বিজ্ঞাপন

যাত্রাপথে পুলিশের চেকিং, বিপাকে গণপরিবহনের যাত্রীরা

September 15, 2018 | 7:09 pm

।। সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ১৫ সেপ্টেম্বর (শনিবার) বিকেল সাড়ে ৪টা। কাওরান বাজারের বাস স্টপেজ থেকে একাধিক যাত্রীর মাঝে ঠেলাঠেলি করে কোনো মতে আয়াত পরিবহনের একটি বাসে উঠলেন হাসিবুর রহমান। যাবেন মিরপুর-১০। দীর্ঘ ১ ঘণ্টা অপেক্ষার পর বাসে উঠতে পেরে তিনি মনে মনে অনেক খুশি। কিন্তু সে খুশি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। বাসটি ফার্মগেইট পার হয়ে যখন সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে আগারগাঁও দিকে যাচ্ছিল তখন সেখানে ট্রাফিক পুলিশের চেকিংয়ে থামতে হলো।

এসময় পুলিশ নিয়মানুযায়ী প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তল্লাশি করে দেখল বাসের কাগজপত্র ঠিক থাকলেও চালকের কাগজপত্র নেই। এ অবস্থায় মামলা দিলেও বাসটি সে চালিয়ে নিতে পারবে না বলে জানালো ট্রাফিক পুলিশ। একথা শুনে পাশে থাকা হেলপার টাকা নিয়ে কেটে পড়ে যাত্রীদের অগোচরে। যেহেতু বাসটি আর যাবে না তাই যাত্রীদের অন্য বাসে যেতে হবে। সেই সঙ্গে অন্য আরেকটি বাসে ওঠার লড়াই তো আছে। এমন পরিস্থিতির শিকার যাত্রীদের চোখে মুখে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছিল সেসময়।

হাসিবুর সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেক কষ্টে অন্য যাত্রীদের ঠেলাঠেলির মধ্যেও এক ঘণ্টা পর বাসে উঠে একটু স্বস্তি পেয়েছিলাম। এ কারণে কাওরান বাজার থেকে মিরপুর-১০ এ ২০ টাকার ভাড়া ২৫ টাকা নিলেও আপত্তি করিনি। কিন্তু এখানে এসে ট্রাফিক পুলিশের চেকিংয়ে পড়ে বাসটি মামলা খেলো। এখন আর যাবে না। এর মধ্যে আবার হেলপার টাকা নিয়ে পালিয়েছে। এত কষ্টে করে উঠে এতগুলো টাকা নষ্ট করেও জায়গায় পৌঁছাতে পারলাম না। সব বিড়ম্বনা শুধু আমাদের জন্য। বাস পাব না ঠিক মত, পাইলেও যেতে পারব না, এভাবেই চলছে। আবার আমাদের ভাড়া নিয়ে পালিয়ে যাবে হেলপার, কিন্তু পুলিশ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেবে না।’

বিজ্ঞাপন

একই পরিস্থিতির শিকার বিকল্প অটো সার্ভিস নামের গণপরিবহনের একটি বাসের যাত্রী নাজমুল হাসান। তিনি মিরপুর ১২তে যাওয়ার জন্য ফার্মগেইট থেকে বাসটিতে উঠেছিলেন। ওই বাসটিও ট্রাফিক পুলিশের চেকিংয়ে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কষ্ট করে উঠা ওই বাসের যাত্রীরা বিকল্প উপায়ে গন্তব্যে যেতে দেখা যায়।

নাজমুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘এত কষ্ট করে উঠেও গন্তব্যে সময়মত যেতে পারলাম না। বিকেল ৫টায় মিরপুর ১২তে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। এজন্য সাড়ে তিনটা থেকে ফার্মগেইটে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু যতগুলো বাস পেলাম একটাতেও উঠতে পারলাম না ঠেলাঠেলির কারণে। সাড়ে চারটার দিকে একটা বাসে যা উঠলাম তাও আবার ট্রাফিক পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন আবার বিকল্প উপায় বের করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘পুলিশ চেকিং করে ভালো কথা। এটা আমাদের জন্য উপকার। তাই বলে তাদের এমন উপকার পেতে গিয়ে আমরা কি হয়রানির শিকার হবো? তারা যদি বাসটি যেখান থেকে ছেড়ে এসেছে সেখানে চেকিংয়ের কাজটি করতো তাহলে কি মাঝপথে কিংবা যাত্রাপথে এসে আমাদের কষ্ট পেতে হতো? এতগুলো যাত্রী এখন অন্য আরেকটি বাসের অপেক্ষা করবে। এছাড়া পুলিশ যদি বাসটি সিজ করবে তাহলে আমাদের ভাড়াগুলো হেলপার থেকে তুলে দিতে পারতো। কিন্তু তা করছে না। আবার আমরা বললেও তা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই তাদের।’

বিজ্ঞাপন

গণপরিবহনে এমন দুর্ভোগের শিকার শুধু হাসিবুর কিংবা নাজমুল নয়, রাজধানীতে প্রতিনিয়ত এমন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন একাধিক সাধারণ যাত্রী। অনেকে এসব দুর্ভোগে পড়ে নীরবে সইলেও কেউ কেউ প্রতিবাদ করতে চাই। কিন্তু তাতেও মিলছে না প্রতিকার। এতে অনেক সময় সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গেও ট্রাফিক পুলিশের বাকবিতণ্ডাও লাগছে হরহামেশাই। ফলে এমন চেকিং থেকে হয়রানিমুক্ত কার্যকরী পদক্ষেপ চায় সাধারণ যাত্রীরা।

তবে ট্রাফিক পুলিশ বলছে, কাগজপত্র তল্লাশি করা এটা তাদের দায়িত্ব। কেউ অনিয়ম করে কিংবা ট্রাফিক আইন না মেনে গাড়ি চালালে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে যদি কোনো দুর্ভোগের সৃষ্টি হয় তাহলে সাময়িক অসুবিধা সাধারণ যাত্রীদের মেনে নিতে হবে। নয়তো আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা ট্রাফিক পুলিশের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।

তবে পরিবহন সংশ্লিষ্ট বিশেজ্ঞরা বলছেন, মাঝপথে গণপরিবহনে ট্রাফিক পুলিশের তল্লাশির কারণে সাধারণ যাত্রীদের দুর্ভোগ চাইলে এড়ানো যায়। এজন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) বা সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তাদের একটু আন্তরিকতা থাকলেই সম্ভব। কারণ যে স্থান থেকে বাসটি ছাড়বে সেখান থেকে যদি প্রয়োজনীয় চেকিং করে তারপর ওই বাসে যাত্রী উঠানো হয় তাহলে যাত্রা পথে আর যাত্রীদের হয়রানির শিকার হতে হবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য প্রয়োজনে অবকাঠামো অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বাস স্টেশন স্থাপন করে এ কাজ বাস্তবায়নের পরামর্শও দিয়েছেন তারা।

ঢাকা বাস মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক গোলাম সামদানী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেক করা ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব। তাই এটা তারা যখন, যেকোনো স্থান থেকে করতে পারবে। এটা নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে মাঝ পথে বাস চেকিংয়ের পর যখন ওই বাসটি থেমে যায় তখন শুধু যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েন এমনটা না। সেই সঙ্গে পরিবহন কোম্পানির আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি মানও ক্ষুন্ন হয়।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘তাই যাত্রীদের দুর্ভোগ এবং আমাদের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি মান রক্ষার্থে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাস স্টেশনে আমরা ভিজিল্যান্স টিম গঠন করেছি। টিমগুলো বাস ছাড়ার আগে কাগজপত্র চেক করে তারপর স্টেশন থেকে বাস ছাড়ে। তবে আমাদের সব বাস দিন শেষে স্টেশনে আসে না স্থান সংকুলানসহ নানা কারণে। যে কারণে মাঝ পথে চেকিংয়ে তারা ধরা পড়ে। এতে দুর্ভোগ ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা।’

তবে এ দুর্ভোগও খুব দ্রুত নিরসন হবে বলে আশাবাদী তিনি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সহ-সভাপতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায় ট্রাফিক পুলিশ বাসটি মাঝ রাস্তায় থামানোর পর যিনি বাস ড্রাইভার তার ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই, বাসের কোনো কাগজপত্র নাই কিংবা অন্যকোনো একটা সমস্যা দেখিয়ে দিয়ে রাস্তার মাঝখানে বললো আপনারা সবাই নেমে যান। এ গাড়িটা আমরা সিজ করেছি। তাহলে এই যে মানুষগুলো, ঢাকার মত যেখানে বাসে উঠায় দায়, এ মানুষগুলো যার মধ্যে বৃদ্ধ হতে শুরু করে অনেকের আবার বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার তাড়া আছে তারা কোথায় যাবে? অনেক সময় এমন পরিস্থিতিতে হেলপার-কন্টাক্টর ভাড়া নিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু যাত্রীদের মধ্যে এমন অনেকেই আছে যারা নিম্ন এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের। যাদের এ ভাড়াটা যে পুনরায় দিবে সে সামর্থ্যও থাকে না। এ মানুষগুলো কি করবে? কাজেই মাঝ পথে এভাবে বাস থামিয়ে চেকিং করা সমাধান হতে পারে না। বরং যাত্রীদের দুর্ভোগ ও হয়রানি করা হয়। এর বিকল্প চিন্ত করতে হবে সংশ্লিষ্টদের ‘

তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু প্রতিদিন রাস্তায় নতুন বাস নামে না, সেহেতু ডিএমপির পক্ষ থেকে একটা বার্ষিক পর্যবেক্ষণ করতে পারে। একজন মালিকের কতগুলো গাড়ি আছে, সেগুলোর রেজিস্টেশন নাম্বার কত এবং সেগুলোর ফিটনেস আছে কিনা এগুলোর সার্বিক বিষয় নিয়ে একটা বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করতে পারে। সেই সঙ্গে এসব বাসের যারা ড্রাইভার তারা বছরের শুরুতে ডিএমপি থেকে ক্লিয়ারেন্স ছাড়পত্র নিয়ে নিতে পারে। তাহলে কারা অনিয়ম করছে তাদের সহজেই চিহ্নিত করা যেতো এবং নিয়মিত ট্রাফিক দায়িত্ব পালন করতে চাইলে বাসটির যাত্রা শুরুর আগে এবং যাত্রা শেষে এ চেকিংয়ের কাজটি করতে পারে পুলিশ। তাহলে অপরাধীও ধরা পড়লোও এবং জনদুর্ভোগ এমনকি হয়রানিও বন্ধ হবে।’

একই কথা বললেন স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে চেকিংয়ের কারণে যাত্রী হয়রানি হয়। এতে যাত্রীরা ক্ষুব্ধ। তাই এটা যেখান থেকে বাসটির যাত্রা শুরু হবে সেখান থেকে চেকিং করেই বাসটি ছাড়লে এ ধরনের দুর্ভোগ অনেকাংশেই এড়ানো সম্ভব।’ এজন্য প্রয়োজনে নির্ধারিত স্থানগুলোতে অবকাঠামোর উন্নয়নের মাধ্যমে স্টেশন স্থাপন করে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে চেকিং কার্যক্রম করা সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।

ডিএমপির ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মীর রেজাউল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো। এতে যদি সাধারণ যাত্রী কোনো অপ্রত্যাশিত দুর্ভোগের শিকার হন তাহলে সেটির জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। তবে মাঝপথে চেকিংয়ের মাধ্যমে যাত্রীরা যাতে হয়রানির শিকার না হন এবং ভবিষ্যতে ট্রাফিক ব্যবস্থায় আরও পরিবর্তন আনতে পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। আশা করছি সেটি বাস্তবায়ন হলে এসব দুর্ভোগ হ্রাস পাবে।’

সারাবাংলা/এসএইচ/এমও

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন