বিজ্ঞাপন

জমি বনের, বন্দোবস্ত দেয় ভূমি অফিস!

February 15, 2019 | 4:45 pm

।। সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট।।

বিজ্ঞাপন

ভাঙা-গড়ার মধ্যেই চলছে উপকূলীয় অঞ্চল। দিন দিন বাড়ছে বাস্তুহারার সংখ্যা। আশ্রয়ের খোঁজে দ্বারে-দ্বারে ঘুরছে ভিটিমাটি হারা হাজারো মানুষ। অথচ নতুন জেগে ওঠা চরাঞ্চলে তাদের আশ্রয় দেওয়ার কথা থাকলেও পুনর্বাসনের নামে ভূমি চলে যাচ্ছে বিত্তবানদের দখলে। এমন চিত্র নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে। সম্প্রতি এলাকাটি ঘুরে এসেছেন সারাবাংলার স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সাদ্দাম হোসাইন। এ নিয়ে আজ থাকছে পাঁচ পর্বে তৈরি ধারাবাহিক প্রতিবেদনটির দ্বিতীয় পর্ব।

নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে একের পর এক খাসজমি নামে-বেনামে প্রভাবশালীদের ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়ার পর বনবিভাগের জমি ভূমিহীনদের কাছে অবৈধভাবে বন্দোবস্ত দিয়েছে হাতিয়া ভূমি অফিস। এতে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অর্ধেকেরও বেশি বন উজাড় করে সেখানে বসতি গড়ে তুলেছে ভূমিহীনরা। ফলে অরক্ষিত হয়েছে পড়েছে নোয়াখালীর সমগ্র উপকূলীয় এলাকা। যেকোনো মুহূর্তে ঝড়-তুফানের মতো বড় দুর্যোগের কবলে পড়তে পারে হাতিয়াসহ পুরো নোয়াখালী এলাকা। একইসঙ্গে চরম হুমকির মুখে পড়তে পারে বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিস্থিতিও।

বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল নিঝুমদ্বীপসহ এর আশপাশের ১১টি চরাঞ্চলের ৪০ হাজার ৩৯০ একর বনভূমিকে ‘নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যান’ ঘোষণা দেয় সরকার। যা পরবর্তী সময়ে ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। একইসঙ্গে এই এলাকার ২১ হাজার ৪৪ দশমিক ২৯ একর বন ভূমিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

ধমার চরে প্রভাবশারীদের দখলে থাকা সংরক্ষিত বনের জমিতে হচ্ছে ধান চাষ।

যার মধ্যে চর ওসমানে রয়েছে ৮ হাজার ৫০০ একর, কর্নার অব চর ওসমানে-৫০ একর, চর কমলায়-১ হাজার একর, চর ইউনুছে-২ হাজার ৫’শ একর, খাজার চরে-৪ হাজার একর, চর রোহানে-৫ হাজার একর, চর বাহাউদ্দিনে-৬ হাজার একর, চর রওশনে-৩ হাজার একর, চর কালামে-৬ হাজার ৬৪০ একর, চর আফতাবে-৭’শ একর এবং চরমুয়ীদে-৩ হাজার একর নিয়ে জাতীয় উদ্যোন ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে শুরু থেকে গত বছর পর্যন্ত বনবিভাগ ৩৭ হাজার ১৬৫ দশমিক ৪৮ একর ভূমিতে বনায়ন করা করেছে। যদিও এর মধ্যে বর্তমানে ২০ হাজার একর বনভূমিও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পুরো উদ্যোনের যথেচ্ছার ব্যবহার করছে ভূমিহীনরা। এখনো অবশিষ্ট যেটুকু আছে, তাও প্রতিনিয়ত উজাড় করছে ভূমিদস্যুরা।

বিজ্ঞাপন

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষিত এসব চরের মধ্যে চর কমলায় ৯ হাজার একর বনভূমি ও চর মুহিতের ৩ হাজার একর বনভূমিকে উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা মাহিদুর রহমানের নামে ‘চর মুহিত’ ও ‘চর মাহিত’ হিসেবে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছিল।

একইসঙ্গে, চর ওসমানের ৫০০ একর ও কর্নার অব চর ওসমানের ৫০ একর ভূমিকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে ‘নিঝুমদ্বীপ’ ও ‘বাউল্যার চর’ নামে। চর ইউনুছের ২ হাজার ৫০০ একর বনভূমির একটি অংশকে বর্ধিত ‘চর ইউনুছ’ ও অন্য অংশকে নিঝুমদ্বীপের একটি মৌজার নাম ‘বর্ধিত চর হেয়ার’ হিসেবে বন্দোবস্ত দেওয়া হচ্ছে। চর বাহাউদ্দিনের ৬ হাজার একর বনভূমিকে ‘দমারচর’ বলে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। চর রওশনের ৩ হাজার একর বনভূমিকে ‘দমারচর’ ও ‘চর কালাম’ নামে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। এছাড়া খাজারচরে ৪ হাজার একর, চর জোহানে ৫ হাজার একর, চর কালামে ৬ হাজার ৬৪০ একর ও চর আফতাবে ৭০০ একর বন ভূমিকে বন্দোবস্ত দিয়েছে ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তারা। ফলে এসব বনভূমি বন্দোবস্ত পাওয়ার পর ভূমিহীনরা বন উজাড় করে ঘরবাড়ি গড়ে তোলেন।

নিঝুমদ্বীপে সংরক্ষিত বনের জমি দখল করে বানানো হয়েছে মাছের প্রজেক্ট

সরেজমিনে দেখা যায়, সংরক্ষিত ও জাতীয় উদ্যোন হিসেবে ঘোষিত বনাঞ্চল নিঝুমদ্বীপের বনের পরিমাণ কমে গেছে ভূমিদস্যূদের দৌরাত্ম্যে। পুরো এলাকায় সর্বত্র বনের গাছ কাটার চিহ্ন দেখা গেছে। এছাড়া, শতফুল, ছোয়াখালী, বউ বাজার, নামার বাজার এলাকাগুলোতে বন উজাড় হয়ে যাওয়ার পর কেবল গাছের গুঁড়ি পড়ে রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয়দের অভিযোগ, বছর দুয়েক আগে যেখানে বন ছিল, এখন সেখানে গড়ে উঠেছে বসত ঘর। আর এভাবেই ক্রমাগত বন উজাড় করে বাড়ি গড়ছেন ভূমিহীনরা। এসবের নেপথ্যে রয়েছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন ও তার সহযোগীরা।

অভিযোগ রয়েছে, চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন সুকৌশলে ভূমিহীনদের বসবাসের উপযোগী জমি তার দখলে নিয়ে ভূমিহীনদের বনের ভেতর থেকে জমি নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। এতে কখনো কখনো ভূমিহীনদের বন ধ্বংসের জন্য টাকা দিয়েও সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। একপর্যায়ে বন কেটে জমি চাষের উপযোগী হলে সেই জমি চেয়ারম্যান মেরাজের দখলে চলে যায়। আবার সেসব জমিতে চাষ করে সে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক ভাগ নেন চেয়ারম্যান মেহরাজ।

নিঝুমদ্বীপের ছোঁয়াখালী এলাকায় সংরক্ষিত বনের ভেতরে রাস্তা বানিয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান

শতফুল এলাকার বাসিন্দা নুরুল আলম বলেন, ‘ছোঁয়াখালী থেকে আমাদের শতফুল এলাকা পর্যন্ত এ জায়গায় গত তিন-চার বছর আগেও বনবিভাগের গাছের কারণে অন্ধকার ছিল। হেঁটে যেতে ভয় লাগতো। আর গত দুতিন বছরে চেয়ারম্যান মেরাজের লোকজন পুরো বাগান ধ্বংস করে দখলে নিয়েছে। বন্দর টিলা বাজারের পশ্চিম পাশের বউ বাজার এলাকায়ও একই অবস্থা। ’

প্রায় একই ধরনের অভিযোগ করেছেন জাহাজমারা রেঞ্জের নিঝুমদ্বীপ (চর ওসমান) বিটের একজন কর্মকর্তাও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিনকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি কোনো কথাই শুনছেন না। তার লোকজন দিয়ে বনের গাছ কেটে জমি দখল করেই চলেছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মতো একটি চরে কীভাবে সরকার আবার ইউনিয়ন পরিষদ ঘোষণা করে? এটা তো মনে হচ্ছে জাতীয় উদ্যোনের বন ধ্বংস করার উদ্দেশ্য করা হয়েছে। শুনেছি এটা নিয়ে উচ্চ মহলে রিট চলছে।’

বিজ্ঞাপন

তবে,এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ইউপি চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন বলেন, ‘আমি জনপ্রতিনিধি হয়ে কীভাবে বন ধ্বংস করব? আমার বিরুদ্ধে বন ধ্বংসের যে অভিযোগ, সেটি প্রতিপক্ষের কেউ করতে পারে। আমি নিজে প্রতি ছয়মাস অন্তর মাইকিং করে জনগণকে সতর্ক করি যেন বন ধ্বংস না করে।’

প্রসঙ্গত, ২০০১ সালে নিঝুমদ্বীপকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর এটিকে জনবসতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার কথা ছিল। কিন্তু ২০০৯ সালেই এ দ্বীপকে স্থানীয় সরকার অবকাঠামোতে ইউনিয়ন পরিষদ ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ ২০১২ সালে সরকার এ দ্বীপকে জাতীয় উদ্যোন হিসেবে গেজেট প্রকাশ করে।

সংরক্ষিত বনাঞ্চলনকে অবমুক্ত করা ছাড়াই কীভাবে বন্দোবস্ত দেওয়া হচ্ছে—জানতে চাইলে হাতিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, ‘এ নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট হয়। আদালত নিঝুমদ্বীপকে ইউনিয়ন ঘোষণাকারীদের তলব করেন। একইসঙ্গে সেখানে সব ধরনের ভূমি বন্দোবস্ত স্থগিত রাখা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কীভাবে জাতীয় উদ্যানের মতো জায়গায় ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ ঘোষণা করা হয়েছে, সেটি আমার জানা নেই। এটি তদন্তের বিষয়। বন বিভাগ সরকারের একটি মন্ত্রালয়ের অধীন। ভূমি বিভাগ আরেকটি মন্ত্রণালয়ের অধীন। এখন সরকারই সিদ্ধান্ত নিবে কী করবে?’

সংরক্ষিত বনের জায়গায় জনগোষ্ঠীর জন্য গড়ে তোলা হয়েছে মৎস অভয়াশ্রম

অনুসন্ধানে জানা যায়, বনের জমি ভূমি অফিস কেন বন্দোবস্ত দিয়েছে, এ বিষয়ে জানতে চেয়ে নোয়াখালী জেলা প্রশাসককে চিঠি দেওয়া হয়। একইসঙ্গে সংরক্ষিত বনের জমি পুনরুদ্ধারেরও নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি বনের জমি বুঝে পেতে জেলা প্রশাসককে দুটি চিঠি দেন জেলা বন কর্মর্কতা। চিঠিতে নিঝুমদ্বীপের জাতীয় উদ্যোনে বন্দোবস্ত দেওয়া নথিভুক্তির জমির পরিমাণ, বসবাসরত মোট পরিবারের সংখ্যা, সরেজমিনে তদন্ত করে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের প্রস্তাবসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে অনুরোধ করা হয়। তবে, এখনো এ বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেন জেলা বন কর্মকর্তা।(ডিএফও) তৌহিদুল ইসলাম।

জেলা বন কর্মকর্তা বলেন, নিঝুমদ্বীপের বেদখল হওয়া জাতীয় উদ্যোনের জায়গা বুঝে পেতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে একটি টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে রাখা হয়েছে। কতটুকু জমি বনের আর কতটুকু জমি ভূমির, তা পরিমাপ করে দিতে ওই কমিটিকে আমরা বলেছিলাম। কিন্তু এখনো আমরা কোনো তালিকা পাইনি। এছাড়া, কী পরিমাণ জমি ভূমি অফিস বন্দোবস্ত দিয়েছে, তারও সঠিক তথ্য জানতে পারিনি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক তন্ময় দাস বলেন, ‘বন বিভাগের বেদখল হওয়া জমি পুনরুদ্ধারে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তবে এখনও প্রতিবেদন আসেনি। ’ প্রতিবেদন পেলে পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

শনিবার তৃতীয় পর্বে থাকছে: খাস জমি বন্দোবস্তে নিয়মের তোয়াক্কা করছে না হাতিয়া ভূমি  অফিস!

প্রথম পর্ব: দুর্গম চরেও ঠাঁই মিলছে না ভূমিহীনদের

সারাবাংলা/এসএইচ/এমএনএইচ

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন