বিজ্ঞাপন

দুর্দিনেও বাঙালির নিত্য সহচর রবীন্দ্রনাথ

May 24, 2020 | 3:46 pm

হাবীব ইমন

এক.

বিজ্ঞাপন

‘প্রলয়ের বীজ যতক্ষণ মাটির নীচে থাকে ততক্ষণ অনেক সময় নেয়। সে এত সময় যে, ভয়ের বুঝি কোনও কারণ নেই। কিন্তু মাটির উপর একবার যেই এতটুকু অঙ্কুরে দেখা দেয় অমনি দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠে। তখন তাকে কোনোমতে আঁচল দিয়ে, বুক দিয়ে চাপা দেওয়ার আর সময় পাওয়া যায় না।’- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঘরে বাইরে উপন্যাসে বিমলার আত্মকথা।

মানুষের নিশ্চিত জীবনযাপনে আঘাত কোনো না কোনো সময় যে এসে পড়বে তা নিয়ে উদ্বিগ্নতা ছিলই। বিশ্বপ্রকৃতির উপর মানুষের যথেচ্ছাচারের সীমা লঙ্ঘিত হয়েছে দিনে দিনে। পরিবেশ মানুষের কাছে তার সতর্কবার্তা নানাভাবে পৌঁছে দিচ্ছে। বিশ্ব উষ্ণায়ণের প্রভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন, মেরুপ্রদেশে বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘন ঘন ঘূর্ণাবর্ত জনিত ঝড়ঝঞ্ঝা, এসবই প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার সংকেত। বায়ুদূষণের মাত্রা মানুষ ও মনুষ্যেতর প্রাণীর সহনশীলতার গন্ডিকে ছাড়িয়েছে অনেক আগেই।

পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে জলবায়ু বিষাক্ত হয়েছে। সামুদ্রিক জীব ও বন্যপ্রাণের জীবনধারণও কষ্টকর হয়ে উঠছে ক্রমেই। জীববৈচিত্র্যের দফারফা হয়েছে। বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে এবং এখনও হচ্ছে একের পর এক জীবপ্রজাতি। ভূগর্ভের ভাঁড়ারেও জলের টানাটানি। মানুষ নিজের প্রয়োজনে এমন অনেক ধরনের কাজই করে চলেছে, যা প্রকৃতি অনুমোদন করে না। মানুষ তার প্রয়োজনীয়তার সীমাকে সীমিত করতে পারেনি। চাহিদাই হয়ে উঠেছে বিপন্নতার কারণ।

বিজ্ঞাপন

দুই.

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে বিচ্ছেদ ঘটে। সাহিত্য এবং শিল্পে মানুষ এখনও প্রকৃতির মুখাপেক্ষী। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রকৃতিই মুখ্য সহায়ক হলো- গাছপালা, পশুপাখি, আকাশ-বাতাস, পাহাড়-সমুদ্র, অরণ্যপ্রাপ্তির নদী-ঝর্ণা, চন্দ্র, সূর্য নিয়ে যে নিসর্গ তাকে, সে ক্রমে প্রাসঙ্গিক মনে করছে না আর। কিন্তু আমাদেরই উদ্ভাসিত প্রযুক্তি জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আয়েশ ও গতি আনার নেশায় প্রকৃতিকে কেবলই বদলেছে, রূপান্তর করেছে। প্রকৃতি মানুষের হাতে পড়ে গুণগত রূপান্তরে শিকার হয়েছে। যা প্রকৃত নয়, তাই বুঝি কৃত্রিম। আধুনিক জীবনব্যবস্থা নিয়ে সজ্ঞান মানুষের মনে রয়েছে সংশয়-শঙকা-সংকোচ-ক্ষণে ক্ষণে নানা উপলক্ষে তা পায়।

জীবন যে ক্রমে কৃত্রিম হয়ে পড়েছে এ বোধে সংক্রমিত সন্ত্রস্ত নয় কে? মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় বা শংকা কিছুই কম ছিল না রবীন্দ্রনাথের মনে। সভ্যতার সংকটে আস্থার বাণী উচ্চারিত হলেও অনাস্থার মেঘ দিগন্তের কোল ছুঁয়েছিল। তবে এতে এবং যে ব্যাকুল নিবেদন তিনি ‘কল্পনা’ কাব্যে ঘনায়মান সন্ধ্যার মুখে বিহঙ্গের কাছে জানিয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিল গভীর দার্শনিকতা। রবীন্দ্রনাথ স্বভাবতই পরিবর্তনের পক্ষে, আধুনিকতার পক্ষে অগ্রপথিক। গানের প্রসঙ্গে তিনি চড়া সুরে নতুন যুগের প্রতি পক্ষপাত ব্যক্ত করেছেন। বহুবার। কিন্তু অনেক রচনায় প্রকৃতির পূজারি ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ববীক্ষণ ও মানবপ্রেম রবীন্দ্রমানসের বেসিক আইডেনটিটি। কবিরা মূলত মননের ভুবনের রূপকার। মানব কল্যাণে সমাজ সংস্কারের কাজে কবির সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা নয়। বিশ্বের কবিদের জীবনপাঠে আমাদের যতটুকু ধারণা, তাতে কাউকে মানুষের সামাজিক জীবন উন্নয়নে ব্রতী হতে দেখা যায় নি। রবীন্দ্রনাথই বোধ করি ব্যতিক্রম।

রবীন্দ্রনাথ গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ-অভিভূত একজন মননশীল রোমান্টিক কবি, যাঁর চোখে শিলাইদহের পদ্মাপ্রকৃতিই এক ভিন্ন পৃথিবী। সেখানকার রূপময়তা তাঁর চোখে যেন পৃথিবীর সৌন্দর্য। আকাশ, মেঘ, বৃষ্টি, নদী, মাটি, ফসলভরা নানা রঙে শস্যক্ষেত, নদীতে চলমান নৌকা, কখনো ধানেভরা, কখনো শূন্য, বর্ষণসিক্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি সিক্ত নগ্নদেহ কৃষক, নির্দয় প্রকৃতির বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ ইত্যাদি নিয়েই এ পর্বের কবিতা- সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালিতে। কখনো সহজ পাঠশালা-বইয়ের পাতা, কখনো জটিল দর্শন চিন্তার প্রকাশ ভিন্ন চরিত্রের পাতায়।

তিন.

আমার মা তখন নোয়াখালীর বসুরহাটে মাকসুদাহ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। একবার ওই স্কুলে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল। স্কুলের কাছাকাছি হোস্টেলে থাকার কারণে আমি অনুষ্ঠানে যাই। মেয়েদের গলায় আমি প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান শুনি। সেই প্রথম ঠাকুরের সাথে আমার প্রেম। সেদিন মেয়েরা গেয়েছিল- ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে/মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ…’ গানটি। সুরে-লয়ে কিছুটা বিকৃতি সে সময়ে হলেও গানের ভেতরে নিজেকে ঢুকাতে পেরেছি। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অন্যমাত্রায় মনে হয়েছে। মনের ভেতরে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠে উন্মত্ত। রবীন্দ্রনাথ যে সংগীত সৃষ্টি করতে চেয়েছেন তা ঠিক যেন মানুষের গান নয়, তাতো যেন সমস্ত জগতের; অর্থাৎ এমন মানুষের জন্য এ গান, যিনি এ জগতের সঙ্গে যুক্ত।

বিজ্ঞাপন

চার.

বাঙালির নিত্য সহচর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ কথাটা অস্বীকার করার উপায় কী আছে! একসময় মধ্যবিত্ত পরিবারে একটা কথা প্রচলিত ছিল, যে ঘরে গীতবিতান, সঞ্চয়িতা থাকবে না, তাকে বাঙালি বলা যাবে না। সেই মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে এখন পরিবর্তন এসেছে। হয়তো গীতবিতান, সঞ্চয়িতা এখন পাওয়া যাবে না, কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে রবীন্দ্রনাথ হারায়নি। কোনো না কোনোভাবে তিনি বাঙালির ঘরে আটকে আছেন।

যখন দেশের কথা ভাবি, কিংবা দেশের বাইরে যাই, তখন প্রবলভাবে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ভীষণভাবে অনুভূত হয়। এমন করে কারোর পক্ষে লেখা হয়নি- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। এ গানটা যখন আমি শুনি তখন আমার ভেতরে শিহরণ জাগে। যে মানুষটি কখনো রবীন্দ্রসংগীত শোনেনি, কিন্তু তার মন ভালো নেই, তার মনেও রবীন্দ্রনাথ খুব সহজাতভাবে প্রবেশ করে। তাকে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে প্রলুব্ধ করে। বাঙালির শিক্ষা, বাঙালির কৃষি অর্থনীতি- যে ধারায় আমাদের অগ্রসর হই না কেন, তার ভেতরেও রবীন্দ্রনাথ আছে। অবৈতনিক স্কুল, দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র, কুটির শিল্পের প্রসার, বিনা সুদে কৃষিঋণ প্রদান ইত্যাদির ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন পদপদবির লোভে নয়, নয় রাজকীয় সম্মান লাভের জন্য। মানুষকে আপন করে দেখার মানসিকতা তাঁকে সমাজ উন্নয়নের কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাইতো তিনি সবার হয়ে উঠেছিলেন এবং বলতে পেরেছিলেন- ‘আমি তোমাদেরই লোক’।

বাঙালির সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতির মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আছেন। তাই তো গেয়েছেন, বাংলার মাটি, বাংলার বায়ু /বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল…। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখনো আছেন আমাদের ভেতরে। চিরনতুন ভাবে। রবীন্দ্রনাথকে কখনোই ছাপিয়ে যাওয়া সম্ভব না।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে সমগ্র বিশ্ব এখন মৃত্যুপুরী। অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলায় ঘরে বসে আছেন মানুষ। ‘অগ্নিস্নানে সূচি হোক ধরা মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা- আজ বাঙালি কায়মনে এই প্রণতিই জানাচ্ছে। আরো পঞ্চাশ বছর পরেও বাঙালির সংস্কৃতি চর্চা ও জীবনে প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্রনাথ। সেটা নিঃসন্দেহে একটা ইতিবাচক দিক।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ঢাকা মহানগর

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই/টিসি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন