বিজ্ঞাপন

অচেনা এক ভিন্ন ঈদ  

May 24, 2020 | 10:34 am

এবার স্বাভাবিক কারণেই ঈদের চিরচেনা রূপ কিছুটা ভিন্ন। আনন্দ, দুঃখ, কষ্ট, আতংক, অনিশ্চয়তা সব কিছু মিলিয়ে অপরিচিত এক ঈদ উদযাপন করতে চলেছি আমরা। অনেকেই বাড়ি-ঘর, পরিবার-পরিজন ছেড়ে আবার কাছাকাছি থেকেও এক অনিবার্য দূরত্ব মেনে পালন করবেন এবারের ঈদ।  ঈদের সার্বজনীন চরিত্র হারানোর এই অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে নতুন। করোনা ভাইরাসের প্রভাবে জনজীবন এমনিতেই অনেকটা দূর্ভোগে। এর মধ্যে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সাইক্লোন আম্পানের আঘাত মানুষকে করেছে বিপদাপন্ন। ঈদ পালনের আনুষ্ঠানিকতা তাই অনেকটাই ফিকে এবার।

বিজ্ঞাপন

রোজার ঈদের চিরন্তন শিক্ষা হচ্ছে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা এবং ধনী গরিব ভেদাভেদ ভুলে সার্বজনীন আনন্দ উৎসবে মিলিত হওয়া। ঈদের নামাজের পর পরিবারের সকলে একত্রিত হওয়া, একে অন্যের বাড়িতে যাওয়া, খাওয়াদাওয়া করা, ঘুরে বেড়ানো, প্রতিবেশী-পরিচিতজনের সঙ্গে আনন্দে সময় কাটানো, উপহার বিনিময় করা এসবই ঈদের আনুষ্ঠানিকতা। এছাড়া ঈদের দিনে মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে, সালাম করে দোয়া নেওয়া, মৃত আত্মীয়স্বজনের কবর জিয়ারতের মত ধর্মীয় ও সামাজিক আচারও রয়েছে। এবারের ঈদে এই সমস্ত আনুষ্ঠানিকতায় দেখা দিতে পারে কিছু ভিন্নতা। করোনা শনাক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং সরকারী বিধিনিষেধ থাকায় সামাজিক মেলামেশায় এক ধরনের অনাগ্রহ এবং আতঙ্ক কাজ করবে। এছাড়া করোনা আক্রান্ত পরিবারগুলোর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং করোনায় আপনজন হারানো মানুষের আহাজারিতে ঈদের আনন্দ অনেকটাই ম্লান।

সমাজের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবার গুলোতে হয়তো উদযাপিত হবে ঈদের ঘরোয়া উৎসব। আনন্দ আয়োজনের স্বাভাবিক রূপও হয়তো দেখা যাবে কোথাও কোথাও। কিছু সব ছাপিয়ে কানে বাজবে বেতন না পাওয়া, বোনাস না পাওয়া চাকুরিজীবি, গার্মেন্টসকর্মী, কর্মহীন শ্রমিক, দিন মজুর আর নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষের চাপা কান্না।

এবারের ঈদের সামগ্রিক আয়োজন এবং প্রস্তুতি শুরু থেকেই একটু আলাদা। অন্য যেকোন সময়ের থেকে ঈদ কেন্দ্রিক কেনাকাটার প্রবণতা কম। সেকারণে চোখে পড়েনি ভিড় ঠেলে ঘুরে ঘুরে কেনাকাটার অস্থিরতা। লকডাউন কিংবা নির্দেশনা থাকার কারণে বেশীরভাগ শপিংমল ছিল বন্ধ। সেগুলোতে ছিলনা লাল নীল বাতির আলোকচ্ছটা, ছিলনা হরেক ডিজাইনের বিজ্ঞাপন আর লোভনীয় অফার। সচ্ছলদের বিদেশে কেনাকাটা করতে যাওয়াও এবার নজরে আসেনি। ঈদে কেনাকাটা করার চিরায়ত আনন্দ তাই অনেকটাই ম্লান। আবার অনেকেই মানসিকতা পাল্টে এই দুর্যোগের সময়ে নতুন পোশাক এবং উপহার বিনিময় না করার মানবিক সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। ব্যতিক্রম হিসেবে এবার দল বেঁধে আনন্দ উল্লাসে মেতে ঈদের চাঁদ দেখার গ্রাম বাংলার পরিচিত দৃশ্য কমই চোখে পড়বে। চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে আগের মত পটকা বাজি, হৈ হুল্লোড় সম্ভবত তেমন হবে না। প্রস্তুতি ও আয়োজনের এই ভিন্ন রূপ তাই আমাদের এক নতুন ঈদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। তবে টিভি চ্যানেলগুলোতে ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গান বেজে উঠলে মনের অজান্তেই ঈদের আনন্দ নাড়া দিয়ে যাবে সবার মনে।

বিজ্ঞাপন

ছোটরা এবার চিরাচরিত ঈদ আনন্দ করা থেকে কিছুটা বঞ্চিত হবে। নতুন পাঞ্জাবি-পাজামা কিংবা শাড়ি-জামা পরে এদিক ওদিক কিংবা এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরতে যাবার সুযোগ কমই থাকবে। নতুন পোশাক আর সালামির চকচকে টাকা জমানোর আর বেশি কমের হিসেব করার সুন্দর মূহুর্তগুলোও হয়ত চোখে পড়বে না। ঈদের নামাজেও থাকবে ভিন্ন চেহারা। সরকারি সিদ্ধান্তের কারনে ঈদগাহে নামাজ হওয়ায় দেখা যাবে না বাবা-ছেলের হাতে হাত রেখে ঈদগার দিকে হেঁটে যাবার সুন্দর মূহুর্ত। নামাজ শেষে হবে না কোলাকুলি, হ্যান্ডশেক। আবার সংক্রমণের আতঙ্কে অনেকে ঈদের নামাজেই যাবেন না এবার। অনেক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে, আইসোলেশনে থাকায় সেই পরিবারগুলোর ঈদ বলে কিছু নেই। অনেকে বহু কাঙ্ক্ষিত ছুটি পেলেও পরিবারের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারবেননা সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে। এমন ঈদ আমাদের আগে চোখে পড়েনি কখনো।

পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশেও ঈদ পালনে এবার রয়েছে ভিন্নতা। সৌদি আরব, জর্দান ও মিসরে ঈদের দিনে থাকবে কারফিউ। ইন্দোনেশিয়া, দুবাই, কাতার এবং তুরস্কে থাকবে লকডাউন। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন বিধি নিষেধ। ঘরেই ঈদের নামাজ পড়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে অনেক দেশে।  ইরানে দান করার মাধ্যমে ঈদ উদযাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তবে আনুষ্ঠানিকতা, রীতিনীতি পালনের ঘাটতি দেখা গেলেও, ঈদের প্রকৃত কিছু শিক্ষা কাকতালীয়ভাবে কিছু দিন যাবত দৃশ্যমান হচ্ছে। করোনার এই দূর্যোগে দায়িত্বশীলতা এবং মানবিকতাবোধ জাগ্রত হতে দেখা গেছে সমাজের সামর্থ্যবানদের মাঝে। অন্যের মুখে খাবার তুলে দেওয়া, সাহায্যে এগিয়ে আসা আর অভাবগ্রস্তকে সহায়তা করাইতো ঈদের শিক্ষা। করোনার প্রভাবে অনেকেরই বোধোদয় হয়েছে জীবনের অনিশ্চয়তা সম্পর্কে। এই বোধোদয় যদি সত্যি জাগ্রত হয় তাহলে ঈদের সৌহার্দ্য, ভাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতির শিক্ষা ব্যক্তিজীবনে চর্চা করা সহজ হবে। আর এমন বোধোদয়ই নিবৃত্ত করতে পারে ঘুষ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, জুলুম থেকে আর আগ্রহী করতে পারে দান, খয়রাত এবং যাকাত প্রদানের দিকে। করোনায় সবাই মিলে সুখ দুঃখ ভাগাভাগি মানব সেবার যে চর্চা আরম্ভ হয়েছে, তা যদি প্রকৃত অর্থে হৃদয়ঙ্গম হয়, তাহলে সারাবছর কষ্ট- আনন্দ ভাগাভাগির ইচ্ছা পোষণ করবে সবাই। ঈদের আসল উদ্দেশ্য  ও শিক্ষা তো এটাই।

বিজ্ঞাপন

করোনার প্রভাবে যে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তা ঈদের আনন্দকে অনেকটাই হতাশায় নিমজ্জিত করেছে। বহু মানুষ চাকুরি হারিয়েছেন, অনেকে বেতন পাননি, নানা সংকটে আছে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। ঈদের পরেও এই অবস্থা চলমান থাকার আতংক রয়েছে। তাই চাইলেও ঈদের আনন্দ উপভোগ করা অনেকের জন্য কষ্টকর। হয়তো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নিজের দুশ্চিন্তা লুকিয়ে আনন্দের অভিনয় করে যাবেন এই ঈদে। নানামুখি অনিশ্চয়তার কারণে বেঁচে থাকাই হয়ে দাঁড়িয়েছে বড় চ্যালেঞ্জ। তৃনমূল পর্যায়ে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ আর কৃষকের ঈদও রয়েছে অনিশ্চয়তায়। উৎপাদন আর ফসলের ন্যায্য মূল্য পাওয়া নিয়ে যে নানামুখী সংশয়, করোনাকালে তা যেন আরও তীব্র হয়েছে। কবি নজরুল ইসলামের ভাষায় তাই প্রশ্ন করাই যায়-

জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?

ঈদ সবাইকে নিয়ে আনন্দ ভাগাভাগির দিন। সুখ-দুঃখের এই ভাগাভাগির শিক্ষা কেবল আত্মোপলব্ধি এবং পরোপকারের অনুশীলনের মাধ্যমেই সম্ভব। করোনার প্রেক্ষিতে গত কিছুদিনের মানবিক প্রয়াসের সঙ্গে ঈদের শিক্ষা মেলালে বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বের করে সমাজের পিছিয়ে পড়া, সংকটে থাকা মানুষগুলির প্রতি সহমর্মী করে তুলতে পারে।

ঈদ অর্থ আনন্দ, খুশি। তবে এর আরেকটি শাব্দিক অর্থ হলো ‘বারবার ফিরে আসা’। প্রাণঘাতী করোনার দুর্ভোগ আর আম্পানের মত সাইক্লোনের আঘাত ফিরে না আসুক আবার। বারবার ফিরে আসুক ঈদের চিরচেনা আনন্দের রূপ। সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি আর ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে থাকুক সারাবছর, সকলের জীবন। অচেনা এই ভিন্ন ঈদে এটাই হোক প্রার্থনা ।

বিজ্ঞাপন

লেখক- ব্যারিস্টার-এট-ল, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। আহ্বায়ক, নাবিক, নাগরিক-বিকাশ ও কল্যান।

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন