বিজ্ঞাপন

প্রকাশ্যে ‘শ্রমিক নেতা’, আড়ালে চোরের ‘গডফাদার’

August 29, 2019 | 5:16 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থেকে পুলিশ মো. সোহেল প্রকাশ সেলু নামে এক যুবককে কোতোয়ালী থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেফতার সোহেল চট্টগ্রাম নগরীতে সক্রিয় একটি চোরের দলের ‘গডফাদার’। নিজেকে শ্রমিক লীগ নেতা পরিচয় দিয়ে গত ৬ বছর ধরে সোহেল এই অপকর্ম করে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (২৮ আগস্ট) গভীর রাতে নগরীর বাকলিয়ার বগারবিল এলাকা থেকে সোহেলকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন।

গ্রেফতার সোহেল প্রকাশ সেলু (৩১) কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার ধন্যারপাড়ের মৃত মোহন মাঝির ছেলে। থাকেন চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানার শান্তিনগর বগারবিলে ইসলাম ভিলায়।

ওসি মহসীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘নগরীর কোতোয়ালী থানা এলাকায় বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত কয়েকটি চুরির ঘটনায় গত ২১ আগস্ট আনোয়ার প্রকাশ মালিঙ্গা নামে এক তরুণকে গ্রেফতার করি। সে একজন পেশাদার চোর। তাকে আমরা রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে তাদের গডফাদার হিসেবে সোহেলের তথ্য দেয়। পরে আমরা সোহেলকেও গ্রেফতার করেছি। জিজ্ঞাসাবাদে সোহেল চকবাজার-বাকলিয়া এলাকায় প্রভাবশালী বিভিন্ন ব্যক্তি তাকে শেল্টার দেয় বলে তথ্য দিয়েছে। আমরা এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করছি।’

বিজ্ঞাপন

ওসি জানান, ভাঙারি (কুড়িয়ে পাওয়া পরিত্যক্ত মালামাল) দোকানদার সোহেলের ছত্রছায়ায় ৮ থেকে ১০ জন শিশু ও কিশোর-তরুণ আছে। তারা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় চুরি করে চোরাই মালামাল সোহেলকে দেয়। সোহেল সেগুলো বিক্রি করে। সোহেল এই ছেলেগুলোকে নিয়মিত ইয়াবা সেবনের টাকা দেয়। ইয়াবা খাইয়ে তাদের দিয়ে চুরি করায়। গ্রেফতার আনোয়ার মালিঙ্গা পাইপ বেয়ে ১০ তলা ভবনেও উঠতে পারে। বাসার জানালা খোলা পেলে গ্রিল কেটে ভেতরে ঢুকে ল্যাপটপ, মোবাইল, টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, পোশাক পেলে সেগুলো নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।

সোহেলের কাছ থেকে ল্যাপটপ, স্বর্ণালঙ্কারসহ বিভিন্ন চোরাই মালামাল এবং একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওসি মহসীন।

বিজ্ঞাপন

কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান সারাবাংলাকে জানান, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি নগরীর কোতোয়ালী থানার আন্দরকিল্লায় কে বি অর্কিড প্লাজার নবম তলায় চট্টগ্রামের পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জান্নাতুল ফেরদৌস চৌধুরীর বাসায় চুরি হয়। বাসার বারান্দার গ্রীল কেটে চুরি হয়েছে বলে অভিযোগ করে কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা দায়ের হয়।

গত ১৯ জুন নগরীর সার্সন রোডে জনৈক এঞ্জেলিনা গোমেজের বাসায়, ৯ আগস্ট চট্টেশ্বরী মোড়ে জনৈক আব্দুল হামিদ সওদাগরের বাসায়, ৯ আগস্ট থেকে ১৪ আগস্টের মধ্যে কাজীর দেউড়ির সানমার এলিভেরা বিল্ডিংয়ে জনৈক মো. আব্দুল্লাহর বাসায়, ১৬ আগস্ট সিরাজউদ্দৌলা রোডে জনৈক রুহুল আমীনের বাসায় চুরি হয়।

কামরুজ্জামান বলেন, ‘প্রতিটি চুরি করেছে সোহেলের ছত্রছায়ায় থাকা চোরেরা। আনোয়ার মালিঙ্গা, মাসুদ আলি, শাকিল প্রকাশ রেন্ডি, হৃদয়সহ কমপক্ষে ১০ জন শিশু-কিশোর আছে, যারা কুড়িয়ে পাওয়া পরিত্যক্ত জিনিস তার দোকানে বিক্রি করে। সোহেল নিজেই ফুসলিয়ে এসব শিশু-কিশোরকে চোর বানিয়েছে। সোহেল তাদের টাকা দেয়, সেই টাকা দিয়ে তারা ইয়াবা সেবন করে। কখনো কারও হাতে টাকা না থাকলে সোহেল তাকে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করে। পরে তারা যখন চুরির মালামাল বিক্রি করতে আসে, তখন সেখান থেকে টাকা কেটে নেয়। গত ৬ বছর ধরে সোহেল এভাবে নগরীর বিভিন্নস্থানে চুরি সংঘটিত করে আসছে।’

চুরির মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ পরিদর্শক কামরুজ্জামান।

বিজ্ঞাপন

কোতোয়ালী থানা থেকে আদালতে নেওয়ার পথে সোহেলের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার। সোহেল জানায়, তার জন্ম বাকলিয়ার বগারবিল এলাকায়। প্রথমে সে দর্জি শ্রমিক হিসেবে কাজ করত। ছয়বছর আগে সে একটি কুড়িয়া পাওয়া পরিত্যক্ত মালামাল কেনার (ভাঙারি) দোকান দেয়। তিনবছর আগে দোকানটি সে ছোট ভাইকে দিয়ে দেয়। এখন বগারবিল এলাকায় নিজে শ্রমিক লীগের অফিস খুলে বসেছে। ওই অফিস ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা দিয়ে ঘেরা বলে সোহেল জানায়।

সোহেল আরও জানায়, উঠতি বয়সে সে এলাকায় রানা নামে কথিত এক যুবলীগ নেতার সঙ্গে থাকত। এ সময় নিয়মিত মারামারি-চাঁদাবাজির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ৭টি মামলা দায়ের হয়। এলাকায় সবাই তাকে ভয় পেত।

২১ আগস্ট গ্রেফতারের পর আনোয়ার মালিঙ্গা সারাবাংলাকে জানিয়েছিল, ছোটবেলা থেকে সোহেলকে চিনলেও ভয়ে কোনোদিন তার সঙ্গে কথা বলত না। সোহেল সবসময় এলাকায় মারামারি করে। তাকে সবাই বড় নেতা হিসেবে জানে। ৬ বছর আগে তার দোকানে কুড়িয়ে পাওয়া মালামাল বিক্রি করতে গিয়ে সোহেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। এরপর সোহেলের পরামর্শে সে চুরি শুরু করে।

সোহেল জানায়, ২০১২ সালে সে এলাকায় নিজেকে শ্রমিক লীগের নেতা হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করে। বাকলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী শফিকুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম মহানগর শ্রমিক লীগের সভাপতি বখতেয়ার উদ্দিন খানকে সে নিজের নেতা হিসেবে দাবি করেছে। নিজেকে ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ড শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বলেও দাবি করেছে সোহেল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক এটলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডে আমাদের কোনো বৈধ কমিটি নেই। সভাপতি বখতেয়ার উদ্দিন খান একটি কমিটি দিয়েছেন, যেখানে সোহেল নামে এই যুবক সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে সম্ভবত আছে। আমি পাল্টা আরেকটি কমিটি দিয়েছি।’

শ্রমিক লীগের পরিচয়ের পাশাপাশি চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে যুবলীগ নেতা আমজাদ হোসেন ‘বড় ভাই’ হিসেবে আশ্রয়-প্রশয় দেয় বলে জানিয়েছে সোহেল।

সোহেলের দাবি, সে মূলত চোরাই মালামাল কেনে এবং বিক্রি করে। আমজাদের আশ্রয়-প্রশয় পাবার জন্য তাকে প্রতিদিন এক হাজার টাকা করে দিতে হয়। আমজাদ পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মাসুদ করিম টিটু’র অনুসারী।

গত জুলাইয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়ে হেরেছেন মাসুদ করিম টিটু। ওই নির্বাচনে সোহেল টিটুর পক্ষে কাজ করেছে বলে দাবি করেছে।

জানতে চাইলে মাসুদ করিম টিটু সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনের সময় সোহেল আমার জন্য কাজ করেছে। আমার কাছে কয়েকবার এসেছে। তবে আমার সঙ্গে তার কোনো ঘনিষ্ঠতা নেই। বাকলিয়া এমন এলাকা, সকালে একজনের সঙ্গে রাজনীতি করলে, বিকেলে করে আরেকজনের সঙ্গে। কে কার গ্রুপে সেটা বোঝা যায় না।’

সারাবাংলা/আরডি/একে

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন