বিজ্ঞাপন

একজন শিক্ষকের কৈফিয়ত

October 7, 2018 | 2:25 pm

আহমদ ছফার লেখা ‘গাভী বিত্তান্ত’ পড়েছিলাম ছাত্রাবস্থায়। গাভী বিত্তান্ত পড়ে মনে হয়েছে আহমদ ছফা একটি বিষয়ে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন সেটি হল আত্মা। এই আত্মা নিয়ে পড়েছি বেশ ঝামেলায়। গত সেমিস্টারে ‘এ্যানথ্রোপলজি অব রিলিজিয়ন’ পড়াতে গিয়ে ছাত্রাবস্থার সে ঝামেলার কথা বার বার কচ্ছপের মাথার মত মনে উঁকি মেরেছে। কিন্তু খোলসের ভেতরে যে তিমিরে ছিলাম সে তিমিরেই বোধ হয় আটকে আছি।

বিজ্ঞাপন

আত্মা কি, আত্মা নিয়ে মানুষের এত চিন্তা কেন? তা দিয়ে কি হয়? আত্মা কি ফুচকার মত মানুষ বানিয়ে ভর্তার মত পুড়ে দেওয়া হয়েছে? এমন হাজারো প্রশ্ন হয়তো করা যাবে। কথা হলো মানব জীবনে এই আত্মা থেকে হোক কিংবা না থেকে হোক এক বিশাল আলোচনার জায়গা দখল করে আছে। এর একটা গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। আহমদ ছফার মতে শিক্ষার জগতে বিশ্ববিদ্যালয় তেমন এক আত্মা। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক এ আত্মাকে ধারণ করেন।

বিশ্ববিদালয়ের ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবন পার করেছি এবং এখন শিক্ষক হিসেবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি। সেদিন বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে গেলো। এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে তাই নিজেই নিজের কৈফিয়ত চাইছি। ছাত্র-কিংবা শিক্ষক হিসেবে আমি কি সে আত্মাকে ধারণ করতে পেরেছি?

আজকাল অনেককেই বলতে শুনি ব্যঙের ছাতার মত গড়ে উঠা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন কয়জন, বেশিরভাগই কোর্স নির্দেশক। আর ছাত্র? সে তো অনুমান করাই যায় যে প্রজন্ম পরীক্ষার আগের রাতে ফেইসবুক পড়ে এ প্লাস পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে তাদের তো খোলসটাই হাওয়াই মিঠাই, ধারণ করা তো অনেক পরের ব্যাপার। ঠিক সেই সময়েই আর মাত্র দুই বছর পরে আমরা পালন করবো এদেশের সবচেয়ে পুরানো বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন। আজ তাই নিজের কৈফিয়ত অমূলক মনে করছি না।

বিজ্ঞাপন

আমি কি সেই সঞ্জীবনী শক্তি ধারণ করতে পেরেছি? নাকি ছাত্রাবস্থায় সাম্যাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বলতে বলতে গলা শুকিয়েছি আর মঞ্চ থেকে নেমেই ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো’র বেনসন ফুঁকেছি?

আমি কি সেই শিক্ষকটিই হলাম কি না যে ক্লাসে পড়াবো না বলে নিয়ত করে ঢুকেছি আর ঢুকেই ছাত্রদের মাত্রাতিরিক্ত ফেইসবুক ব্যবহার না করার এক জ্বালাময়ী বক্তব্য শেষে বের হয়ে যাওয়ার আগে বলছি- আজকের ’টপিক’ তোমাদের ফেইসবুক গ্রুপে দিয়ে দেওয়া হবে। অথবা অফিসে বসে মাত্রই এক শিক্ষিকাকে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলে ক্লাসে ঢুকে ছাত্রদের বলছি- মেয়েরা তোমাদের বোন। এমনকি হচ্ছে কখনো ছাত্রকে পক্ষপাতমূলক বেশি নম্বর দিচ্ছি, যার বাবা সরকারি বড় কর্মকর্তার কাছ থেকে বড় অংকের ’প্রজেক্ট’ হাতিয়ে নেয়া যাবে?

আবার কখনো হয়তো মনে হচ্ছে কি আমি নিতান্ত গোবেচারা? আমি এসবের মধ্যে নেই। আমি ক্লাসে যাই, পড়াই বাড়ি ফিরে আসি। আমি কি একদমই ভাবিনা সেই প্রজেক্টধারী শিক্ষক কখনো যদি প্রশ্ন করেন- আমি তো এত এত শিক্ষার্থীকে চাকরীর সুযোগ করে দিয়েছি আপনিতো ক্লাস নিয়েই ক্ষান্ত। আবার এমনটাও কি হয় যে- আমিতো ব্যাপক গবেষণায় ব্যস্ত আমারতো ক্লাস মিস হতেই পারে। এমনটা কি হচ্ছে যে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত থাকার কারণে সকালে ক্লাস নেয়ার কথা বলে বিকালে এসে বললাম- আজ সারাদিনই নানান মিটিং ছিল।

বিজ্ঞাপন

এজন্যই জানতে হবে যে আমি কি বিশ্বিবিদ্যালয় নামে যে আত্মা আছে তাকে ধারণ করি নাকি নিতান্ত একজন চাকুরে যে কখনোই হৃদয়ের গভীরে এর টান অনুভব করি না, যেমন টান অনুভব করে না একটি যন্ত্র। দিনান্তে ভাবি-আহা একটু দম পেলাম। বসে বসে ভাবি কবে ছুটি হবে? এই বুঝি দায়িত্ব শেষ হল। অথচ এমনটিই কি হওয়ার কথা ছিল?

যদিও আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে অনেক কিছু উপহার দিয়েছে তাও কেন ভয় হয়- বলছি। এই যে শিক্ষক দিবস পালিত হলো এর অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। হতে পারে এমন সময়ে আমরা উপস্থিত হয়েছি পরিবেশ বিপর্যয়ের মত চরম শিক্ষক বিপর্যয় হয়েছে তাই দিবস পালন করে তাকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম চলছে।
একটা গল্প বলেই শেষ করবো। এ বছরের গোড়ার দিকে আমি ও আমার দুই সহকর্মীসহ বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিয়ে মাঠপর্যায়ে গবেষণার জন্য নেত্রকোনার সুসং, দূর্গাপুরে যাই। ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা। আমাদের মাঠকর্মটিও একবারেই সীমান্ত ঘেঁষে হবে। সাধারণত এ এলাকায় লোকজনের বসতি কম চোখে পড়ল। যথারীতি একদিন সকালে গারো বসতি খুঁজতে খুঁজতে একবারে সীমান্তে গিয়ে হাজির হই। আমি এক পর্যায়ে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য একটা জায়গা খুঁজতে থাকি, বিশেষত দোকান হলে খুব ভালো জমতো, চা ও খাওয়া যেত। খুব ঘনবসতি না হওয়ায় দোকানপাটও খুব কম, বেঁচাকেনা নেই বললেই চলে। তবুও অবশেষে গারো মেয়েদের দ্বারাই পরিচালিত একটি দোকান খুঁজে পেলাম। একজন মাঝ বয়েসী গারো মহিলা ভেতরে বসে থেকেই আমার মত একজন শহুরে ক্রেতা দেখে মনে হল ভিমরি খেলেন। দোকানের সামনে লুঙ্গি পরিহিত একজন লোক বসেছিলেন। প্রথম দেখায় বোঝার উপায় নেই বাঙালি নাকি গারো। চকচেকে কালো চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। ছাত্রদের এবং আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন- আমরা কোথা থেকে এসেছি। আমরা আমাদের পরিচয় দিতেই লোকটি শশব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দৌড়ে গিয়ে দোকানের ভেতর থেকে একটি বসার জন্য মোড়া নিয়ে আসলেন। আমাকে বসতে বলে স্থানীয় ভাষায় দোকনীকে কি যেন বললেন। বুঝতে পারলাম খুব খুশি তিনি। কিন্তু কেন খুশি তা বুঝলাম না। এরই মধ্যে তার সাইকেলের পেছনে আচারের একটি ব্যাগ থেকে দুই-তিন প্যাকেট আচার দিয়ে উৎসাহ নিয়ে নিজেই বলতে শুরু করলেন তার এক ছেলে, এক মেয়ে, দু’জনেই আমারই বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে পড়ে। আমাকে আচার খাওয়ার কথা বলতে বলতে লোকটি কেঁদে ফেললেন। বললেন- স্যার আপনি খেলে আমার আত্মা শান্তি পাবে। জানি স্যার, এই আচার ভাল না, মানসম্মত না, শহরের মত না। কিন্তু কি করব স্যার এই আচার দোকানে দোকানে সাইকেলে করে দিয়ে আসি। ক’টা দোকানইবা আছে এখানে? এই ব্যাগে যা আছে তাই শেষ হয় না। এই আচার বিক্রির টাকা জমিয়েই ছেলে-মেয়েকে মানুষ করছি স্যার। আপনি আমার ছেলে-মেয়ের শিক্ষক। আপনাকে পেয়ে আমার কি যে ভালো লাগছে।

এ ভালো লাগার কথা হয়তো না বললেও তার চোখমুখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম। সাথে সাথে মনটাও ডুকরে কেঁদে উঠছিল ভেতরে ভেতরে। এমন হাজার ফোটা চোখের জলেই তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে। হাজারো মা-বাবা দিন রাত পরিশ্রম করে ছেলে-মেয়েদের বিশ্ববিদালয়ে পাঠান। পা-ফাটা রক্তাক্ত কৃষক সরকারে ঘরে টাকা জমা দিয়ে কোষাগার ভারী করেন যা দিয়ে আমার আরাম আয়েশ হয়। যদি নিজের মধ্যে আত্মাকে ধারণ না করি তবে কেমন করে এইসব সাদা মনের মানুষদের আত্মা শান্তি পাবে?

মাহমুদুল হক
প্রভাষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্বাবদ্যালয়
anthromahmud@gmail.com

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এমএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন