বিজ্ঞাপন

‘ভুল চিকিৎসার’ বিরুদ্ধে লড়ছেন যে গৃহবধূ

March 7, 2019 | 8:44 pm

।। রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ২২ বছর বয়সী সন্তানকে ছোট একটি অস্ত্রোপচারের জন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন গৃহবধূ দেলোয়ারা বেগম। অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়, কিন্তু ডাক্তার ‘ভুল করে’ শরীরে ভেতরে সুঁই রেখে সেলাই করে দেন। তীব্র ব্যথায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা ছেলে আমিনুল ইসলামের। হাসপাতালে মৃত্যু নিশ্চিত জেনে সবাই যখন কলেমা পড়া শুরু করেন, তখন আরেক ডাক্তার এসে সেই সুঁই আরেক দফা অস্ত্রোপচার করে বের করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু সেই অস্ত্রোপচারের পর ভেতরে রয়ে যায় ব্যান্ডেজ। আবারও মৃত্যুমুখে আমিনুল। শেষে ভারতে নিয়ে গিয়ে সাত দফা অস্ত্রোপচার করে বের করা হয় সুঁই ও ব্যান্ডেজ। প্রাণে বেঁচে যান আমিনুল।

হাসপাতালে, ডাক্তারের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে যুদ্ধ করে ছেলের প্রাণ ফিরিয়ে এনে দেলোয়ারা বেগম নেমে পড়েন আরেক যুদ্ধে। যেসব ডাক্তারের জন্য তার সুস্থ-সবল সন্তানকে নিতে হয়েছে পঙ্গুত্বের অভিশাপ, তাদের শাস্তি দেবেন দেলোয়ারা। মামলা করলেন ডাক্তারদের বিরুদ্ধে। এরপর থেকে ক্রমাগত হুমকিধমকি, প্রাণে মেরে ফেলার ভয়ভীতি উপেক্ষা করে গত ছয় বছর ধরে দেলোয়ারা ঘুরছেন আদালতের বারান্দায়। অভিযুক্ত ডাক্তারদের শাস্তি দেওয়ার প্রতিজ্ঞা এখন গিয়ে ঠেকেছে ‘ভুল চিকিৎসার’ বিরুদ্ধে এক গৃহবধূর প্রাণপণ লড়াইয়ে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে গৃহবধূ দেলোয়ারা বেগম মুখোমুখি হয়েছিলেন সারাবাংলা’র। আলাপে উঠে এসেছে সন্তানের জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ থেকে ‘ভুল চিকিৎসার’ বিরুদ্ধে ক্রমাগত চালিয়ে যাওয়া এক মায়ের সংগ্রামের কথা।

বিজ্ঞাপন

ছেলে মারা যাচ্ছে, কলেমা পড়ে পানি খাইয়েছিলেন দেলোয়ারা

চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বাচ্চু’র ছেলে আমিনুল তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য বিবিএ সম্পন্ন করা তরুণ। তার মলদ্বারে সামান্য ব্যথা ছিল। ছেলেকে নিয়ে দেলোয়ারা বেগম শরণাপন্ন হয়েছিলেন জিইসি মোড়ে আইডিয়াল ল্যাবে ডা.সুরমান আলী’র। এই চিকিৎসক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ল্যাপরোস্কোপিক, কলোরেক্টাল ও জেনারেল সার্জন ছিলেন। সুরমান আলী জানান, আমিনুলের মলদ্বারে অস্ত্রোপচার করতে হবে। ২০১২ সালের ৩০ মে অস্ত্রোপচার করা হয় নগরীর ওআর নিজাম রোডে রয়েল হাসপাতালে। অস্ত্রোপচার করেন সুরমান আলী নিজেই।

দেলোয়ারা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘অপারেশনের পর যখন আমার ছেলের জ্ঞান ফিরে আসে, তখন সে বাথরুমে যায়। সেখানে প্রস্রাব করতে গিয়ে তীব্র ব্যাথা শুরু হয়। ব্যাথার চোটে চিৎকার করে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তার মাথা ফেটে যায়। আমরা ধরাধরি করে তাকে সিটে নিয়ে আসি। তাড়াতাড়ি সুরমান আলী সাহেবের কাছে যাই। তিনি বললেন- অপারেশনের পর ব্যথা হওয়া স্বাভাবিক। তিনি আমার ছেলেকে ডিসচার্জ করে দেন। কিন্তু আমি ছেলের চেহারার দিকে তাকাতে পারছিলাম না। যন্ত্রণায় সে কাতরাচ্ছিল। এরপরও যেহেতু ডাক্তার ডিসচার্জ করেছেন, আমরা তাকে বাসায় নিয়ে যাই।’

বিজ্ঞাপন

দেলোয়ারা জানান, বাসায় গিয়ে বারবার আমিনুল বলতে থাকে- তার অস্ত্রোপচার করা জায়গায় কিছু রয়ে গেছে। সে কাতরাতে থাকে। তখন দেলোয়ারা আবারও সুরমান আলী’র কাছে যান। ডাক্তার তাকে বলেন- ছেলে মিথ্যা বলছে, অভিনয় করছে। ডাক্তারের কথায় আস্থা রেখে বাসায় ফিরে দেলোয়ারা ছেলেকে চড়-থাপ্পড়ও দিয়ে ফেলেন কয়েকবার। কিন্তু আমিনুলের অবস্থার ক্রমশ: অবনতি ঘটতে থাকে। আমিনুলকে আবারও রয়েল হাসপাতালে নেওয়া হয়। এক্স-রে করে অস্ত্রোপচার করা শরীরের অংশে বাহ্যিক কিছুর অস্তিত্ব দেখা যায়।

দেলোয়ারার বক্তব্য- এক্স-রে রিপোর্ট দেখে সুরমান আলী বলেন, ভেতরে সুতার মতো কিছু রয়ে গেছে, সেগুলো মলত্যাগের সময় স্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু রয়েল হাসপাতালের ডা.লিয়াকত আলী’র পরামর্শে দেলোয়ারা তার ছেলে নিয়ে ভর্তি করেন নগরীর মেহেদিবাগে ন্যাশনাল হাসপাতালে। বেসরকারি ল্যানসেট ডায়াগনস্টিক এন্ড রিসার্চ সেন্টারের চিকিৎসক ডা. জাকির হোসেন ওই হাসপাতালের এক্স-রে রিপোর্ট দেখে তাকে জানান, আমিনুলের শরীরে অস্ত্রোপচারের পর সুঁই বের করা হয়নি। আরেকদফা অস্ত্রোপচার করে সেটি বের করতে হবে। দেলোয়ারার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। দ্রুত অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করেন।

‘সুরমান আলী একদফা ক্ষতি করেছেন। জাকির হোসেন আরও বড় ক্ষতি করেন। তিনি নিডল বের করতে গিয়ে মলদ্বার কেটে ফেলেন। কিন্তু নিডল বের করতে পারেনি। যন্ত্রণা আরও বাড়তে থাকল। আমার ছেলেটা নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকল। আমি জাকির হোসেনের চেম্বারে যাই একবার, আবার সুরমান আলীর চেম্বারে। তারা আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করলেন। কেউ কোনো আশা দিতে পারলেন না।’ বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন দেলোয়ারা।

তিনি জানান, ‘হাসপাতাল থেকে বলা হল- আমার ছেলের শেষ অবস্থা। আমরা যেন কলেমা পড়ে সবাই দোয়া করি। আমাকে বলা হল, পানি খাইয়ে দিতে। আমি তো মা। আমার মন মানে না। আমার চোখের সামনে আমার ছেলেটা মরে যাচ্ছে। কলেমা পড়ে ছেলের মুখে পানি দিলাম। আল্লাহ আমিনুলের প্রাণটা ভিক্ষা দিল।’

বিজ্ঞাপন

পরদিন থেকে আরও কয়েকজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন দেলোয়ারা ও তাঁর স্বামী। আবারও আমিনুলকে রয়েল হাসপতালে নেওয়া হল। সেখানে আরেক দফা এক্স-রে করার পর জানা গেল, প্রথম দফা অস্ত্রোপচারের পর রেখে দেওয়া সুঁইয়ের সঙ্গে দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত ব্যান্ডেজও ভেতরে রয়ে গেছে। রয়েল হাসপাতালের চিকিৎসক মতিউর দ্রুত আরেক দফা অস্ত্রোপচার করে ব্যান্ডেজ বের করে আনেন। এরপর থেকে তার ছেলের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে থাকে বলে জানান দেলোয়ারা।

ভারতে সাতদফা অস্ত্রোপচারের পর বের করা হয় সুঁই

২০১২ সালের ৩০ জুন আমিনুলকে নিয়ে কলকাতা যান দেলোয়ারা। ভর্তি করা হয় অ্যাপোলো হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসক দেবাশীষ দত্তের তত্বাবধানে সাতদফা অস্ত্রোপচার হয়। বের করা হয় রেখে দেওয়া সুঁই। কেটে ফেলা মলদ্বারেরও চিকিৎসা হয়।

দেলোয়ারা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, কলকাতার হাসপাতালে সুঁই বের করার সময়ও আমার ছেলের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। একেবারে মারা যাবে, এমন অবস্থা। তখন আবারও কলেমা পড়ে পানি খাইয়ে দিই। ছেলেকে সুস্থ করে ফেরত আনতে পারব, এমন চিন্তা মাথায় ছিল না। তারপরও আল্লাহ’র অশেষ রহমতে ব্যথাটা কমে যায়। কিন্তু এরপর দেড় বছর ধরে কলকাতা আর চট্টগ্রামে বারবার আসা-যাওয়া করতে হয়েছে।

‘দেড় বছর ধরে আমার ছেলেকে প্যাম্পার্স পরিয়ে রাখতে হয়েছে। কিছু খেলেই অটোমেটিক মলত্যাগ হয়ে যেত। মল বেরিয়ে যাবে, এই ভয়ে কত রাতের পর রাত যে আমার ছেলে দাঁড়িয়ে থেকেছে তার কোনো হিসেব নেই। গাড়িতে, বিমানে করে নিয়ে যাবার সময় ছেলের জন্য ২টা সিটের টিকেট কিনতে হতো। এতো কষ্ট করে ছেলেটাকে বড় করলাম, ডাক্তারের সামান্য অবহেলায় আমার সুস্থ ছেলেটা আতুর হয়ে গেল। অবশ্য আল্লাহর রহমতে সে এখন আগের চেয়ে সুস্থ, পুরোপুরি সুস্থ আর কখনোই হবে কি-না জানি না।’ বলেন দেলোয়ারা বেগম।

ছেলেকে বাঁচিয়ে নেমে পড়লেন আরেক যুদ্ধে

২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি চট্টগ্রামের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে দুই চিকিৎসক সুরমান আলী ও জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করলেন দেলোয়ারা বেগম। দন্ডবিধির ২৬৯, ২৭০, ৩২৬, ৪২০ ও ৩৪ ধারায় দায়ের হওয়া মামলাটি গ্রহণ করে আদালত চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানাকে সেটি সরাসরি এজাহার হিসেবে রেকর্ডের নির্দেশ দেন।

২০১৩ সালের ৩০ মে দুই চিকিৎসককে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা পাঁচলাইশ থানার তৎকালীন এসআই রহুল আমিন। ৩ জুন সুরমান আলী আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। জাকির হোসেন হাইকোর্ট থেকে জামিনে ছিলেন।

সুরমান আলীকে কারাগারে পাঠানোর পর নজিরবিহীন আন্দোলন শুরু করেন চট্টগ্রামের চিকিৎসকেরা। তারা প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করে দেন। হাসপাতালে রোগী রেখে তারা মানববন্ধনসহ বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি পালন করতে থাকেন। মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি আসতে থাকে দেলোয়ারার কাছে। কিন্তু তিনি অনড়।

দেলোয়ারা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডাক্তারদের একজন নেতা আমাকে বললেন- উনি তিন খুনের আসামি। মামলা কিভাবে প্রত্যাহার করাতে হয়, সেটি তিনি দেখে নেবেন। টেলিফোনেও বারবার বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিতে থাকে। তবে মিডিয়া এবং পুলিশ আমার পাশে ছিল। আমি হুমকি এলেই থানায় গিয়ে জিডি করেছি। আমি বলেছি- প্রয়োজনে আমার মৃত্যু হবে, কিন্তু মামলা প্রত্যাহার করব না।’

এদিকে, ২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। একবছর পর ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট দুই চিকিৎসককে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আদেশ দেন চট্টগ্রামের তৎকালীন মুখ্য মহানগর হাকিম মশিউর রহমান চৌধুরী।

এর বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে রিভিশন দাখিল করেন দেলোয়ারা বেগম। ২০১৬ সালের ৮ মে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শাহে নূর রিভিশন খারিজ করে করে ‍দুই চিকিৎসকের মামলা থেকে অব্যাহতির আদেশ বহাল রাখেন।

এই আদেশের বিরুদ্ধে বাদি হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০১৮ সালের ২৮ মে দুই চিকিৎসককে অব্যাহতি দেওয়ার আদেশ খারিজ করে দেন বিচারপতি মো.আব্দুল হাকিম ও এস এম মুজিবুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে দুই চিকিৎসক আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করেছেন, যা এখনও শুনানির অপেক্ষায় আছে বলে জানিয়েছেন দেলোয়ারা বেগম।

তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি শেষ পর্যন্ত লড়ব। আমি একজন সাধারণ পরিবারের গৃহবধূ। আমার সন্তানের প্রতি যে অবিচার হয়েছে, সেটা যেন আর কারও প্রতি না হয়, সেজন্য আমি লড়ে যাচ্ছি। দেশের আইন-আদালতের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। আমি বিশ্বাস করি, ভুল চিকিৎসার জন্য দায়ী চিকিৎসকদের অবশ্যই বিচার হবে। যতক্ষণ প্রাণ থাকে, এই মামলা থেকে আমি সরে আসবো না।’

সারাবাংলা/আরডি/এনএইচ

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন