বিজ্ঞাপন

পুলিশি পোশাকে’ই এই ‘অডাসিটি’!

October 25, 2018 | 8:28 pm

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: মধ্যরাতে সিএনজি চালিত অটোরিকশার গতিরোধ করে কয়েকজন পুলিশ সদস্যের হয়রানি করার ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, মধ্যরাতে বাইরে থাকার কারণেই ওই নারীকে বলা হয়েছে ‘খারাপ মেয়ে’। বাজে ইঙ্গিত দিয়ে করা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ায় তাকে বলা হয়েছে ‘বেয়াদব’। তার পারিবারিক শিক্ষা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যদের এরকম আচরণে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

এর আগে, এ বছরের মার্চ মাসেও পুলিশের হেনস্থা হওয়ার কথা ফেসবুকে জানিয়েছিলেন সফটওয়্যার প্রকৌশলী তানিয়া আলম। তিনি জানিয়েছিলেন, স্কুটিতে করে সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দিতে গেলে সেখানে সাইফুর নামের এক ট্রাফিক পুলিশ অন্য গাড়িচালকদের তার স্কুটিতে ধাক্কা দেওয়ার জন্য উসকে দিচ্ছিলেন!

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিম্নপদস্থ এসব সদস্যদের হাতে এই দুই নারীর মতোই আরও অনেক নারীই বিভিন্ন সময় হেনস্থার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন হেনস্থা আর হয়রানি থেকে বাদ যান না পুরুষরাও। তবে পুরুষের বেলায় হেনস্থার ধরন ভিন্ন হলেও নারীদের ক্ষেত্রে অবমাননাকর, আপত্তিকর ও অশ্লীল শব্দের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চশিক্ষিত এবং দেশের বাইরে থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসা পুলিশ কর্মকর্তারা অনেক ক্ষেত্রেই গর্বের কারণ। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের নিম্নপদস্থ কিছু পুলিশ সদস্যের ভূমিকা গোটা পুলিশ বাহিনীকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে, গ্রহণযোগ্যতা হারায় পুলিশ। আর এ ক্ষেত্রে তাদের সাহস জোগায় তাদের গায়ে থাকা ‘পুলিশের পোশাক’। ‘পুলিশি পেশাকে’র কারণেই তারা ‘অডাসিটি’ দেখাতে সাহস পায়, ‘পাওয়ার প্র্যাকটিসে’র মানসিকতা তৈরি করে। যদিও এই পোশাকের তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি করার কথা ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া নারী যাত্রীর হেনস্থা হওয়ার ভিডিওর জের ধরে এরই মধ্যে একজন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ও ডেমরা লাইনের তিন কনস্টেবলকে বরখাস্ত করেছে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত অব্যাহত আছে বলেও জানিয়েছেন মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন।

পুলিশের এমন আচরণকে বিষয়টা কেবল কেবল পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে একে পারিবারিক শিক্ষার অভাব এবং পারিপার্শ্বিক আবহের প্রতিফলন বলে মনে করছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন।

বিজ্ঞাপন

তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ভিডিওতে যেসব শব্দ ওই নারীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি রূঢ় হতে পারতেন, ব্যাগ চেক করতে পারতেন; সন্দেহ হলে আইন মেনেই নারী পুলিশ দিয়ে প্রয়োজনে থানায় নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি যা করেছেন, তা করে তার ‘কোড অব কন্ডাক্টে’র পরিপন্থী বলেই আমরা মনে করি। এ ধরনের কাজ তখনই কেউ করে, যখন সে মনে করে যে এর জন্য তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে না। তাই সব পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের জন্যই এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। পুলিশ প্রশিক্ষণেও এসব অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়গুলোতে ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

পুলিশের ইউনিফর্ম, সাংবাদিকের কলম বা হাতের বুম যখন থাকে, তখন ‘এক্স্ট্রা পাওয়ার’ তৈরি হয়— এ ধরনের সাইকোলজিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ট রয়েছে জানিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এই শিক্ষক বলেন, ‘ইউনিফর্মের বড় একটি ভূমিকা রয়েছে। তারা যখন এ পোশাকে থাকে, হাতে যখন অস্ত্র থাকে, ব্যবহার করার মতো ক্ষমতা থাকে, তখন সে সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগায়। সে ক্ষেত্রে তার মানসিকতা যদি খারাপ থাকে, তখন সে ক্ষমতা খারাপভাবে ব্যবহার করে। সেদিন রাতের বেলা সেটাই ঘটেছে।’

ডা. হেলাল বলেন, পরিবারের শিক্ষার অভাব তো বটেই, ‘পুলিশি পোশাক’ও তাকে এই কাণ্ড ঘটাতে বাড়তি প্রণোদনা দিয়েছে। এই ব্যক্তির মানসিকতা একই রকম থাকত অন্য পেশাতে গেলেও। কিন্তু ‘পুলিশি পোশাক’ তাকে এই ‘অডাসিটি’ দিয়েছে।

একই ধরনের কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সেলিম।

বিজ্ঞাপন

তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশসহ কয়েকটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ দেখার সুযোগ হয়েছে। খুবই দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখেছি, সেখানে তাদেরকে শারীরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু একজন পুলিশ হিসেবে যাকে সেবা দেব, তার সঙ্গে আচরণ কেমন হবে— এ ধরনের প্রশিক্ষণ বিশেষ করে নন-কমিশনড স্তরে একেবারেই নেই।’

তিনি বলেন, ওই রাতে পুলিশ সদস্যরা অত্যন্ত ‘স্টিগমাটাইজড’ ও ‘জাজমেন্টাল’ শব্দ ব্যবহার করেছে। তাদের কথা থেকে এটা স্পষ্ট— তারা ধরেই নিয়েছে, রাত আড়াইটার সময় কোনো মেয়ে রাস্তায় থাকলেই সে ‘খারাপ মেয়ে’। আর সেটা বলার সাহস পেয়েছে তাদের গায়ে ইউনিফর্ম থাকার কারণে। তারা জানে, ইচ্ছা করলেই ওই নারীকে থানায় নিয়ে যাওয়া যেত। হয়ত আরও ভয়ঙ্কর কিছুও হতে পারত। অথচ এখন কাজের ধরন বদলেছে। টেলিযোগাযোগ, চিকিৎসা, সাংবাদিকতাসহ অনেক পেশাতেই এখন ২৪ ঘণ্টার কাজ। কাজের প্রয়োজনে কিংবা কোনো প্রয়োজন ছাড়াও যদি মেয়েরা রাতে রাস্তায় বের হন, তাতে পুলিশ তো বাধা দিতে পারে না।

একদম প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই এই পরিবর্তন না আনলে হঠাৎ করে পরিবর্তন আনা যাবে না বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানের এই শিক্ষক। তাই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় জেন্ডার এক্সপার্টদের যুক্ত করতে হবে বলে মত দেন তিনি।

পুলিশের সঙ্গে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান। তিনি বলেন, ‘আমিসহ এবং আমি ছাড়া থানায় এক তৃণমূল পর্যায়ের নারীর যে অভিজ্ঞতা আমি জানি, সেটাও ভয়ঙ্কর। আমিসহ যখন গিয়েছে, তখন তার সঙ্গে একরকম ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে, ওই নারী একা থানায় গিয়ে পেয়েছে অন্যরকম ব্যবহার। ওই নারীর সঙ্গেও ওই সময় অশ্লীল ও আপত্তিজনক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।’

রাশেদা রওনক খান বলেন, একজন পুরুষ যদি ওই সময় সিএনজিতে থাকতেন, তাহলে তাকে হয়তো অন্যভাবে হেনস্তা করা হতো। কিন্তু যেসব আপত্তিকর শব্দ বলা হয়েছে, সেগুলো বলা হতো না। পুরুষের বেলায় হয়তো ভিন্ন ভাষা ব্যবহার করা হয়। তবে হেনস্থা ঠিকই করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই শুধু নয়, আমাদের দেশে কোনো পেশাতেই প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতার সঙ্গে, বিশেষ করে নারীদের সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সে বিষয়টি শেখানো হয় না বলে উল্লেখ করেন নৃবিজ্ঞানের এই শিক্ষক।

তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীকে পুরুষের সমান করে দেখার কোনো চর্চা নেই। ছোটবেলা থেকে সবাই সেই মানসিকতা নিয়েই বড় হচ্ছে। পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণেও নারী-পুরুষ সমঅধিকারের বিষয়টি নেই। যে কারণে নারী আসামিদের সঙ্গে পুলিশের দুর্ব্যবহার, এমনকি ধর্ষণের শিকার নারীদেরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা আদালতেও অপদস্থ হতে হয়। ভিডিওতে যেসব শব্দ আমরা শুনেছি, সেগুলো খুবই অপ্রাসঙ্গিক, আপত্তিজনক ও চরম অবমাননাকর।’

 এগুলো আসলে ওই শিক্ষারই ফসল। এ কারণে নারী অধিকার নিশ্চিত করতে পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণে এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

কেবল নারী নয়, পুরুষকেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে। বিশেষ করে রাতে বাইরে থাকলেই যে তাকে হেনস্থা করতে হবে— এই মানসিকতা থেকে বের হতে হবে। কেউ রাতের বেলা বের হলেই যে সে কোনো খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িত হবে— এই মনস্তত্ব থেকে বের হতে হবে। এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য খুব জরুরি।

পুলিশের পোশাক আমাদের দেশে ‘ক্ষমতার প্রতীক’ হিসেবে বিবেচিত হলেও এই পোশাক দায়িত্ববোধের জায়গা হওয়া উচিত বলে মনে করেন রাশেদা রওনক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড ক্রিমিনাল জাস্টিস বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান সারাবাংলাকে বলেন, পুরো সমাজের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ যেটা রয়েছে, ভাইরাল হওয়া ভিডিও তারই বহিঃপ্রকাশ। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা সবসময়েই নারীকে অধস্তন হিসেবে দেখে। এর সঙ্গে রয়েছে ‘পাওয়ার রিলেশন’ এবং পুলিশের রিফর্ম না হওয়া, জবাবদিহিতা না থাকা এবং পুলিশের নিম্নপদস্থদের মধ্যে প্রয়োজনীয় মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ না থাকা। ফলে তারা সুযোগ পেলেই বলপ্রয়োগ করছে।

একইসঙ্গে অধ্যাপক জিয়া রহমান আরও বলেন, পোশাক তার হাতিয়ার, এই পোশাকে না থাকলে কিন্তু সে এই সাহস দেখাতে পারত না। গায়ে পুলিশের পোশাকটা যদি না থাকত, তাহলে সে ক্ষমতাহীন থাকত। পোশাকের কারণেই সে যা ইচ্ছে বলতে পেরেছে, থানায় নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিতে পেরেছে। পরে তাদের সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু সাময়িক বহিষ্কারের এই কালচারটাও সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া দরকার। কারণ, শাস্তির বিধান না করা গেলে আবারও বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকেই যাবে। এসব ঘটনাতে দৃস্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে সমাজেও কোনো ‘ব্রেক থ্রু’ হয় না। এটা না করা গেলে অনেক সময় লাগবে এখান থেকে বের হতে।

সারাবাংলা/জেএ/টিআর

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন