।

ভীরের মধ্যে একজন নদীতে একটি ঘূর্ণিস্রোত দেখিয়ে বললেন, ওই ঘুর্ণিটা দেখলেই বেশি ডর লাগে। তার মতে, এই ধরনের ঘুর্ণির কারণে নদী বেশি ভাঙ্গে। তলায় মাটির নিচের অংশটা আগেই ভেঙ্গে নেয়। সে কারণে উপরের অংশে প্রথমে ফাঁটল ধরে। আর ধীরে ধীরে তা ভেঙ্গে পড়ে।

এনিয়ে কথা বলতে বলতেই দুটি কৃষ্ণচুড়া গাছসহ চত্ত্বরের অনেকটা অংশ ভেঙ্গে পড়লো পদ্মার গর্ভে। একটি হরিতকি, একটি জারুল গাছ তখনও দাঁড়িয়ে… সেগুলোর একই পরিণতি ঘটা তখন কেবলই সময়ের ব্যবধান মাত্র।

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন