বিজ্ঞাপন

‘রাষ্ট্রবিরোধী’ উসকানিমূলক আবৃত্তি পরিবেশন নিয়ে বিতর্কে বোধন

January 24, 2019 | 10:23 pm

।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম ব্যুরো: মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে আদর্শিক অবস্থান প্রশ্নে বিভক্ত হতে চলেছে চট্টগ্রামের প্রথম আবৃত্তি সংগঠন ‘বোধন আবৃত্তি পরিষদ’। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক একটি পাণ্ডুলিপি নিয়ে একটি বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশনের পর প্রগতিশীল এই সংগঠনটির সংগঠকেরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।

একপক্ষের দাবি, সংগঠনের ভেতরে জামায়াত-শিবিরসহ মৌলবাদে বিশ্বাসী অনুপ্রবেশকারীদের সরাতে হবে। অপরপক্ষ বিষয়টি সমঝোতার মাধ্যমে মীমাংসায় যেতে আগ্রহী বলে অভিযোগ উঠেছে। মতদ্বৈততা থেকে ‘বোধন আবৃত্তি স্কুলের’ ২৫ বছরের ইতিহাসে এবার প্রথম আলাদাভাবে আবৃত্তি শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি নবীন বরণের আয়োজন করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠাতা রণজিৎ রক্ষিতের মৃত্যুর মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে জন্ম নেওয়া বোধনের মধ্যে এই দ্বিধাবিভক্তি এসেছে। চট্টগ্রামের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বোধনের এই বিভক্তি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে বোধনের ‘রাষ্ট্রবিরোধী উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড’ নিয়ে তদন্তে নেমেছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার পলাশ কান্তি নাথ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সম্প্রতি বোধন যে সম্মিলিত আবৃত্তি পরিবেশন করেছে, এর পাণ্ডুলিপিতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক আপত্তিকর বক্তব্য আছে। ফেসবুকে জামায়াত-শিবিরের বাঁশের কেল্লা পেইজে যে ধরনের বক্তব্য দেওয়া হয়, একই ধরনের কাথাবার্তা আছে এই পাণ্ডুলিপিতে। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনের আড়ালে সরকার বা রাষ্ট্রবিরোধী কোন শক্তি আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে কি-না সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি।’

বিজয় দিবসের আগের দিন গত ১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর চেরাগির মোড়ে একটি অনুষ্ঠানে সম্মিলিতভাবে এই আবৃত্তি পরিবেশ করেন বোধনের শিল্পীরা। ‘বিতর্কিত’ ওই পাণ্ডুলিপির একটি অনুলিপি সারাবাংলা’র হাতে এসেছে।

পাণ্ডুলিপির বিভিন্ন অংশকে চরম আপত্তিকর ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক হিসেবে চিহ্নিত করেছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। একইসঙ্গে তুমুল আপত্তি আছে বোধনের সংগঠকদের একাংশের মধ্যে।

বিজ্ঞাপন

সূত্র মতে, তদন্তে নেমে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট পাণ্ডুলিপির অনুলিপি সংগ্রহ করে বোধন আবৃত্তি পরিষদের সভাপতি সুজিত রায়সহ পাঁচজন জ্যেষ্ঠ্য সংগঠককে কার্যালয়ে ডেকে নেন। এই বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান, আবু সাঈদ রিয়াদ নামে একজন আবৃত্তিকর্মী এই পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছেন। তদন্তে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট জানতে পেরেছে, রিয়াদ একসময়ের জামায়াত নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী। ছাত্রশিবির কিংবা হিযবুত তাহরীরের মতো উগ্রপন্থী সংগঠনের সঙ্গে রিয়াদের সম্পৃক্ততা আছে কি-না সেটি এখন খতিয়ে দেখছে জঙ্গি মোকাবিলায় গড়ে তোলা পুলিশের এই বিশেষায়িত ইউনিট।

একইসঙ্গে বিতর্কিত ওই পাণ্ডুলিপি দেখার পর বোধনের জ্যেষ্ঠ্য সংগঠকরা সেটির পরিবেশনা বন্ধে কোনো উদ্যোগ নিয়েছিলেন কি-না কিংবা রিয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি-না, তাকে পৃষ্ঠপোষকতা কারা দিচ্ছেন, একই মানসিকতার আর কেউ বোধনসহ অন্যান্য প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোতে আছে কি-না, সেটা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

বোধনের কয়েকজন সংগঠকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্মিলিত এই আবৃত্তি পরিবেশনের সময়ই বেশ কয়েকজন সংগঠক এর প্রতিবাদ করেন। পরবর্তীতে সংগঠকদের একাংশ রিয়াদকে বহিষ্কারের দাবি করেন পরিষদের নির্বাহী কমিটির কাছে। তাদের বক্তব্য- বিজয় দিবস এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ১৫ দিন আগে এই ধরনের স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে তৈরি করা পাণ্ডুলিপি পরিবেশনের মধ্য দিয়ে উদার প্রগতিশীল ধারার সাংস্কৃতিক সংগঠন বোধনকে বিতর্কিত করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এরপর একমাস পেরিয়ে গেলেও বোধনের নির্বাহী কমিটি বিতর্কিত পাণ্ডুলিপি তৈরির দায়ে রিয়াদকে বহিষ্কারের কোন উদ্যোগ নেয়নি বলে তারা জানিয়েছেন।

জানতে চাইলে বোধন আবৃত্তি পরিষদের সভাপতি সুজিত রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্ক্রিপ্ট যেটা তৈরি করা হয়েছিল, সেটা মাত্র দুইদিন রিহার্সেলের পর মঞ্চে পরিবেশ করা হয়েছিল। রিহার্সেলে কারও বিষয়টা চোখে পড়েনি। যে পাণ্ডুলিপিটা তৈরি করেছে, ছেলেটাকে (রিয়াদ) ডেকে আমরা মৌখিকভাবে বলে দিয়েছি- সে যেন আর সংগঠনের কার্যালয়ে না আসে। আগামী রোববার অথবা সোমবার সভা ডেকে তাকে বহিস্কারের উদ্যোগ নেব। বিষয়টা আমরা গোয়েন্দা সংস্থাকেও জানিয়েছি।’

বিতর্কিত এই পাণ্ডুলিপির বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নিয়েছিলেন তাদের একজন, বোধন আবৃত্তি পরিষদের স্থায়ী কমিটির সদস্য সোহেল আনোয়ার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যারা কমিটিতে আছি আমরা একাংশ মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, ছেলেটাকে (রিয়াদ) তাৎক্ষণিকভাবে বহিস্কার করতে হবে। কিন্তু আমাদের মধ্যে কেউ কেউ তাকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন।’

‘আমাদের বক্তব্য ছিল, একটা জাতীয় নির্বাচনের আগে এই ধরনের বিতর্কিত পাণ্ডুলিপি তৈরি করাটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এটা সুগভীর চক্রান্ত হতে পারে। এর সঙ্গে আরও কেউ জড়িত থাকতে পারে। কারণ বিগত ১০-১২ বছরে জামায়াত-শিবির কিংবা মৌলবাদী চেতনায় বিশ্বাসী অনেকে বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠনে ঢুকে গেছে নিজেদের আড়াল করার জন্য। আমরা মনে করি, বোধন এটার ভিকটিম। কিন্তু দুঃখজনকভাবে নীতিনির্ধারকদের অনেকে এই ধরনের কর্মীদের আড়াল করার চেষ্টা করছেন।’ বলেন সোহেল আনোয়ার

এদিকে একমাসের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিতর্ক, পাল্টাপাল্টির পর বোধনের সংগঠক-কর্মীদের মধ্যে বিভক্তি এবার প্রকাশ্যে আসছে।

সভাপতি সুজিত রায়দের নেতৃত্বাধীন অংশটি শুক্রবার (২৫ জানুয়ারি) থেকে নতুন আবৃত্তি শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু করতে যাচ্ছেন। এদিন বোধন আবৃত্তি স্কুলের পক্ষ থেকে ‘নবীন বরণের’ আয়োজন করা হয়েছে নগরীর মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলে।

তবে ‘বিতর্কিত’ পাণ্ডুলিপির রচয়িতাকে বহিস্কারের দাবিতে সরব অংশটি যুক্ত হচ্ছেন না তাদের সঙ্গে। তারা ১ ফেব্রুয়ারি ‘বোধন আবৃত্তি স্কুলের’ পক্ষ থেকে পাল্টা নবীনবরণ ও আবৃত্তি ক্লাসের আয়োজন করেছেন। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক মিলনায়তনে এই নবীনবরণের আয়োজন করা হয়েছে।

জানতে চাইলে সুজিত রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আমাদের কারও কারও মধ্যে ক্ষোভ আছে। এটাকে আমরা বিভক্তি মনে করি না। এখন সংগঠন বড় হয়েছে। নানা ধরনের মতামত থাকতে পারে। থাকাটাই স্বাভাবিক। কারও কারও মধ্যে মনোমালিন্য থাকতে পারে। আমরা বসে এটা সমাধান করে ফেলব। কারণ আমরা নিজেরাই তো এই পাণ্ডুলিপিকে সমর্থন করছি না। সংগঠনের ভেতরে এই ধরনের আরও কেউ আছে কি-না, সেটা তো আমরা নিজেরাই খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছি।’

সোহেল আনোয়ার সারাবাংলাকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে মধ্যপন্থা বা নিরপেক্ষতার কোনো সুযোগ নেই। আমরা মনে করি, যারা এই বিতর্কিত পাণ্ডুলিপির বিরুদ্ধে, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের পক্ষে আছেন, তারাই আসল বোধন। তবে এরপরও আমরা আশা করি, বোধনের মধ্যে এই ধনের অনুপ্রবেশ যাদের ঘটেছে, তাদের বিরুদ্ধে নীতিনির্ধারকরা শক্ত অবস্থান নেবেন এবং তাদের সংগঠন থেকে বের করে দেবেন।’

স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে ১৯৮৭ সালের ৯ জানুয়ারি তৎকালীন বাম প্রগতিশীল ছাত্র ও সংস্কৃতিকর্মীরা গড়ে তোলেন সম্মিলিত আবৃত্তি সংগঠন ‘বোধন আবৃত্তি পরিষদ’। এসময় এরশাদ বিরোধী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে সরকারের রোষানলেও পড়তে হয়েছিল সংগঠনটির নেতাকর্মীদের। চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ্য সংস্কৃতিকর্মীরা জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মুখে বোধন কর্মীদের আবৃত্তি পরিবেশন করেই মঞ্চ থেকে পালিয়ে যেতে হত।

১৯৯৩ সালের ১০ অক্টোবর দেশের প্রথম আবৃত্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘বোধন আবৃত্তি স্কুল’ যাত্রা করে। বোধনের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম রণজিৎ রক্ষিত আমৃত্যু এর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। গত বছরের (২০১৮) ৩০ অক্টোবর রণজিৎ রক্ষিতের মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বে আছেন আবৃত্তিশিল্পী পঞ্চানন বিশ্বাস।

সারাবাংলা/আরডি/একে

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন