বিজ্ঞাপন

নাকচ হচ্ছে ভিআইপি লেনের প্রস্তাব

February 6, 2018 | 11:33 pm

গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: গত সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিবের ব্রিফিংয়ে ‘ঢাকার রাস্তায় ভিআইপিদের জন্য আলাদা লেন’ এমন একটি খবর সংবাদমাধ্যম হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে ওঠে আলোচনা সমালোচনার ঝড়। নানামহল থেকে প্রতিবাদও আসে। প্রস্তাবটি ছিলো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের। যেটি অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে। সেখান থেকে এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে পাঠানো হয়েছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষে (ডিটিসিএ)। আর দায়িত্বশীল সূত্র জানাচ্ছে, এরই মধ্যে ডিটিসিএ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা এই প্রস্তাবের বাস্তব ভিত্তি দেখছেন না। প্রস্তাবটি নাকচ করা হবে।

এদিকে, আলাদা লেনের প্রস্তাবকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, অসাংবিধানিক এবং গণবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও নগর পরিকল্পনাবিদরা। তাদের মতে, এই ধরনের প্রস্তাব কোন অবস্থাতেই অনুমোদনযোগ্য নয়। কেউ মত দিয়েছেন, যদি হয়, তাহলে বুঝতে হবে আমরা পিছনের দিকে যাচ্ছি। অন্য একজন বলছেন, এটি করা হলে, শহরের সমস্যাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে। পৃথিবীর কোথাও ভিআইপিদের জন্য আলাদা লেন নেই, এমন মত দিয়ে তারা এও বলছেন, এই ধরনের প্রস্তাবকে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, বৈষম্যমূলক ও ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহারের সামিল।

কি আছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আলাদা লেনের প্রস্তাবে?
এরই মধ্যে সারাবাংলার হাতে মন্ত্রী পরিষদের পাঠানো প্রস্তাবের একটি কপি এসেছে। তাতে প্রস্তাবে কী লেখা হয়েছে তা এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো-

বিজ্ঞাপন

“ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে। জনআধিক্য, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় রাস্তার স্বল্পতার কারণে সহসা এর সমাধান কঠিন। তীব্র যানজটের কারণে অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সেবা খাতের যানবাহনসমৃহের চলাচল প্রায়ই মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের জনবহুল গুরুত্বপূর্ণ শহরে সেবাকাজে নিয়োজিত যানবাহন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের চলাচলের জন্য সড়কসমৃহে পৃথক লেইন রয়েছে। ঢাকা মহানগরী সড়কসমৃহে অনুরুপ পৃথক লেইন তৈরি করা হলে সেবাখাতের যানবাহনসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গেও চলাচল সহজতর হবে।
বর্ণিত প্রেক্ষাপটে বিষয়টি পরীক্ষা নিরীক্ষাপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হল।”

 

মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের উপসচিব সাজজাদুল হাসান এতে স্বাক্ষর করেন।

বিজ্ঞাপন

কি বলেছিলেন মন্ত্রী পরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম?
এই প্রস্তাবের বক্তব্যের সাথে বাড়তি কিছু কথা মন্ত্রী পরিষদ সচিবের বক্তব্যে এসেছিলো। সোমবার তিনি এই প্রসঙ্গে কথা বলেন একজন সংবাদকর্মীর প্রশ্নের উত্তরে। প্রশ্নটি ছিল-

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগের কাছে ভিআইপিদের জন্য আলাদা লেনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে কী?

উত্তরে সচিব বলেন-

“মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নরমাল একটা অনুরোধ করা হয়েছে, পরীক্ষা করে দেখার জন্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভিআইপিরা ডান দিক দিয়ে যায়, উল্টো দিক দিয়ে যায়। নানা রকমের ঝামেলা হয়, অনেক সময় যাওয়া লাগে। অন্যান্য অনেক দেশে ভিআইপিদের জন্য আলাদা লেন আছে, আমাদের দেশে সেটা করা যায় কিনা, বিশেষ করে জরুরি বিভাগের জন্য।”

বিজ্ঞাপন

সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল- ভিআইপির তালিকায় কারা পড়েন? মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘বিশেষ করে ইর্মাজেন্সির জন্য, ভিআইপিরা অত বেশি গুরুত্বপূর্ণ না। অ্যাম্বুলেন্সে যে লোকটা মারা যাচ্ছে, এছাড়া ফায়ার সার্ভিসও অ্যাক্সেস পায় না- এসব ইমার্জেন্সি সার্ভিসের জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। পুলিশের অনেক সময় দ্রুত যাওয়ার দরকার হয়।’

এ ব্যাপারে সারাবাংলার কথা হয়, নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন-

“এতোদিন ধরে আরবান নিয়ে স্টাডি করছি, দেখছি, শুনছি কখনো এই ধরনের কথা শুনিনি। ভিআইপি রোড আছে, এখন ভিআইপি লেন। এই ধরনের চিন্তা ভাবনাতো ঠিক না”

তিনি বলেন, “ঢাকার যে যানজট সমস্যা রয়েছে তার বড় সলিউশন হলো, গণপরিবহন, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। তা না করে কয়েকজন লোকের জন্য লেন লাগবে, এটা হয় না। সুপারিশ হল, আলাদা বাস লেন রাখা। বাস র‌্যাপিট ট্রানজিট (বিআরটি)। যেটা করার জন্য সরকার চেষ্টা করছে। সেদিকে না গিয়ে কয়েকজন লোকের জন্য একেবারে উল্টা দিকে যাওয়া! এটা শুধু অবাস্তবই না। অজ্ঞতাপ্রসূত প্রস্তাব। পৃথিবীর কোথাও এই রকম দেখি নাই। লন্ডন, টোকিও, নিউইয়র্ক কোথাও এই ধরনের লেন আছে, দেখি নাই, শুনিও নাই।”

নজরুল ইসলাম বলেন, “যুগ্মসচিব পর্যন্ত ভিআইপি, কত হাজার ভিআইপি আছে, তাদের জন্য লেন থাকতে হবে?
স্থপতি ইকবাল হাবিব সারাবাংলা.নেটকে বলেন, নিতান্তই যে শহরে একটি গণপরিবহণ ব্যবস্থা নাই, একটি গণপরিবহণ ব্যবস্থার অভাবে শহরের গতিসীমা ঘন্টায় ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার পৌঁছেছে। সেই শহরে নতুন সড়ক যুক্ত করা যাচ্ছে না, সড়কের সক্ষমতা ও গতিশীলতা বাড়ানোর জন্য কাজ করা হচ্ছে না। এই শহরের গণমানুষের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা না করে বিশেষ বিশেষ মানুষের লেন সংক্ষণের চেষ্টা গণবিরোধী। এটা সরকারকে বিব্রত করার মত একটি প্রচেষ্টা বলেও আমি মনে করছি। এটা কোনভাবেই বাস্তবসম্মত নয়।

নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আখতার মাহমুদ সারাবাংলা.নেটকে বলেন, ঢাকা শহরে যেভাবে অবকাঠামো তৈরি হয়েছে এবং গণপরিবহন নিয়ে যে সিদ্ধান্তগুলো হয়েছে এর কোনটাই জনবান্ধব নয়।

ভিআইপি লেনের জন্য যে প্রস্তাবটা এসেছে এটাও জনবান্ধব হয়নি, জনবিরোধী হয়েছে। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ যখন ট্রাফিক জ্যামে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে, সেখানে ভিআইপিদের জন্য আলাদা একটা লেন হবে, তা অবিশ্বাস্য, এটা হওয়া উচিত নয়।

যারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব নিয়ে এটা করছেন। তিনি বলেন, ভিআইপিদের জন্য আলাদা লেন করা জনবিরোধী সিদ্ধান্ত।

টিআইবি‘র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জরুরি সেবার যানবাহন ও ভিআইপিদের চলাচলে রাজধানীতে আলাদা লেনের প্রস্তাব অসাংবিধানিক। তিনি বলেন-

“এ ধরনের প্রস্তাব সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, বৈষম্যমূলক ও ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহারের শামিল। টিআইবি মনে করে, আলাদা লেন করে ভিআইপি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ কোন বিশেষ মহলকে অসাংবিধানিক ও অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য আত্মঘাতীমূলক। সরকার এ ধরনের অনিয়মকে কোনভাবেই উৎসাহিত করবে না বলে আমরা প্রত্যাশা করি।”

উল্লেখ্য, গত ৩১ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবের কাছে ভিআইপি ও সেবা খাতের পরিবহন চলাচলের জন্য আলাদা লেন তৈরির জন্য একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রস্তাবটি গত ১০ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করে মতামত দেওয়ার জন্য ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপর্ক্ষ (ডিটিসিএ)‘র নির্বাহী পরিচালকের কাছে পাঠানো হয়। বর্তমানে প্রস্তাবটি ডিসিটিএ কার্যালয়ে রয়েছে।
কর্তৃপক্ষটির দায়িত্বশীল সূত্র সারাবাংলাকে জানিয়েছে, তারা প্রস্তাবটি নাকচ করে দিচ্ছেন।

এ ব্যাপারে ডিসিটিএ’র নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সৈয়দ আহম্মদ মঙ্গলবার বিকালে তার কার্যালয়ে সারাবাংলা.নেটকে বলেন, প্রস্তাবনাটি আমরা পেয়েছি। আগামী দুই/একদিনের মধ্যে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আমাদের সুস্পষ্ট মতামতসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেব।

সারাবাংলা/জিএস/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন