বিজ্ঞাপন

ত্রিপুরার লাল রাজত্বে গেরুয়ার কিস্তিমাত

March 3, 2018 | 5:06 pm

গত মাসের আঠারো তারিখ অনুষ্ঠিত ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনের এক্সিট পোল দেখেই অনুমান করা যাচ্ছিলো ত্রিপুরায় অবসান হতে যাচ্ছে পঁচিশ বছরের বাম জামানার, আসছে বিজেপি। সেই অনুমানের তীব্রতা বুঝানোর জন্যই কিনা দুদিন আগে হোলি উৎসবকে সামনে রেখে আগড়তলায় গেড়ুয়া আবিরের দাম হয়ে গেলো লাল আবিরের আড়াইগুণ। লাল আবিরের দাম যেখানে কিলোপ্রতি ৪০ টাকা ছিলো সেখানে গেরুয়ার আবির বিকিয়েছে ১০০ টাকারও বেশি দামে। অর্থাৎ সবকিছুই যেন সর্বান্তকরনে জানান দিচ্ছিলো ভারতের সিংহভাগ রাজ্যের মতো দেশটির উত্তর-পূর্বের ছোট ও পিছিয়ে থাকা রাজ্য ত্রিপুরাতেও এবার উড়বে মোদি-অমিত শাহ জুটির বিজয় নিশান।

বিজ্ঞাপন

হলোও তাই। ত্রিপুরা বিধানসভার ৬০ টি আসনের মাঝে নির্বাচন হওয়া ৫৯ টি আসনের দুই তৃতীয়াংশ আসন দখল করে নিলো বিজেপি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সহযোগী আইএফটিকে সাথে নিয়ে ৪০ টি আসন পকেটে পুড়েছে বিজেপি। দুই যুগেরও বেশি রাজ্যপাট সামলানো সিপিএমের ঝুলিতে এসেছে মাত্র ১৯ টি আসন। মোদীর আহবান মেনে নিয়ে মানিকের বদলে হীরেকেই বেছে নিয়েছে ত্রিপুরার জনগণ। স্বভাবতই উৎসবে উত্তাল ত্রিপুরার বিজেপি শিবির, চলছে উৎসবের প্রস্তুতি। এখন বুঝা গেলো কেন বেড়ে গিয়েছিলো গেরুয়া আবিরের দাম! এখন থেকে ত্রিপুরা যে সাজবে গেড়ুয়া রঙেই।

ত্রিপুরায় বিজেপির এই উত্থান রীতিমতো গবেষণার দাবি রাখে। এ যেন মর্ত্য থেকে এক লাফে স্বর্গ ছোঁয়া, মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে কোন এক স্লামডগের মিলিওনিয়ার হয়েও যাওয়া। দিল্লীতে আম-আদমি পার্টির সিনেমাটিক উত্থানের সাথেই কেবল এর তুলনা চলে। এর আগে ত্রিপুরায় বিজেপি একটি আসনেও কখনো জয় পায়নি। এমনকি এর আগে কখনো সবগুলো আসনে প্রার্থীও দিতে পারেনি তারা। বেশিদূর যাবার দরকার নেই। ২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের দিকেই একবার চোখ বুলানো যাক। ৬০ টি আসনের মাঝে সিপিএম জিতেছিলো ৫০ টি আসনে, কংগ্রেসের ভাগে ছিলো বাকি ১০ টি আসন। সেবার সাকুল্যে ৫০ টি আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছিলো বিজেপি। তাদের মাঝে ৪৯ প্রার্থীরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিলো। সেই রুগ্নদশা থেকে ২০১৯-এ এসে একেবারে হেভিওয়েট লিফট নিল বিজেপি।

প্রশ্ন হচ্ছে বিজেপি কিভাবে এই অসাধ্য সাধন করলো। মোটাদাগে বলতে গেলে অমিত শাহের নেতৃত্বাধীন বিজেপি পলিসি মেকারদের দূর্দান্ত ও আধুনিক নির্বাচনী পরিকল্পনা এবং প্রচারনার কাছেই মার খেয়ছে ট্র্যাডিশনাল ধারার ধারক সিপিএম। সিপিএমের নির্বাচনী শ্লোগান ছিলো ‘ত্রিপুরা একসাথে ছিলো, একসাথে আছে, একসাথে থাকবে।’ স্বভাতই এই শ্লোগানের মাঝে নতুন কিছু পায়নি ত্রিপুরার জনগণ। তাই তো তারা বিজেপির নির্বাচনী শ্লোগান ‘চলো পাল্টাই’কে ধারন করে পালটে দিলো মানিক সরকারের গদি। নির্বাচনী প্রচার দেখেই বুঝা গিয়েছিলো বিজেপি ত্রিপুরার নির্বাচনকে দারুন গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। প্রতিটি বুথকেন্দ্রিক কমিটি গঠন করে নির্বাচনী প্রচারনা চালিয়েছে তারা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে অমিত শাহ, অরুণ জেটলি, নিতিন গড়করি, রাজনাথ সিং, কে আসেনি বিজেপির নির্বাচনী প্রচারণায়। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগি আদিত্যনাথ থেকে শুরু করে দেশটির অন্যান্য অঞ্চলের বিজেপি নেতারাও ফেসবুক, টুইটার সহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারনা চালিয়েছেন। বিজেপির এই অল আউট এটাকের কোন জবাব ছিলো না সিপিএমের কাছে।

বিজ্ঞাপন

সাফল্যের একক কৃতিত্ব যে বিজেপির ঘটে যাবে ব্যাপরটাও এমনও না। বরং সিপিএমের ব্যর্থতাও এর জন্য অনেকাংশেই দায়ী। বলা যায় বিজেপি পরিস্থিতির সর্বোচ্চ সদ্বব্যবহার করেছে। কান পাতলেই সিপিএমের বিরুদ্ধে ত্রিপুরার জনগনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের আওয়াজ পাওয়া যায়। সদ্য সাবেক সিপিএম মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার নিপাট ভদ্রলোক, সৎ ও সজ্জন ব্যাক্তি। সিপিএমের অনেক নেতার ক্ষেত্রেও এই কথা বলা যায়। তাদের দিকে তাকিয়েই বারবার ত্রিপুরার জনগণ রাজ্যের শাসনভার তুলে দিয়েছে সিপিএমের হাতে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের ভরাডুবির পরেও ত্রিপুরার জনগণ আস্থা রেখেছে সিপিএমে। তাদের সেই আস্থার প্রতিদান দিতে পারেনি সিপিএম। সুদীর্ঘ ২৫ বছরের বাম জামানায় ত্রিপুরার জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সম্মেলন ঘটেছে খুব কমই। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি রাজ্যের অধিকাংশ জায়গায়। বাম রাজনীতির চিরায়ত প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মানসিকতা এই ক্ষেত্রে অনেকাংশেই দায়ী। মানুষজন তাই পরিবর্তনের পথে হেঁটেছে। নতুন শাসকগোষ্ঠীকে পরখ করতে চাচ্ছে। বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত সবার জন্য স্মার্টফোন কিংবা প্রতিটি পরিবারের অন্তত একজন সদস্যের চাকরি দেয়ার আশ্বাস ত্রিপুরার তরুণ প্রজন্মকে অনেকবেশি আকৃষ্ট করেছে। তাই তারা দুহাত ভরে ভোট দিয়েছে পদ্মফুল প্রতীকে। সময়ই উত্তর দিবে ত্রিপুরার জনগণের প্রত্যাশা কতটুকু পূরন করতে পারে বিজেপি।

ত্রিপুরায় সিপিএমের পতনের মধ্য দিয়ে গোটা ভারতবর্ষে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা শেষ বাম প্রদীপটিও নিভে গেলো। সময় এখন বাম রাজনীতির নীতি নির্ধারকদের আত্মজিজ্ঞাসার, আত্মসমালোচনার। শুদ্ধবাদী তাত্ত্বিকতার লেবাশ ছেড়ে তাদেরকে সাধারনের কাতারে এসে জনগণের সুরে কথা বলতে শিখতে হবে। কেন অপেক্ষাকৃত সৎভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করার পরেও জনগণ মুখ ফিরিয়ে নিলো সেই প্রশ্নের উত্তর তাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে। অন্যথায় সুদীর্ঘ ৩৪ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করার পরেও পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম এর যে দীর্ঘস্থায়ী ভগ্নদশা হয়েছে ত্রিপুরার সিপিএমকেও সেই পরিণতিই বরন করতে হবে।
ত্রিপুরা হতে যাচ্ছে ভারতের বিশতম অঙ্গরাজ্য যেখানে বিজেপি এককভাবে কিংবা জোটগত ভাবে সরকারে আছে। এ পরিসংখ্যান থেকেই বুঝা যাচ্ছে বিজেপির সর্বভারতীয় শক্তিশালী রুপ। ভারতের ইতিহাসে আর কখনো একক কোন দলের এমন সুসংহত প্রভাবশালী অবস্থান দেখা যায়নি। ভারতের রাজনীতিরই এ এক নতুন মেরুকরণ। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি জয়ী হতে পারলে ভারতের অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করাই কঠিন হয়ে যাবে। কংগ্রেসসহ ভারতের অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলকে তাই এখন থেকেই আটঘাট বেঁধে নেমে পড়তে হবে রাজনীতির মাঠে। তাদেরকে যে মোকাবেলা করতে হবে মোদী- অমিত শাহর জুটির নেতৃত্বাধীন সর্বগ্রাসী বিজেপির।

লেখক: সাবেক ছাত্রলীগ নেতা
[এই কলামে উপস্থাপিত মতামত সম্পূর্ণভাবে লেখকের নিজস্ব]

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন