বিজ্ঞাপন

পদ্মায় ড্রেজিং শুরু, নড়িয়া বাঁচানোর উদ্যোগ ছিল বাস্তবায়ন ছিল না

September 18, 2018 | 11:49 am

||এমএকে জিলানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট||

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার শহর-গ্রাম প্রতি মুহুর্তে পদ্মার ভাঙনে বিলীন হচ্ছে। সবশেষ পাওয়া তথ্য জানাচ্ছে, ২০৩ দশমিক ৫৮ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এই উপজেলায় ২০০৯ থেকে চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ১৪১০ হেক্টর বা ১৪ দশমিক ১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পদ্মার গর্ভে হারিয়ে গেছে।

এখনো ভাঙন চলছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে- প্রমত্তা পদ্মার ভাঙন এভাবে চলতে থাকলে পুরো নড়িয়া উপজেলা হারিয়ে যেতে পারে। অথচ সংশ্লিষ্টরাই বলছে, আগে থেকে কার্যকর উদ্যোগ নিলে নড়িয়ার হারিয়ে যাওয়া ভূমি বাচাঁনো যেত। টিকে থাকতো সেই সব শহর-গ্রাম-জনপদ। যা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

গবেষণাধর্মী সরকারি সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সেন্টার (সিইজিআইএস) এর পরিচালক ড. মমিনুল হক সরকার এ প্রসঙ্গে সারাবাংলা’কে বলেন, ‘কোথায় কেমন নদী ভাঙন হতে পারে, এই তথ্য আমরা প্রতি বছরই আগাম জানাতে পারি। আর সেটা করেও আসছি। এ বছরও পদ্মার আঘাতে নড়িয়াতে কেমন ভাঙন হতে পারে তা সরকারকে আগেভাগে জানিয়েছি। তখনই প্রতিরোধের উদ্যোগ নিলে এতটা ক্ষতি হতো না।’

বিজ্ঞাপন

সিইজিআইএস নড়িয়ার নদী ভাঙন সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি গত জুনমাসে দিয়েছে বলেও জানান ড. মমিনুল।

তবে বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনের কাছে পৌঁছায়নি। ফলে স্থানীয়ভাবে সতর্কতা বা সচেতনতা তৈরির উদ্যোগটিও ছিল অপ্রতুল।

নড়িয়ার ভাঙন কবলিত এলাকা ঘুরে আসে সারাবাংলা.নেট এর একটি টিম। সেসময় নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াছমিনের সাথেও কথা হয়। তিনি বলেন, ‘পদ্মার আঘাতে নড়িয়া ভাঙতে পারে, সরকারের পক্ষ থেকে এমন কোনো তথ্য পাইনি।’

বিজ্ঞাপন

তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ভাঙনের কথা জানিয়েছিল এমনটা স্বীকার করে তিনি বলেন, পদ্মাপাড়ের মানুষগুলো সরকারিভাবে কিছু না জানলেও তারা নিজেরা ধারণা করতে পেরেছিলো এবছরও ভাঙন অনেক বেশি হবে।’

সানজিদা বলেন, ‘তুলনামূলক হিসাবে গত বছরের চেয়ে এবছর পদ্মার ভাঙন কম। তবে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। কারণ হচ্ছে গত বছর শুধু জমি (ফসলের) ভেঙেছে। অন্যদিকে, এবার মানুষের বসত-বাড়ি, বাজার-ঘাট, মসজিদ-মন্দিরসহ রাস্তা-ঘাট ভেঙেছে।’

সিইজিআইএসের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে-, পদ্মার আঘাতে ২০০৯ সালে নড়িয়ার ৫০ হেক্টর, ২০১০ সালে ৮০ হেক্টর, ২০১১ সালে ৬০ হেক্টর, ২০১২ সালে ৬০ হেক্টর, ২০১৩ সালে ৮০ হেক্টর, ২০১৪ সালে ২০ হেক্টর, ২০১৫ সালে ১৩০ হেক্টর, ২০১৬ সালে ৩৮০ হেক্টর, ২০১৭ সালে ৪০০ হেক্টর এবং ২০১৮ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ১৫০ হেক্টর ভূমি নদীগর্ভে বিলিন হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জানা গেছে, নড়িয়ায় যে পদ্মা আঘাত হানবে তার আগাম তথ্য সংস্থাটি আগেই পেয়েছিল। তথ্য পেয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করলেও অজানা কারণে তা কাজে আসেনি।

বিজ্ঞাপন

বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নড়িয়াকে বাঁচাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড কয়েক বছরে আগে থেকেই বাধ নির্মাণ ও ডেজিংয়ের জন্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে পাঠায়। কিন্তু সেগুলো আমলে নেওয়া হয়নি। ২০১৭ সালে ভাঙনের রূপ ভয়াবহ হলে একনেক থেকে প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। গত জানুয়ারিতে সে অনুমোদন দেওয়া হলেও কাজ শুরু করা যায় নি।

তবে এখন পুরোদমে কাজ শুরু হয়েছে বলেই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে নদী ড্রেজিংয়ের কাজও শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে এই ড্রেজিং শুরু করা হয়।

নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট এর মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) অরুন চন্দ্র মহোত্তম সারাবাংলা’কে বলেন, ‘নড়িয়ায় নদী ভাঙন ঠেকাতে আমরা মডেল স্টাডি শুরু করেছি। ওইখানে আমরা নদী খননের কাজ করব। সোমবার (১৭ সেপ্টেম্বর) থেকে আমরা মডেল স্টাডি তথ্য সংগ্রহের জন্য জরিপের কাজ শুরু করেছি। আগামী ৮ মাস এই জরিপ কাজ চলবে। জরিপ কাজ শেষে কী করতে হবে সেই ফলাফল আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দিব। তারা পরবর্তী ধাপ বাস্তবায়ন করবে।’

নড়িয়ায় ভাঙন ঠেকাতে সোমবার (১৭ সেপ্টেম্বর) থেকে নদী খননের কাজ শুরু হয়েছে জানিয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব কবির বিন আনোয়ার সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত ২ জানুয়ারি একনেক বৈঠকে শরীয়তপুরের জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলার ভাঙন প্রতিরোধে ৯ কিলোমিটার জুড়ে ‘পদ্মার ডান তীর রক্ষা প্রকল্প’শীর্ষক ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। যা থেকে গত জুলাই মাসে সাড়ে ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এ অর্থ ব্যবহার করে ১১ জুলাই থেকে ভাঙন এলাকায় জিও ব্যাগ (বালির বস্তা) ফেলা শুরু হয়, যা এখনও ফেলা হচ্ছে। আর এই খাতে আরো ২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।’

ভারপ্রাপ্ত সচিব আরো বলেন, ‘নড়িয়া-জাজিরার ভাঙন ঠেকাতে ৯ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার নদী খনন এবং ভাঙন রোধে ৯ দশমিক ৯০ কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া পদ্মা সেতুর ডান তীর ও বাম তীর বাঁধ রক্ষায় ১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ বর্ষা মৌষুম শেষ হলেই শুরু হবে। যা এরই মধ্যে একনেকের অনুমোদন মিলেছে।’

নড়িয়ার নদী ভাঙনরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম সোমবার (১৭ সেপ্টেম্বর) জাতীয় সংসদে বলেন, ‘পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাজ অন্য মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা। এখানে কারিগরি কিছু সমস্যা আছে। নদী ভাঙনরোধে কোনো প্রকল্প নিতে হলে পানির নিচে জরিপ করতে সময় লেগে যায়, উপর থেকে কিছু বোঝা যায় না। এতে প্রকল্পের কাজ শুরু করতে দেরি হয়ে যায়।’

তিনি আরো বলেন, ‘নড়িয়ায় নদী ভাঙনরোধে এরইমধ্যে ৭/৮ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। আরও ১২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কাজগুলো অতি দ্রুত হবে।’

সরেজমিন চিত্র
সরেজমিন রিপোর্টিংয়ে এ নিয়ে পদ্মাপাড়ের মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখে এসেছে সারাবাংলা.নেট টিম। গত ৯ সেপ্টেম্বর নড়িয়া উপজেলা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বানের পানি ধেয়ে আসছে প্রাণ চঞ্চল নড়িয়াকে গ্রাস করতে। টাইলস আর মোজাইকে গড়া শত শত আবাস-ভূমি চলে যাচ্ছে পদ্মার গর্ভে। পদ্মার উন্মাদনা দেখতে জায়গায় জায়গায় মানুষের জটলা।

বিলীন হওয়ার আগেই যে যার সম্পদ সরিয়ে নিচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তাদেরও দেখা গেল সরকারি সম্পদ সরিয়ে নিতে। নদী গর্ভে হারিয়ে যেতে পারে এমন সরকারি সম্পদগুলো নিলাম ডেকে বিক্রি করে দিচ্ছে উপজেলা প্রশাসন। পথে পথে নিলামে বিক্রি হওয়া কাটা গাছের স্তুপ আর বাড়ি-ঘর ও ভবনগুলোর ভাঙা ইট।

স্থানীয় বাসিন্দা আলাউদ্দিন খালাসি (বয়স ৬৫) সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই যে নদী দেখছেন, আগে এই নদী অর্ধেক ছিল। বাকি অর্ধেকটায় বসত-ভিটা, সড়ক, মসজিদ-মন্দিরসহ একাধিক জনপদ ছিল। প্রতি বছরই পদ্মার ভাঙণে নড়িয়ার ৩০০ নল (স্থানীয়ভাবে জমির হিসেব) করে জমি হারিয়ে যাচ্ছে।’

স্থানীয় বাসিন্দা ইকবাল মাঝি (বয়স ৪০) সারাবাংলাকে বলেন, ‘নড়িয়া বাজার থেকে মুলফৎগঞ্জ পর্যন্ত সড়কটি এখন পদ্মা নদীর নীচে। এই সড়কের উত্তরে কোর্টঘর বাজার, ওয়াপদা বাঁশতলা, সাহেবের চরসহ একাধিক জনপদ পদ্মার আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।’

পূর্ব নড়িয়ার স্থানীয় বাসিন্দা আনিস উদ্দিন সরদার (বয়স ৭০) সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক সপ্তাহের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে দাসপাড়া, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপাসানালয় কয়েকশ বছরের পুরানো মন্দির।’

শেহের আলীর স্থানীয় বাসিন্দা রশিদ মোল্লা (বয়স ৭৫) বলেন, ‘শেহের আলীর সড়ক থেকে কলমির চর দিয়ে জাজিরা পৌরসভার শফি গাজীর মোড় পর্যন্ত আড়াই মাইল সড়ক নদী গর্ভ চলে গেছে। নড়িয়ার প্রায় ৪০টি মসজিদসহ মানুষের বসত-ভিটা কেড়ে নিয়েছে পদ্মা। শেহের আলী গ্রামের উত্তরে প্রায় ২ মাইলজুড়ে মানুষের জনবসতি ছিল। এখন কিছুই নাই। ভাঙতে ভাঙতে শেহেরআলী সড়কও বিলিন হয়ে গেছে। যে কোনো এই জায়গাও (শেহেরআলী) চলে যাবে।’

নড়িয়া পৌরসভার মেয়র মো. শহিদুল ইসলাম বাবু সারাবাংলাকে বলেন, ‘এরই মধ্যে নড়িয়া পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের ৭০ শতাংশ এবং ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ৯০ শতাংশ পদ্মার ভাঙনের শিকার হয়ে নদী গর্ভে হারিয়ে গেছে। স্কুল, মসজিদ, দালান-কোঠাসহ প্রায় ৮০টির মতো অবকাঠামো নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। পৌরসভার বাঁশতলা বাজার এবং পূর্ব নড়িয়া বাজারও হারিয়ে যাওয়ার পথে।’

ভাঙনের ফলে ৪ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, হারিয়েছে তাদের বসত-ভিটা, প্রায় ৮ কিলোমিটার সড়ক এখন পানির নিচে চলে গেছে উল্লেখ করে উপজেলা চেয়ারম্যান ইসমাইল হক বলেন, ‘নড়িয়াতে ৩/৪ ধরেই ভাঙল চলছে। তবে এবারের ভাঙন যে কোনো সময়ের চেয়ে ভয়ঙ্কর। এই উপজেলার মুক্তারের চর ইউনিয়নের ৩টা ওয়ার্ড এবং কেদারপুর ইউনিয়নের ৪টা ওয়ার্ড এরই মধ্যে পদ্মার গর্ভে হারিয়ে গেছে। পৌরসভার বাজারের ৪০টি দোকান বানের পেটে চলে গেছে।’

সারাবাংলা/জেআইএল/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন