বিজ্ঞাপন

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, একবছরে গ্রাহক সংখ্যা দ্বিগুণ

August 6, 2019 | 11:10 am

টুটুল রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: প্রচলিত ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এজেন্ট ব্যাংকিং। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খুলেছেন ২৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৫ জন। এর প্রায় ৮৭ শতাংশই গ্রামের অধিবাসী। আর গত একবছরেই অ্যাকাউন্ট খুলেছেন ১৪ লাখ ৩৭ হাজার ৮৫৮ জন। অর্থাৎ, এই এক বছরেই এজেন্ট ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই একবছরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম ও জমার পরিমাণও বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। একই সময়ে এই সেবার মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় তিন গুণ।

বিজ্ঞাপন

এমন সাড়া পাওয়ায় এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও এখন ঝুঁকছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে। চাহিদা বিবেচনায় কোনো কোনো ব্যাংক এ বছরের মধ্যেই ১৫শ থেকে দুই হাজার আউটলেট খোলার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংক কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের (এসএমই) জন্য ঋণও বিতরণ করতে চায় এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য, বিভিন্ন ব্যাংকের প্রধান, হেড অব এজেন্ট ব্যাংকিংসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব  তথ্য জানা গেছে।

যাত্রা শুরু ২০১৪ সালে

স্বল্প আয়ের মানুষ, যাদের ব্যাংকিং সেবা নেওয়ার মত সামর্থ্য নেই, তাদের জন্যও ব্যাংকিং সেবা দিতে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে এজেন্ট ব্যাংকিং নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরের বছর ব্যাংক এশিয়া প্রথমে এ সেবা চালু করে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৯টি ব্যাংক প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের জন্য এই ব্যাংকিং সেবা চালু করেছে। শুরুতে খুব বেশি সাড়া না ফেললেও প্রযুক্তিনির্ভর, সহজলভ্য ও ঝামেলামুক্ত হওয়ার কারণে এজেন্ট ব্যাংকিং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে।

বিজ্ঞাপন

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে যেসব সেবা

এজেন্ট পয়েন্ট থেকে আমানত সংগ্রহ, ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ, রেমিট্যান্সের অর্থ পৌঁছে দেওয়া, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ভাতাভোগীকে অর্থ প্রদান, অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স জানা, অ্যাকাউন্ট ফরম সংগ্রহ, ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডের আবেদন ফরম এবং চেক বই সংগ্রহের মতো সেবাগুলো এখন পাচ্ছেন প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষরা।

সেবা গ্রামমুখী

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকিং সেবা শহরে কেন্দ্রীভূত হলেও এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা গ্রামমুখী। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত চালু হওয়া ৪ হাজার ৮৬৬টি এজেন্টের মধ্যে ৪ হাজার ৩৬৫টিই গ্রামে অবস্থিত। আর ৭ হাজার ৮৩৮টি আউটলেটের মধ্যে ৭ হাজার ৮৪টি গ্রামে।

গ্রাহক-জমা দ্বিগুণ একবছরে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন বলছে, এ বছরের মার্চ পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খুলেছেন ২৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৫ জন। এর মধ্যে ২৫ লাখ ২২ হাজার জন গ্রামের অধিবাসী। আগের বছরের মার্চে হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ৬৮ হাজার ৭৯৭জন। অর্থাৎ গত এক বছরেই গ্রাহক হয়েছেন ১৪ লাখ ৩৭ হাজার ৮৫৮ জন, যা আগের সময়ের প্রায় দ্বিগুণ। এদিকে, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকদের জমার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে এই জমার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই এক বছরে জমার পরিমাও ছিল আগের প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি।

আউটলেটে ব্যাংক এশিয়া, অ্যাকাউন্টে এগিয়ে ডাচ-বাংলা

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ৭৪৮টি আউটলেট রয়েছে ব্যাংক এশিয়ার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ  ২ হাজার ৭১৫ আউটলেট ডাচ-বাংলা ব্যাংকের। এছাড়া এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৫৬৩টি, ইসলামী ব্যাংকের ৩৪৯টি, মধুমতি ব্যাংকের ৩১৪টি, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ২১৭টি ও অগ্রণী ব্যাংকের ২০০টি আউটলেট রয়েছে।

তবে অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে ডাচ-বাংলা ব্যাংক। এই ব্যাংকে হিসাব সংখ্যা ১৩ লাখ ৬৩ হাজার ৭২১টি। অন্যদিকে, সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ২৪ কোটি টাকা জমা আছে আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে। এছাড়া ডাচ-বাংলা ব্যাংকে ৯৫৫ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়ায় ৭৫৩ কোটি টাকা ও ইসলামী ব্যাংকে এজেন্ট ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে জমার পরিমাণ ৪৯৩ কোটি টাকা।

বেড়েছে ঋণ বিতরণ

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ২১০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। আগের বছর একই সময়ে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১২২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঋণ বিতরণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে এই একবছরে।

জানা গেছে, ১৯টি ব্যাংকের মধ্যে ছয়টি ব্যাংক ঋণ বিতরণ শুরু করেছে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। এর মধ্যে ১৯২ কোটি টাকাই দিয়েছে ব্যাংক এশিয়া। এছাড়া সিটি ব্যাংক ৯ কোটি টাকা, আল আরাফাহ পাঁচ কোটি টাকা, ডাচ-বাংলা দুই কোটি টাকা ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক এক কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।

রেমিট্যান্স এসেছে ৩ গুণ

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ গত একবছরে বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ৭ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। আগের বছরের মার্চে এর পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। এই একবছরের ব্যবধানে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১৬৮ শতাংশ।

রেমিট্যান্সের দিক থেকে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে শীর্ষে রয়েছে ডাচ-বাংলা ব্যাংক। এই ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স বিতরণ হয়েছে ২ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংক এশিয়ার এজেন্টরা ২ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা, আল আরাফাহ ব্যাংকের এজেন্ট ১ হাজার ৫৬ কোটি টাকা, ইসলামী ব্যাংকের এজেন্টরা ৬৪৮ কোটি টাকা ও অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্টরা ৩৭০ কোটি টাকা রেমিট্যান্স বিতরণ করেছে।

এজেন্ট ব্যাংকিং ঘিরে ব্যাংকগুলোর পরিকল্পনা

ডাচ-বাংলা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ডাচ-বাংলা ব্যাংক একমাত্র ব্যাংক যারা পরিবেশকভিত্তিক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি বছর তাদের আরও ১৫০০ থেকে ২০০০ আউটলেট খোলার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।

এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশব্যাপী ব্যাংকের ১৮৫টি শাখা, ৭৭টি এজেন্ট ব্যাংকিং অফিস ও ৯৫০টির বেশি ফাস্ট ট্র্যাক থেকে ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে ডাচ-বাংলা ব্যাংক। এছাড়াও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের গ্রাহকরা সেবা পাচ্ছেন ৫ হাজার এটিএম বুথের মাধ্যমেও।

এদিকে, চলতি বছরের মধ্যেই নন রেসিডেন্সিয়াল বাংলাদেশি (এনআরবি) ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের জন্য সারাদেশে আরও ৩০০টি আউটলেট খুলবে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির হেড অব এজেন্ট ব্যাংকিং ও ফরেন রেমিট্যান্স বিভাগের প্রধান মিল্টন রায়। তিনি বলেন, এনআরবি ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা বন্ধু নামে ২০১৮ সালের ৬ মে উদ্বোধন করা হয়। ‘দুঃসময়-সুসময় বন্ধু সবসময়’ স্লোগানের এই সেবা কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই ব্যাপক সাড়া মিলছে। এ পর্যন্ত সারাদেশে আমরা ১১৪টি আউটলেট খুলতে পেরেছি। এ বছরের মধ্যে আরও ৩০০টি আউটলেট খোলার পরিকল্পনা রয়েছে।

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মামুন-উর রশিদ বলেন, আমরা বলছি ‘সবার জন্য ব্যাংক’। এটাই আমাদের স্লোগান। এর অর্থ, সবাই যেন ব্যাংকে আসতে পারে। যেসব জায়গায় ব্যাংকের নেটওয়ার্ক নেই, সেসব জায়গার মানুষ আগে ব্যাংকিং সেবা নিতে পারত না। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এখন তাদের কাছেও ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে যাচ্ছে।

মামুন-উর রশিদ বলেন, আমাদের কনভেনশনাল ব্যাংক তো আছেই। পাশাপাশি এটিএম, এজেন্ট ব্যাংকিং, পজ (পয়েন্ট অব সেল) মেশিন আমরা স্থাপন করছি। এভাবে আমরা সব মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিচ্ছি।

ব্যাংক এশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আরফান আলী বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার জন্য এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করা হয়েছে। মানুষের দোরগোড়ায় সেবা দেওয়ার কারণে এই সেবার দ্রুত পসার হচ্ছে। আমরা আমানত সংগ্রহের পাশাপাশি ঋণ বিতরণ করছি। ভবিষ্যতে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবাকে ব্যাপক প্রসারের সুযোগ রয়েছে।

সারাবাংলা/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন