বিজ্ঞাপন

‘সব গেছে-কেবল বাচ্চাটাকে নিয়ে বেঁচে আছি’

February 15, 2018 | 8:33 am

জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: শরীয়তপুরের চন্দ্রপাড়া গ্রামের পারুল বেগমের একটাই ছেলে লাবিব। বয়স চার বছর তিন মাস। তিন বছর আগে লাবিবের ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। তারপর থেকেই নিজের বাড়ি ছাড়ে পারুল। বর্তমানে লালবাগের শহীদ নগরে চাচির সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকার এক রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছে। ছেলের চিকিৎসার জন্যই পারুল ঘর ছাড়ে।

গতকাল বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগের সামনে কথা হয় পারুল বেগমের সঙ্গে। সেখানেই পারুল বলেন ছেলেকে নিয়ে তার সংগ্রামের কথা।

নিজের ওড়না দিয়ে ছেলের মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে তিনি বলেন, জীবনটা একটা দুঃখের নদী হয়ে গেছে, কূল-কিনারা পাচ্ছি না। তাও এই ছেলেকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি, একটাই আশা-ছেলেটাকে যদি বাঁচাতে পারি।

বিজ্ঞাপন

পারুল জানান, স্বামী রুমান পালিয়ে ইটালি গিয়েছে। তারপর থেকেই সেখানে পুলিশের কাছে রয়েছে, বের হতেও পারেনি বলে কাজও করতে পারে না। তাই শ্বশুর বাড়ি আর বাবার বাড়ি থেকে যতোটুকু নিজের পাওনা ছিল সেটুকু প্রথমে বিক্রি করে, পরে আত্মীয় স্বজনের থেকে ধার করে ছেলের চিকিৎসা চালাচ্ছে। ঢাকায় থাকা-খাওয়া-হাসপাতালে যাতায়াত আর চিকিৎসা খরচ বাবদ এ পর্যন্ত গত এক বছর তিন মাসে খরচ হয়ে গেছে প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা। ধারের টাকা দেওয়াতো পরের কথা, এরপরে চিকিৎসা খরচ চালাবেন কীভাবে সেটাই এখন তার ভাবনা।

বিজ্ঞাপন

একই অবস্থা চট্রগ্রামের মিতালী সাহার। ৯ বছরের মেয়ে পড়শী সাহাকে নিয়ে তিনিও এসেছেন অনকোলজি বিভাগে। বিভাগের সামনের জায়গায় সিড়ির পাশের মেঝেতে মাদুর পেতে বসেছিলেন মেয়েকে নিয়ে মিতালী।

মিতালী সাহা বলেন, সাড়ে ছয় বছর বয়সে লিউকোমিয়া ধরা পরে মেয়ের। তারপর চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজ হয়ে এই হাসপাতাল। এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকার বেশি। আর মেয়ের সঙ্গে ঢাকায় যাতায়াত, হাসপাতালে ভর্তির সময়ে মেয়ের সঙ্গে থাকতে গিয়ে চাকরিতে অনিয়ম হবার কারণে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিও হারাতে হয়েছে পড়শীর বাবাকে। এখন ধার করে, মায়ের গয়না বেঁচে চিকিৎসা চলছে পড়শীর।

মিতালী বলেন, এভাবে চলতে কষ্ট হচ্ছে-কিন্তু কী করার আছে। এই কপাল নিয়েই এসছি-সেটাতো আর খন্ডানো যাবে না। কেবল লাবিব আর পড়শী নয়, কথা হয় শিহাব, নিয়ন, শৈলীর মায়ের সঙ্গেও। সবারই এক কথা। আমাদের সবার গল্প একই রকম, এখানে সুখের কিছু নেই-সবই কষ্টের দিনলিপি, প্রতিটি পরিবারের একই গল্প।

বিজ্ঞাপন

আজ(১৫ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ব শিশু ক্যান্সার দিবস। বাংলাদেশে ১৪ থেকে ১৫ লাখ শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত। সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশের ক্যান্সার চিকিৎসা কেবলমাত্র শহর কেন্দ্রিক হওয়াতে বিশেষ করে রাজধানী কেন্দ্রিক হওয়ায় এসব পরিবারগুলো আর্থিক ভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কেবলমাত্র একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশু রোগীর জন্য কমপক্ষে খরচ হয় সাড়ে ৪ থেকে ৭ লাখ টাকা। এই টাকাটা কেবলমাত্র চিকিৎসার খরচ। এর সঙ্গে অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচতো রয়েছেই।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান একেএম আমিরুল মোরশেদ খসরু সারাবাংলাকে বলেন, নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি খরচের কথা চিন্তা করে অনেক অভিভাবক হাসপাতালে আসেন না। মোট রোগী শনাক্ত হবার পর ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ রোগীর ‘ড্রপ আউট’ হয় কেবলমাত্র খরচের কারণে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অনকোলজির বিভাগের করা এক গবেষণার কথা জানিয়ে অধ্যাপক ডা. আমিরুল মোরশেদ বলেন, ২০১৩ সালের দিকে ক্যান্সার  আক্রান্ত রোগীদের খরচ নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, কেবলমাত্র চিকিৎসা খরচে চলে যায় ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। এই টাকাটা যাচ্ছে কেবলমাত্র যতো টাকার কেমো নিচ্ছে এবং হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ। ঢাকার বাইরে থেকে আসা, ঢাকায় থাকা-খাওয়ার খরচ এখানে বাদ দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, একটানা তিন বছর চিকিৎসা নিতে হয় একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর, ১৪৫ সপ্তাহ থেকে ১৯৫ সপ্তাহ পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে হয় একজন শিশুকে- এই যে খরচ সেটা বিশাল ব্যয় সাপেক্ষ বিষয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, এরপর যদি কোনও ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়, তখন তাদেরকে এন্টিবায়োটিক দিতে হয়, আর সেটি খুব হাই এন্টিবায়োটিক। একইসঙ্গে, যদি রক্তশূণ্যতা দেখা দেয় বা প্লাটিলেট কমে যায় তাহলে একবার প্লাটিলেট দিতে খরচ হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা-এই বিপুল পরিমান অর্থের যোগান দেওয়া বেশিরভাগ পরিবারের পক্ষে যোগান দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই যদি সার্পোট গ্রুপ তৈরি না করতে পারি তাহলে এভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না।

বাইরের চিকিৎসকরা আমাদের বলেন, সাপোর্ট গ্রুপ তৈরি করেন নয়তো সম্ভব না। দেশের বিত্তবানরা যদি এগিয়ে আসেন, ঢাকার বাইরে থেকে আসার রোগীদের জন্য একটি সেল্টার হোম তৈরি করে দেন, বিনা পয়সায় যদি তাদের চিকিৎসা সরঞ্জামাদি দেওয়া যায় তাহলেই কেবল দেশের অধিকাংশ দরিদ্র রোগীরা চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারবে-বলেন আমিরুল মোরশেদ।

অপরদিকে, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকীন বলেন, গবেষণা দেখা গেছে, ক্যান্সার শনাক্ত হবার এক বছরের মধ্যে ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পরে পরিবারগুলো। তাই, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ক্যান্সার স্কৃনিং ও সীমিত চিকিৎসা সেবা যুক্ত করতে হবে এবং ক্যান্সার রোগী ও একজন স্বজনের জন্য গণপরিবহনে বিনাভাড়ায় যাতায়াতের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

সারাবাংলা/জেএ/ এমএইচ

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন