বিজ্ঞাপন

মামলা দিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা, বিশৃঙ্খলা আগের মতোই

March 25, 2019 | 9:51 am

সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: সড়কে বিশৃঙ্খলা ও রাজধানীতে কয়েকজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর জেরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে সড়কে বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। শৃঙ্খলা ফেরাতে গত ছয় মাসে পাঁচবার পালন করা হয়েছে ট্রাফিক সপ্তাহ, ট্রাফিক পক্ষ ও ট্রাফিক মাসের মতো নানা কর্মসূচি। তবে মিলছে না সুফল। স্বাভাবিকভাবেই জনমনে প্রশ্ন জন্মেছে এসব কর্মসূচির কার্যাকারিতা নিয়ে।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেছেন, সড়কের পুরো সিস্টেমে ত্রুটি রেখে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য ট্রাফিক পুলিশের যে চেষ্টা, তা কখনো সফল হবে না। উল্টো ত্রুটিপূর্ণ সিস্টেমগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ণ ছাড়া এমন কর্মসূচি একসময় জনগণের জন্য বিরক্তিকর। তাই আগেই ক্রুটিগুলোর টেকসই সমাধান নিশ্চিত করে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতি জোর দেওয়া উচিত।

তবে এ ব্যাপারে পরিবহন বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সড়কের এমন বিশৃঙ্খলা ট্রাফিক পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। কারণ ট্রাফিক পুলিশের কাজই হলো আইন মানতে বাধ্য করা। আর আইন মানুষ তখনি মানবে যখন তা মানার জন্য কার্যকরি পরিবেশের সৃষ্টি হবে। অন্যথায় আইন মানতে ট্রাফিক পুলিশ যে কার্যক্রম পরিচালনা করে জরিমানা করছে, সেটি অন্যায়। সেই সঙ্গে সড়ক এবং ফুটপাত ঘিরে একটি বড় রাজনৈতিক সিন্ডিকেট অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করায় এটি নিয়ন্ত্রণ এখন রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপরও নির্ভর করছে।

তবে ট্রাফিক পুলিশের দাবি, তারা যে কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাতে সড়কে শৃঙ্খলা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসলেও কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে। সফলতা না আসলেও এটি ব্যর্থতা নয় বলেই মনে করেন তারা। আর এসব কার্যক্রমের পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে পুরোপুরি সমাধান আসবে বলে মনে করেন তারা। এছাড়া বিভিন্ন সেবা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে ক্রুটি সমাধানে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ সূত্র।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দেখা গেছে, এখনো বিশৃঙ্খলা রয়েছে আগের মতই। ট্রাফিক পুলিশও নিয়মিত মামলা দেওয়ার কাজে ব্যস্ত। এতে যত্রতত্র রাস্তা পারাপার, যাত্রী উঠানামা এবং বেপরোয়া গতি নিয়ে যানবাহন চলাচলের কোনো দৃশ্যমান নিয়ন্ত্রণ হয়নি। এখনো পথচারীদের জন্য সড়ক পারাপারে বিদ্যমান জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভার ব্রিজ কিংবা ফুটপাত ব্যবহারের উপযোগী করা হয়নি। আবার পরিবহন ব্যবস্থাপনায়ও ফিটনেসবিহীন কিংবা অনুপযোগী পরিবহনগুলো এখনো অপসারণ করা হয়নি। ট্রাফিক পুলিশ শুধু মামলা দিচ্ছে। আর সে মামলার জরিমানা পরিশোধ করে ফের সড়কে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকরা। এ অবস্থায় পরিবর্তন আশা করাটাও বোকামি বলে মনে করেন নগরবাসী।

রোববার (২৪ মার্চ) দুপুর দেড়টার সময় কারওয়ান বাজারে দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশের সিগনাল ছাড়ায় রাস্তা দিয়ে পারাপার হচ্ছে পথচারীরা। আবার গণপরিবহনগুলো যেখানে সেখানে যাত্রী নামাচ্ছে-উঠাচ্ছে। এতে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট।

বিজ্ঞাপন

সোনারগাঁও হোটেল মোড়ে রাস্তাপারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন শরীফ রহমান। যাবেন স্কয়ার হাসপাতালে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘পনের মিনিট দাঁড়িয়ে আছি রাস্তা পার হওয়ার জন্য। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশের সিগন্যাল না পাওয়ায় যাচ্ছি না। অন্যরা তো যাচ্ছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন আমি যদি তাদের মতো যেতে চাই, আর কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে আমার দায় হবে আমি সিগনাল মানিনি। কিন্তু এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি, অথচ সিগন্যাল পাচ্ছি না।’

অন্য একজন পথচারী সিরাজ উদ্দিন সিগন্যাল না মেনে রাস্তা পার হলেন। সামনে গিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশের সিগন্যালের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেক্ষণ। কিন্তু সিগন্যালের লক্ষণ নেই। মনে হয় সে ভুলেই গেছে সিগন্যাল দেওয়ার কথা। তাই নিয়ম না মেনেই চলে আসলাম। দেশের এত নিয়ম মানতে গেলে গন্তব্যে যাওয়া আর হবে না। রাস্তায় দিন শেষ করতে হবে’ বলেই অপরাধীর মতো একটা হাসি দিয়ে সামনে হাঁটতে থাকেন।

এ বিষয়ে জানতে কথা হয় জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) সহসভাপতি আকতার মাহমুদের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর যে দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশ হাতে নিয়েছে তা তো সম্ভব নয়। কারণ তাদের দায়িত্ব হলো ট্রাফিক আইন মানানো। কিন্তু ট্রাফিক আইন মানার আগে যে সমস্যাগুলো সমাধান প্রয়োজন সেগুলোতো তারা পারবে না বা তাদের দায়িত্ব নয় সেটি।’

তিনি আরও বলেন, ‘উত্তরার হাউজ বিল্ডিং এলাকার ফুটওভার ব্রিজটা এক সময় সড়কের উভয় পাশে সংযুক্ত ছিল। কিন্তু সড়ক প্রসস্ত হওয়ায় সেটি এখন রাস্তার মাঝখানে হয়ে গেছে। এখন কোনো পথচারী যদি ওই ফুটওভার ব্রিজে উঠতে চায় তাহলে সে গাড়ির মাঝে দিয়ে পার হয়ে ব্রিজে উঠতে হবে। কিন্তু এটা তো সম্ভব নয়। আবার ধরুন বাংলামোটরের ফুটওভার ব্রিজ। যেটি শুধু একটি সড়কে। বাকি দুটি সড়কে নিচ দিয়ে পারাপার হতে হয়। তাহলে একটি ফুটওভার ব্রিজ যখন করা হয়েছিল তখনো তো বাকি আরও দুটি সড়ক ছিল। তাহলে সেসব সড়কে ফুটওভার ব্রিজ হয়নি কেনো। আবার যেটি আছে সেটিও ব্যবহার হয় না। কারণ সেখানে যখন সিগন্যাল দেওয়া হয় এপাশ ওপাশের গাড়ি পারাপারের জন্য তখন কিন্তু নিচ দিয়ে পথচারীরা পার হয়ে যাচ্ছে সুন্দরভাবে। যেকারণে সেখানে এখন জেব্রা ক্রসিং দেওয়া হয়েছে। আবার দেখা যায়, শিশু পার্ক কিংবা বেইলি রোডের ফুটওভার ব্রিজ। যেগুলো ব্যবহারই হয় না।’

বিজ্ঞাপন

পরিকল্পনাবিদ আকতার মাহমুদ বলেন, ‘দুর্ঘটনার জন্য যথেষ্ট কারণ রয়েছে। পথচারী এগুলোতে উঠতে এবং নামতে গাড়ির সঙ্গে রেষারেষি করে সেগুলো ব্যবহার করতে হয়। একই অবস্থা মৌচাক ও বনানীর মিরপুর ফ্লাইওভার। যেখানে ত্রিমুখী ও চতুর্মুখী চলাচল রয়েছে। কিন্তু কোনো গতি নিয়ন্ত্রক সাইন নেই। কাজেই এসব ক্রুটির ডিজিটাল সমাধান না করে ট্রাফিক পুলিশের পরিশ্রম বৃথা যাবে।’

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পাঁচটি সমস্যার টেকসই সমাধান প্রয়োজন বলে মনে করেন অপর একজন নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবীব। তিনি বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশের কর্মসূচি নেওয়ার আগে কিছু অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন ছিল। যা বাস্তবায়ন করার কথা সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য সেবা সংস্থাগুলোর।’

তিনি বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রথমেই পাঁচটি বিষয়ের টেকসই পরিবর্তন আনতে হবে। সেগুলো হল- বাস চলাচল থেকে শুরু করে যাত্রী ওঠা-নামার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে বাস-বে তৈরি করা, পথচারীর চলাচলের করিডোর (রুট) তৈরি করে তাদের চলাচল যেন নির্বিঘ্নে হয় সেজন্য সকল ধরনের সিগন্যালিং সিস্টেম এবং রোড সাইন সহায়িকা তৈরি করা, সকল সিগন্যাল সিস্টেম মোতাবেক সকল গাড়ি থামা-চলা এবং সেই সঙ্গে তার গতির নিয়ন্ত্রিত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ডিজিটাল অবকাঠামোগত উন্নয়ণ করা, নগরীর সকল অনুপযোগী এবং ফিটনেসবিহীন পরিবহন অপসারণ করে দ্রুততম সময়ে যাত্রীবান্ধব বাস নামিয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগহীন সম্পন্ন চালক দ্বারা সেগুলো পরিচালনা করা ও অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সকল চালকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে লাইসেন্স নবায়ণ করতে হবে। এ ক্রুটিগুলো যদি সমাধান করা হয় তাহলে ট্রাফিক সিস্টেমে শৃঙ্খলা ফিরবেই।

এ বিষয়ে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামছুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘সড়কে বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কোনো প্রকল্পের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছার। কারণ এ বিশৃঙ্খলার কারণে একটি রাজনৈতিক সিন্ডিকেট বড় ধরণের অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করছে। আবার বিআরটিএ এবং পুলিশও সে সুবিধার অন্তর্ভুক্ত। যেটি আমি গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ পেয়েছি। কাজেই ট্রাফিক পুলিশ চাইলেই এ সমস্যার সমাধান আনতে পারবে না। এটি করতে হলে সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন। আর এ সরকার চাইলে তা করতে পারে। সরকার এখন তৃতীয় মেয়াদের। যেখানে আর ভাবার সময় নেই। এখন বাস্তবায়ণের সময়।’

রাজধানীর সড়কে বাস শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে গঠিত টাস্কফোর্স ‘বাস রুট রেশনালাইজেশন’ কমিটির সদস্য ও ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মফিজ উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এখন ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন চালকদের মামলার মাধ্যমে সচেতন করার চেষ্টা করছি। পথচারীদের ও যারা যত্রতত্র পারাপার হচ্ছে তাদেরকেও সচেতন করার চেষ্টা করছি। এতে পুরোপুরি শৃঙ্খলা না ফিরলেও আমরা ব্যর্থ নই। এ ব্যাপারে কিছুটা হলেও সফল হয়েছি। তবে পুরোপুরি সফল হতে অবকাঠামোগত যেসব উন্নয়নের প্রয়োজন সেগুলো ও বাস্তবায়ন করতে সিটি করপোরেশন, বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে কাজ করছি আমরা।

সারাবাংলা/এসএইচ/এমআই

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন