বিজ্ঞাপন

ভরসা কেবল ক্যানসার ইনস্টিটিউট, রোগীর চাপে সেবা দিতে হিমশিম

February 4, 2020 | 11:15 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: গাজীপুর থেকে ৫২ বছর বয়সী মাকে নিয়ে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এসেছেন ছেলে জাভেদ আহমেদ। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে মাকে শুইয়ে রেখে ছেলে ১০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করলেন। কথা বলে জানা গেল, জাভেদের মায়ের ফুসফুসে ক্যানসার। সমস্যা আছে কিডনিতেও।

বিজ্ঞাপন

দুই দিন আগেও মাকে এই হাসপাতালে এনেছিলেন জাভেদ। তবে তার রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেশি থাকায় চিকিৎসকরা বলেছেন জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে যেতে। কিন্তু সেখানে চিকিৎসকরা বলে দিয়েছেন, ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা চারের নিচে নামানো তাদের পক্ষে সম্ভব না। এক্সরে রিপোর্টও ভালো না থাকায় ডায়ালাইসিস করা সম্ভব হয়নি। ক্যানসার ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক জানালেন, ক্রিয়েটিনিনের মাত্রায় ক্যানসারের চিকিৎসা অনেক ক্ষতিকর হতে পারে। আর তাই তিনি রোগী রেফার করে দিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। সেখানে তিনি রোগীকে এইচডিইউ ইউনিটে ভর্তি করে নেফ্রোলজি বিভাগের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার জন্যও লিখে দিয়েছেন।

আরও পড়ুন- আজ বিশ্ব ক্যানসার দিবস

একই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে স্ত্রীকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন ফরিদ উদ্দিন নামে একজন মাঝবয়সী লোক। বহির্বিভাগে চিকিৎসককে দেখাতে এসেছিলেন। কিন্তু দেরি করে ফেলায় আর পারেননি। জরুরি বিভাগের টিকেট কেটে চিকিৎসককে দেখাতে পারলেও বেড পাননি। কারণ জরুরি বিভাগে থাকা ১৪টি বেডের কোনোটিই খালি ছিল না।

বিজ্ঞাপন

হাসপাতালের তৃতীয় তলায় বহির্বিভাগ। সেখানে টিকেট কেটে চিকিৎসককে দেখাতে পারলেও ঝিনাইদহ থেকে আসা বজলুর রহমানকে যেসব পরীক্ষা করার জন্য বলা হয়েছে, সেগুলো করতে চার থেকে পাঁচ দিন লাগবে বলে জানালেন তার ছেলে হাফিজুর রহমান। কিন্তু ঢাকা শহরে তাদের থাকার কোনো জায়গা নেই। আর হাসপাতালেও অসুস্থ বাবাকে ভর্তি করাতে পারবেন না শয্যা ফাঁকা না থাকায়।

সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) এমন দৃশ্যই দেখা যায় জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের সামনে। সেখানে ভিড় করা রোগী ও স্বজনদের কারও চোখে-মুখে হতাশা, কেউ কেউ স্বজনকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন খুব দ্রুত বেড জোগাড় হয়ে যাবে— এমন আশার বাণী শুনিয়ে।

বিজ্ঞাপন

জরুরি বিভাগের প্রবেশপথের আগে হাসপাতালের গেটে ভেতরে ও বাইরে দেখা গেল অনেকে বসে আছেন মাদুর পেতে। পরদিন বহির্বিভাগের চিকিৎসকের সিরিয়াল আগে নিতে পারবেন— এমন আশাতেই তাদের এমন অবস্থান। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ক্যানসার আক্রান্ত স্বজনের সুস্থ হয়ে ওঠা নিয়ে তারা সবাই যতটা উদ্বিগ্ন, তার চাইতেও বেশি ভাবছেন আদৌ দ্রুত চিকিৎসা পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে। আর তাদের সবার বক্তব্য একই, নিজ নিজ এলাকায় ক্যানসারের যথাযথ চিকিৎসার সুযোগ থাকলে ঢাকায় ভিড় করে ভোগান্তিতে পড়তে হতো না।

আরও পড়ুন- ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে গাইডলাইন, যা হতে পারে সহায়

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. রাসেলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রায় প্রতিদিনই শতাধিক রোগী আসেন জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেই তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এখানে যেসব রোগী আসেন তাদের মধ্যে কারও কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষাই হয়নি। তারা তাদের সমস্যা নিয়ে আসেন। আবার কিছু রোগী তাদের নিজ নিজ এলাকায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ক্যানসার শনাক্ত হওয়ার পর এসেছেন চিকিৎসা নিতে। আরও এক ধরনের রোগী আছেন, যাদের এরই মধ্যে ক্যানসারের চিকিৎসা শুরু হয়েছে, কিন্তু ভর্তি হতে পারেননি। তাদের অনেকেরই কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপির তারিখ পড়েছে চার থেকে পাঁচ দিন পরে।

চিকিৎসায় দীর্ঘসূত্রিতা কেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. রাসেল সারাবাংলাকে বলেন, এখানে যে রোগীরা শুরুর দিকেই আসেন, তাদের আমরা কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাই। জানার চেষ্টা করি রোগটা কী পর্যায়ে আছে। থেরাপি নেওয়ার জন্য রোগীর শারীরিক সামর্থ্য কেমন, সেটাও দেখার বিষয়। এগুলো দেখার পর আমরা মেডিকেল বোর্ড করি। বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্ধারিত হয় চিকিৎসার ধরন।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা মূলত তিন ধরনের— সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি। কোনো কোনো রোগীর জন্য যেকোনো এক ধরনের চিকিৎসা প্রযোজন্য, কারও কারও ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় তিনটিই। পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট দেখে বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয়, কোন রোগীর ক্ষেত্রে কোন ধরনের চিকিৎসা প্রযোজ্য হবে। সেই সিদ্ধান্তের পর রোগীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নির্ধারিত বিভাগে। আর পুরো প্রক্রিয়ায় ন্যূনতম চার থেকে পাঁচ দিন সময় লাগেই।

জরুরি বিভাগের এই চিকিৎসক বলেন, ২০১৬ সালের পর থেকে আমাদের এখানে জরুরি বিভাগে আসার রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। এখন আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান ব্যক্তিরাও আসছেন চিকিৎসা নিতে। এখন আগের তুলনায় ডায়াগনোসিস অনেক বেশি হচ্ছে, কিন্তু একইসঙ্গে বেড়েছে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর পরিমাণও। ফলে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। আর তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রোগী ও স্বজনদের।

আরও পড়ুন- ঢামেক রেডিওথেরাপি বিভাগের বেহাল দশা, ভোগান্তিতে ক্যানসার রোগীরা

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের (আইএআরসি) হিসাবও বলছে, দেশে ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষের পরিমাণ নেহায়েত কম নয়। তাদের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর দেড় লাখ মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হন। আর এই রোগে মারা যান এক লাখ আট হাজার মানুষ। এই রোগীদের অনেকের চিকিৎসার জন্যই নেই পর্যাপ্ত সুবিধা।

রোগীদের ঢাকামুখী হয়ে পড়ার প্রবণতা নিয়ে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যানসার ইপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, আমাদের এখনো সরকারি পর্যায়ে বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে একটিমাত্র ভরসা, আর তা হলো ক্যানসার ইনস্টিটিউট। এখানে কেমোথেরাপির একটি তারিখ পেতে এক থেকে তিন সপ্তাহ সময়ও লেগে যায়। একই বিষয় ঘটে অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রেও। দেখা যায়, তাতে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগে। রেডিওথেরাপির জন্য একজন রোগী তারিখ পান তিন থেকে চার মাস পরে। এ কারণে সামর্থ্যবান অনেকেই দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। যতদিন পর্যন্ত আমরা বিভাগীয় পর্যায়ে ক্যানসারের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে না পারব, ততদিন পর্যন্ত এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী মোশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, কয়েকদিন আগেই আমি এখানে যোগ দিয়েছি। এরই মধ্যে রোগীদের জন্য আরও বেশি সেবার সুযোগ তৈরিতে কিছু পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছি। তবে দীর্ঘদিনের যেসব সমস্যা, সেগুলো চাইলেই রাতারাতি সমাধান করা সম্ভব নয়।

ডা. মোশতাক আরও বলেন, ক্যানসার রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি বিভাগীয় শহরে ১০০ শয্যার নতুন হাসপাতাল নির্মাণ হতে যাচ্ছে, যার প্রক্রিয়াও অনেক দূর এগিয়েছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে ক্যানসার সেবার পরিধি আরও বাড়বে। চিকিৎসাও মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছাবে।

ক্যানসার প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা

তবে কেবল চিকিৎসার সুযোগ তৈরি নয়, ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা মোকাবিলায় সচেতনতায় জোর দিতে চান ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, সারাবিশ্বে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা এখন বাড়ছে, বাংলাদেশেও বাড়ছে। সমাধান তখনই হবে যখন আমরা ক্যানসারের জন্য দায়ী ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’গুলো এড়িয়ে চলতে পারব। সাধারণ মানুষের কাছে সেই ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’গুলো তুলে ধরতে হবে।

ডা. রাসকিন বলেন, আন্তর্জাতিকভাবেই বলা হয়, তিন ভাগের একভাগ ক্যানসার প্রাথমিকভাবেই প্রতিরোধ করা যায়। আমরা একটি ক্যাম্পেইন শুরু করেছি, যেখানে বলা হচ্ছে— পাঁচটি ভালো জিনিস যদি আমরা গ্রহণ করি ও পাঁচটি খারাপ জিনিস যদি বর্জন করি, তবে ক্যানসার প্রাথমিকভাবেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। একইসঙ্গে সাতটি নিয়মও মেনে চলতে হবে। তামাক, অস্বাস্থ্যকর খাবার, ফাস্টফুড, অ্যালকোহল ও উচ্চ প্রোটিন— এগুলো ক্যানসারের কারণ হতে পারে। জাংক ফুড মুটিয়ে যাওয়ারও কারণ, যা থেকে স্তন ক্যানসারও হয়ে থাকে। এছাড়াও বাংলাদেশে এখনো বাল্যবিয়ের হার কম নয়, যা কোনোভাবেই স্বাস্থ্যকর নয় এবং জরায়ুমুখ ক্যানসারের ক্ষেত্রে যা অন্যতম ভূমিকা রাখে।

আরও পড়ুন- ক্যানসার প্রতিরোধে চিনির বিকল্প গুড়

ক্যানসার প্রতিরোধে ডা. রাসকিনের পরামর্শ, মাংসের পরিমাণ কমিয়ে শাকসবজির পরিমাণ বাড়ানো, সবখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, শিশুদের নিয়মিত টিকাদান এবং নিয়মিত পর্যাপ্ত কায়িক পরিশ্রম বা শরীর চর্চা— এই কয়েকটি বিষয় অনুসরণ করলে ক্যানসারকে অনেকটাই দূরে রাখা সম্ভব হবে। তবে সমাজের সব স্তরের মানুষের মধ্যে এরকম সচেতনতা ছড়িয়ে না দিতে পারলে কোনো পরিকল্পনাই কাজে আসবে না বলেও মনে করেন তিনি।

এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্বাস্থ্য কর্মসূচি নেওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসকদের পাঠ্যক্রমেও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন ডা. রাসকিন। তিনি বলেন, প্রাথমিক প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনে ভ্যাকসিনেশন থেকে শুরু করে সচেতনতা কর্মসূচি পালন করতে হবে। পাশাপাশি জনসাধারণের জন্য স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। আবার আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতেও একটি গলদ আছে। দেখা গেল, একজন ক্যানসার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য পড়ালেখা করছে। কিন্তু সে ক্যানসার ইপিওডিমলজি কিংবা প্রিভেন্টিভ অনকোলজি সম্পর্কে জানে না। আমাদের কারিকুলামের মধ্যেও তাই পাবলিক হেলথ, প্রিভেন্টিভ অনকোলজির মতো বিষয়গুলো রাখতে হবে। কারিকুলাম ঢেলে সাজাতে হবে। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লেভেল থেকেই বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ নিয়েও পড়ানো দরকার।

আরও পড়ুন- ক্যানসার রোধে ধুমপানকে না, ১৮’র নিচে নয় শারীরিক সম্পর্ক

এ সময় ক্যানসার রোগীদের জরিপের প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন ডা. রাসকিন। তিনি বলেন, যেকোনো দেশে ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পরিকল্পনা নিতে হলে ক্যানসারে আক্রান্তের হার, মৃত্যুহার, কারা কোন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে— এ সম্পর্কিত সঠিক পরিসংখ্যান প্রয়োজন। এর জন্য জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন চালু করতে হবে। ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলে সেবার পরিসর নির্ধারণ করা কঠিন। দেশে এখন ক্যানসারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে প্রতিরোধ কর্মসূচিতে। কিন্তু কী করলে, কীভাবে জীবনযাপন করলে মানুষের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমবে, সে সম্পর্কে কোনো কর্মসূচি নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এ খাতে তেমন বরাদ্দও নেই। অথচ এগুলো বেশি বেশি করে প্রচার করলে সচেতনতা বাড়বে। এর মাধ্যমে আক্রান্তের সংখ্যাও কমিয়ে আনা সম্ভব।

সারাবাংলা/এসবি/এমএইচ/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন