বিজ্ঞাপন

‘স্বাস্থ্যখাতে ইফেকটিভ কিছু ইশতেহারে নেই’

December 19, 2018 | 7:33 am

।। জাকিয়া আহমেদ,  স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা:একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইশতেহার ঘোষণা করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। এসব ইশতেহার বিশ্লেষণ করে চিকিৎসক সমাজ  এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘স্বাস্থ্যখাতে ইফেকটিভ কিছু ইশতেহারে নেই’।

তারা বলছেন, ১ বছরের নিচে ও ৬৫ বছরের উপরে সব নাগরিক বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পাবেন- এই অঙ্গীকার করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিএনপি তাদের ইশতেহারে বলেছে, জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা হবে। চিকিৎসক ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে চিকিৎসা শিক্ষার মানোন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে জাতীয় অ্যাকিডিটেশন কাউন্সিল গঠন করা হবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তাদের ইশতেহারে উল্লেখ করেছে, দেশের সব জেলায় ২০ শয্যার সিসিইউ-আইসিইউ ও ১০ শয্যার এনআইসিইউ স্থাপন করা হবে।

আরও বলছে তারা, দেশের বড় ও জেলা শহরে রেফারেল ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। মেট্রোপলিটন শহরে বাধ্যতামূলক সব নাগরিকের সঙ্গে জেনারেল প্র্যাকটিশনার পদ্ধতি চালু করা হবে। জেনারেল প্র্যাকটিশনার রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা ও পরামর্শ দেবেন এবং প্রয়োজন মাফিক রোগীকে জেনারেল ও বিশেষায়িত হাসপাতালে রেফার করবেন।

বিজ্ঞাপন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণাকালে আরও বলেছেন, সকল বিভাগীয় শহরে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হার্ট, ক্যানসার ও কিডনি রোগের চিকিৎসা চালু করা হবে। গ্রামাঞ্চলের চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানো, সেবার মান বাড়ানো এবং চিকিৎসক ও সেবিকাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে।

স্বাস্থ্যখাতের বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো দলের ইশতেহারে বাস্তবে স্বাস্থ্যখাতে ইফেকটিভ কিছু নেই। এই খাত নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনা খুব ‘সুপার ফিসিয়াল’ বা অগভীর। যারাই ক্ষমতায় আসুক, তাদেরকে স্বাস্থ্যখাত ঢেলে সাজাতে অনুরোধ করব।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের ইপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান ও অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের দেওয়া ইশতেহারে উল্লেখিত ২১টি জেলায় ক্যান্সার কেমোথেরাপি সেন্টার এবং রেফারেল সিস্টেম উল্লেখযোগ্য। এতে করে নামকরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সিরিয়াল পেতে রোগীদের যে ভোগান্তি পোহাতে হয়, সেটা কমে আসবে।’

বিজ্ঞাপন

একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে দেওয়া ক্যান্সার সেন্টারও গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে ডা. রাসকিন বলেন, ‘যদি দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে ক্যান্সার হাসপাতাল করা যায়, রোগীদের সেবা পৌঁছে দেওয়া সহজ হবে। তবে শুধু ক্যান্সার হাসপাতাল নয়, সেন্টারগুলো হতে হবে এমন যেখানে প্রিভেনশন-আর্লি ডিটেকশন-স্ক্রিনিং এবং ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা থাকবে।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক ডা. শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে স্বাস্থ্যখাতের অংশটুকু রচনা করার দায়িত্ব সম্ভবত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে দেওয়া হয়েছিল। অদ্ভুত সব দফা ওখানে দেখা যাচ্ছে- যার সঙ্গে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের কোনো সম্পর্ক নেই।

এর মধ্যে সবচেয়ে নিরীহ একটি দফার কথাই বলি- ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় গেলে সরকারি মেডিকেল কলেজের টিউশন এবং হোস্টেলের ফি বাড়ানো হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের টিউশন ফি বাড়ানোর মতো অদ্ভুত দফা কেউ কারও ইশতেহারে কোন যুক্তিতে যুক্ত করতে পারে?’

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি ডা. রশীদ-ই-মাহবুব সারাবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বলেছে কোয়ালিটি সার্ভিস দেবে, বিএনপি বলছে জিডিপির ৫ শতাংশ দেবে- এগুলো কথার কথা। বাস্তবে হেলথ সেক্টরে ইফেকটিভ কিছু করার অঙ্গীকার কারও ইশতেহারেই দেখা যাচ্ছে না। যারাই ক্ষমতায় আসুক- তাদেরকে অনুরোধ করব, তারা যেন স্বাস্থ্যখাত ঢেলে সাজান। রিফর্ম বলতে সেখানে বাজেট, জবাবদিহিতা, কোয়ালিটি, রোগীদের জন্য সহজগম্যতা- সব সার্ভিস নিয়েই একটি কমিশনের অধীনে কাজ হবে।’

বিজ্ঞাপন

একটি জাতীয় স্বাস্থ্য রিফর্ম কমিশন করে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে যেন আধুনিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়- এটাই চাওয়া বলেন ডা. রশীদ-ই-মাহবুব।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘তৃণমূলের চিকিৎসা শক্তিশালী করতে হবে। আওয়ামী লীগ বলেছে, কমিউনিটি ক্লিনিক আধুনিকায়ন করবে তারা। এটা আসলেই প্রয়োজন। এর সঙ্গে দরকার মনিটরিং। কারণ, যারা শহরে বাস করেন তারা অনেক চিকিৎসক পান, হাসপাতাল পান। কিন্তু তৃণমূলের মানুষ সেটা পায় না। তাই তৃণমূলের জায়গায় সবাইকে গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের ঘাটতি এবং দক্ষ জনবল নিয়ে ভাবতে হবে।

দেশের বেসরকারি খাতকে আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, ‘বেসরকারি খাতে চাকরি বিধি, নীতিমালা সে রকম কিছু নেই। তাদের নিয়মের মধ্যে আনা উচিৎ। তাই এখানে একটি নীতিমালা খুব দরকার। তাদের যুক্তিযুক্ত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা উচিৎ বলে আমি মনে করি- বলেন অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান।’

প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও সমাজকর্মী ডা. লেলিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনা খুব ‘‘সুপার ফিসিয়াল’’ বা অগভীর ভাবনা। রাজনৈতিক দলগুলো স্বাস্থ্য বলতে কেবল চিকিৎসাকে বুঝিয়ে থাকে, কিন্তু রোগের চিকিৎসা স্বাস্থ্য সেবার একটি অংশ মাত্র। রোগ প্রতিরোধ এবং রোগ হয়ে যাওয়ার পরে সেই রোগী কেমন জীবন যাপন করবে, তার পুনর্বাসন এবং রোগ মুক্ত জীবন যাপন, যাকে বলা হয় প্রমোটিভ হেলথ- এই বিষয়গুলো সর্ম্পকে রাজনীতিক এবং দলগুলো ভাবতে অভ্যস্ত নয়।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) নতুনভাবে স্বাস্থ্যকে দেখছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কৃষিখাতের সঙ্গে মানুষের স্বাস্থ্যের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। শাক-সবজি, ফসল, গবাদি পশু, মুরগি- এসবের সঙ্গে মানুষের স্বাস্থ্য যুক্ত। যেমন শাক-সবজিতে যদি অতিরিক্ত কীটনাশক দেওয়া হয়, সেটা খাবারের সঙ্গে আমাদের শরীরে যায়। আবার ওই কীটনাশক পানির মাধ্যমে মাটিতে মিশে আমাদের প্রভাবিত করে। পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ার পাশাপাশি জলজ প্রাণীদের জীবনকেও প্রভাবিত করে- যার একটি অংশ মানুষ খাবার হিসেবে গ্রহণ করে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দিনাজপুরের লিচু খেয়ে ১২ শিশুর মৃত্যু। মুরগি বা গবাদি পশুকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হয়। এর প্রভাব মানুষের স্বাস্থ্যে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলছে, মানুষের স্বাস্থ্য ও প্রাণীর স্বাস্থ্য এবং কৃষিখাতে যা যা রয়েছে সব একই সূত্রে গাঁথা। ফলে কোনও একটিকে গুরুত্ব দিয়ে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্ভব নয়। তারা পরামর্শ দিচ্ছে, তিনটিকে এক সুতায় গেঁথে ‘‘ওয়ান হেলথ’’ নীতিতে স্বাস্থ্য ভাবনাকে ঢেলে সাজাতে। আমরা প্রত্যাশা করব, আগামী দিনে যে সরকার আসবে, তারা তাদের স্বাস্থ্য বিষয়ক ভাবনাকে অগভীর পর্যায় থেকে বৃহত্তর পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে এই তিনটিকে এক করে ওয়ান হেলথ বা এক স্বাস্থ্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবে।’

‘দেশে এক সময় সংক্রামক ব্যাধি ৬০ শতাংশ আর অসংক্রামক ব্যাধি ছিল ৪০ শতাংশ। বর্তমানে সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু অসংক্রামক ব্যাধি হচ্ছে ৬৭ শতাংশ। ফলে দেশের স্বাস্থ্য সেবার মৌলিক ভাবনা হওয়া উচিৎ অসংক্রামক ব্যাধিকে কেন্দ্র করে। এই জায়গাতে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইশতেহারে ততোটা গুরুত্ব দেয়নি’, বলেন ডা. লেলিন চৌধুরী।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মতো আয়ের দেশে ১ বছরের কম অথবা ৬৫ বছরের বেশি মানুষকে বিনা পয়সায় স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্ব দেওয়ার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হতদরিদ্রদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। দেশের প্রায় ১১ ভাগ মানুষ এখনও হতদরিদ্র। তাদের যদি হেলথ কার্ড দেওয়া যায়- যে কার্ড দেখিয়ে সরকারি-বেসরকারি সব জায়গা থেকে তারা স্বাস্থ্যসেবা এবং ওষুধ পাবে।

সারাবাংলা/জেএ/এটি/পিএ

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন