বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রার কথা জাতিসংঘকে জানালেন প্রধানমন্ত্রী

September 28, 2019 | 7:05 am

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ এখন প্রায়ই ‘উন্নয়নের বিষ্ময়’ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে নানা অস্থিরতা এবং বিশ্বব্যাপী ক্রমাগত আর্থিক মন্দা স্বত্বেও বাংলাদেশ গত ১০ বছর ধরে সমৃদ্ধি বজায় রেখেছে। স্পেকটেটর ইনডেক্স ২০১৯ অনুযায়ী, গত ১০ বছরে মোট ২৬টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ। এ সময়ে বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী মোট দেশজ উৎপাদনের ব্যাপ্তি ঘটেছে ১৮৮ শতাংশ। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপি’র আকার ছিল ১০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বেড়ে চলতি বছরে দাঁড়িয়েছে ৩০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।

বিজ্ঞাপন

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে এসব কথা বলেন শেখ হাসিনা। নিউইয়র্ক স্থানীয় সময় শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৬টা ২৮ মিনিটে, বাংলাদেশ স্থানীয় সময় শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) ভোর ৪টা ২৮ মিনিটে তিনি এই বক্তব্য দেন।

বাংলায় দেওয়া ভাষণে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে তার সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ বিভিন্ন খাতে কী উন্নয়ন করেছে তারও বর্ণনা দেন। তার ভাষণে উঠে আসে রোহিঙ্গা সংকট ও এর সমাধানের কথাও।
শুরুতেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনের সভাপতি নাইজেরিয়ার তিজ্জানি মোহাম্মদ-বান্ডেকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। গতিশীল নেতৃত্বের জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকেও ধন্যবাদ জানান।

শেখ হাসিনা বলেন, দ্রুত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তার সরকার নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া উন্নয়ন কৌশল হিসেবে দারিদ্র্য দূরীকরণ, টেকসই প্রবৃদ্ধি, পরিবেশ সুরক্ষা, মানবসম্পদ উন্নয়নের মত বিষয়ের ওপর মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘গত ১০ বছর ধরে আমরা প্রগতিশীল ও সময়পোযোগী নীতি ও কার্যক্রম গ্রহণ করে আসছি যা আমাদের এনে দিয়েছে অসামান্য সাফল্য। আমাদের রফতানি আয় ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তুলনায় তিন গুণ বেড়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হয়েছে ৪০.৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মাথাপিছু আয় সাড়ে তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৯০৯ মার্কিন ডলার হয়েছে। গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮.১৩ শতাংশ। ২০০৫-০৬ হতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মধ্যে আমাদের বিনিয়োগ জিডিপি’র ২৬ শতাংশ হতে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগ ৫ গুণ বেড়ে হয়েছে ৭০ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৯ গুণ বেড়ে হয়েছে ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।’

বিজ্ঞাপন

বক্তব্যের শুরুতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করেন তার মেয়ে শেখ হাসিনা। ১৯৭৪ সালে এই পরিষদে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কিছু অংশও উদ্ধৃত করেন তিনি।

অধিবেশনের সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বাস্তবায়নে আমাদের যে অঙ্গীকার ও যৌথ আকাঙ্ক্ষা তারই প্রতিফলন ঘটেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যা আমাদের জনগণের আস্থা অর্জনে সাহায্য করেছে এবং আমরা টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছি। আমাদের ২১ দফার রাজনৈতিক অঙ্গীকার মূলত জনগণের কল্যাণের নিমিত্ত গৃহীত অঙ্গীকার।’

এসময় তিনি বলেন, ‘দ্রুততম সময়ে দারিদ্র্য হ্রাসকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। ২০০৬ সালে আমাদের দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ যা ২০১৮ সালে হ্রাস পেয়ে হয়েছে ২১ শতাংশ এবং অতি দারিদ্র্যের হার ২৪ শতাংশ হতে ১১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশকে পেছনে ফেলে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪তম।’

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন কৌশল কী তাও জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা, শোভন কর্ম পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বৈষম্য দূরীকরণই এই কৌশল। বর্তমান সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনিতে সমাজের অনগ্রসর ও অরক্ষিত অংশের প্রতি বিশেষ নজর দিয়েছে। অর্থ, খাদ্য, কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ, সঞ্চয় ও সমবায়-এর মাধ্যমে এই সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। জিডিপি’র ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচিতে ব্যয় করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

নারী-পুরুষ সমতা এবং বিদ্যালয়ে শতভাগ ভর্তির মাইলফলক অর্জনের পর বাংলাদেশ এখন মানসম্মত শিক্ষার প্রসারে মনোনিবেশ করেছে বলে জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এখন বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার ৫০ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশে নেমেছে।

দেশের সকল নাগরিককে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে প্রায় ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের একটি বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এসব কেন্দ্র থেকে গ্রামীণ জনগণকে বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ এবং স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। সেবাগ্রহীতাদের ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু। এসব কর্মসূচির ফলে মাতৃমৃত্যুর হার, নবজাতক ও শিশু মৃত্যুহার, পুষ্টিহীনতা, খর্বকায়তা ও ওজনহীনতার মতো সমস্যাসমূহ ক্রমাগত কমছে।’

প্রতিবন্ধী, অটিজম ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সম্পৃক্ত করার বিষয়টিকে তার সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমানে এ ধরনের প্রায় ১৬ লাখ ৪৫ হাজার ব্যক্তি নিয়মিত সরকারি ভাতা পাচ্ছেন।’
ভাষণে প্রযুক্তি সেবা, ডিজিটাল সেন্টার, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, ব্লু ইকোনোমি, সমুদ্রসীমা, সামৃদ্রিক জীববৈচিত্র রক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মূলনীতিকে উপজীব্য করে আমরা রূপপুরে আমাদের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছি। ইতোমধ্যে ৯৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের প্রতি অঙ্গীকার মূলত পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থানেরই বলিষ্ঠ প্রতিফলন।’

বাংলাদেশ নিরাপদ, সুষ্ঠু ও নিয়মিত অভিবাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘অনিয়মিত অভিবাসন ও মানবপাচার একটি বৈশ্বিক সমস্যা। যার মূলে রয়েছে জটিল ও সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্র। জাতীয় পর্যায়ে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন এবং মানবপাচার সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সম্প্রতি আমরা মানবপাচার বিষয়ক ‘পালেরমো প্রোটোকল’-এ যোগদান করেছি।’

জাতিসংঘ মহাসচিব কর্তৃক বিশেষত জাতিসংঘ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে গৃহীত সংস্কার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা আশা করছি নতুন প্রজন্মের জাতিসংঘ কান্ট্রি টিম এবং নতুনরূপে সজ্জিত জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারী ব্যবস্থার দ্বারা জাতিসংঘ স্বাগতিক রাষ্ট্রের জাতীয় অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংশ্লিষ্ট দেশের উন্নয়ন ও শান্তি প্রক্রিয়ায় আরও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি বহুপাক্ষিকতাবাদ বৈশ্বিক সমস্যা সমাধান এবং সর্বজনীন মঙ্গলের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। বিশ্বে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জাতিসংঘই আমাদের সকল আশা-আকাক্ষার প্রতীক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এই আশাই ব্যক্ত করেছিলেন।’
একটি শক্তিশালী বহুপাক্ষিক ফোরাম হিসেবে জাতিসংঘের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন সর্বদা অব্যাহত থাকবে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা এর সংগঠন এবং সনদে বর্ণিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সদা প্রস্তুত থাকব।’

সারাবাংলা/এনআর/এসএমএন/এসএস

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন