বিজ্ঞাপন

বাস্তবায়ন হয়নি সরকারি নির্দেশনা, শৃঙ্খলাও ফেরেনি সড়কে

July 28, 2020 | 10:34 pm

সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই। দুই চালকের প্রতিযোগিতার কারণে বাসচাপায় প্রাণ হারান রাজধানীর শহিদ রমিজ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম রাজীব। এ ঘটনায় আহত হন আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। এর পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে টানা ১১দিনব্যাপী চলে ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’। পরে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বেশকিছু নির্দেশনাও দেওয়া হয়। কিন্তু দেখতে দেখতে ২ বছর পেরিয়ে গেলেও নেই সেসব নির্দেশনার দৃশ্যমান কোনো বাস্তবায়ন। শুধু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নয়, তিনি নিজেও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেগুলোরও বাস্তবায়নে নেই অগ্রগতি। উপেক্ষিতই রয়ে গেছে সবই। ফলে এখনও সড়কে ফেরেনি শৃঙ্খলা। এখনও প্রতিনিয়ত সড়কে ঝরছে প্রাণ, মানুষকে বরণ করতে হচ্ছে পঙ্গুত্বকে, নিঃস্ব হচ্ছে পরিবার।

বিজ্ঞাপন

বিভিন্ন সংস্থার তথ্য মতে, দেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে সাত হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান। আর আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেন প্রায় ১৭ হাজার মানুষ। আর এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, অতিরিক্ত গতি, অদক্ষ চালক ও সড়কের অব্যবস্থাপনা। কিন্তু এসব নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা উদাসীন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাই নৈরাজ্যের সড়কে শৃঙ্খলা ফেরা এখনও অনেক সময়ের ব্যপার বলে ধারণা তাদের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৫ জুন সড়কে নৈরাজ্য বন্ধে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে আলোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আলোচনার এক পর্যায়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে তিনি পাঁচটি নির্দেশনাও দেন। নির্দেশনাগুলো হলো- টানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালাতে দূরপাল্লার যানবাহনে বিকল্প চালক রাখা, চালকদের জন্য বিশ্রামাগার করা, গাড়ির চালক ও তার সহকারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, সিগন্যাল মেনে পথচারীদের জেব্রা ক্রসিং ছাড়া অবৈধভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা এবং চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করা।

প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনার মাসখানেক পেরোতেই ২৯ জুলাই বাসচাপায় রমিজ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের তোপে পড়ে ১৬ আগস্ট আরও ১৭টি নির্দেশনা আসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। সেগুলো বাস্তবায়নেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

বিজ্ঞাপন

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের যে ১৭টি নির্দেশনা ছিল সেগুলো হলো- ১. গণপরিবহন চলাকালে দরজা বন্ধ রাখা এবং বাস স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠানামা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা। ২. গণপরিবহনে দৃশ্যমান দুটি স্থানে চালক ও হেলপারের ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর, মোবাইল নম্বর প্রদর্শন নিশ্চিত করা। ৩. সব মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীকে বাধ্যতামূলক হেলমেট পরিধান এবং সিগন্যালসহ ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য করা। ৪. সব পরিবহনে (বিশেষত দূরপাল্লার বাসে) চালক এবং যাত্রীর সিটবেল্ট ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া এবং পরিবহন মালিকদের সিটবেল্ট সংযোজনের নির্দেশনা দেওয়া এবং আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। ৫. যেসব স্থানে ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাস রয়েছে সেসব স্থানের উভয়পাশে ১০০ মিটারের মধ্যে রাস্তা পারাপার সম্পূর্ণ বন্ধ করা। ৬. ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাসসমূহে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ৭. ফুটপাত হকারমুক্ত রাখা, অবৈধ পার্কিং এবং স্থাপনা উচ্ছেদ করা। ৮. ট্রাফিক সপ্তাহে চলমান সব কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত যথাসম্ভব অব্যাহত রাখা। ৯. ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু করার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া। ১০. ঢাকা শহরে রিমোট কন্ট্রোলড অটোমেটিক বৈদ্যুতিক সিগন্যালিং পদ্ধতি চালুর নির্দেশ। ১১. ৩০ অক্টোবর ২০১৮ এর মধ্যে ঢাকা শহরের সব সড়কের রোড ডিভাইডারের উচ্চতা বৃদ্ধি করে বা স্থানের ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ।

নির্দেশনার মধ্যে আরও ছিল- ১২. মহাখালী ফ্লাইওভারের পর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ন্যূনতম দুটি স্থানে স্থায়ী মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এবং নিয়মিত দৈব চয়নের ভিত্তিতে যানবাহনের ফিটনেস ও ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করা। ১৩. ঢাকা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি বা আরম্ভ হওয়ার সময় জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী, স্কাউট এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের (বিএনসিসি) সহযোগিতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের রাস্তা পারাপারের উদ্যোগ নেওয়া। ১৪. অবৈধ পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ফিটনেস দেওয়ার প্রক্রিয়ায় অবশ্যই পরিবহন দেখে ব্যবস্থা নিতে হবে। ১৫. রুট পারমিট/ফিটনেসবিহীন যানবাহন দ্রুত ধ্বংস করার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। ১৬. লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘লারনার’ দেওয়ার আগে ড্রাইভিং টেস্ট নেওয়া যেতে পারে এবং উত্তীর্ণদের দ্রুততম সময়ে লাইসেন্স দেওয়ার নির্দেশ এবং ১৭. কর্মকর্তা-কর্মচারীর ঘাটতি থাকলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু এসব নির্দেশনার হাতেগোনা দুয়েকটি ছাড়া অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এত আন্দোলন, এত সভা-সমাবেশ করেও যখন সড়কে নৈরাজ্য বন্ধ হচ্ছিল না। তখনই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা দেওয়ার খবর শুনে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের কথা হলো এখনও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি। প্রথমে তিনি যে পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন তার মাত্র দুটি চালক প্রশিক্ষণ এবং বিশ্রামাগার তৈরি প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য চলমান রয়েছে। বাকি যে তিনটি নির্দেশনা রয়েছে সেগুলো একটু সদিচ্ছা থাকলেই বাস্তবায়ন সম্ভব।’

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এআরআই’র পরিচালক ড. মিজানুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর কিছুদিন সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামলেও এখন আবারও সেই পুরোনো অবস্থা। নিয়মের তোয়াক্কা করছে না কেউই। জেব্রা ক্রসিং থাকলে সেখানে যেন গাড়ির গতি আরও বেড়ে যায়। যাত্রী উঠানো-নামানোর চিত্র তো আরও ভয়ংকর। আর দুই বাসের প্রতিযোগিতা দেখলে আতঙ্ক ছড়ায় যাত্রীদের মাঝেই। এসবের জন্য পরিবহনের মালিকরাই দায়ী। তারাই চালকদের বাধ্য করে এসব পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে।’

তিনি বলেন, ‘এইসব নৈরাজ্য বন্ধে মালিকদের নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। আর এ জন্য তাদের বিরুদ্ধে সরকারের শক্ত অবস্থান নিতে হবে। মালিকরা যতই শক্তিশালী হোক, রাষ্ট্র বা সরকার এর থেকে বেশি শক্তিশালী। তাহলে তাদের কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না? আমার মনে হয় সরকারের একটা স্ট্রং স্টেটমেন্ট থাকা দরকার। এই যে পরিবহনের নৈরাজ্য এটা নিয়ে মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। এমনকি এর কারণে সরকারের অনেক সাফল্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এটা সরকারের বোঝা উচিত।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে অনেকের আর্থিক বাণিজ্য সুবিধা কমে যাবে। আবার দেখা যাচ্ছে যে, নির্দেশনাগুলোর মধ্যে যেগুলোতে আর্থিক বাণিজ্য সুবিধা রয়েছে কিংবা প্রকল্প নির্ভর নির্দেশনা সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য কাজ চলছে। কিন্তু যেগুলোতে টাকা লাগবে না, শুধুমাত্র প্রয়োজন সদিচ্ছা এবং জবাবদিহিতা সেগুলোতে কারও নজর নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘এমন বেহাল অবস্থার মূল কারণ সরকারের কঠোর অবস্থান না থাকা। সরকার প্রধান যদি জবাবদিহি নিশ্চিত করতেন যে, নির্দেশনা কেন বাস্তবায়ন হয়নি? তাহলে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারাও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতেন। যাদের কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তারা জবাবদিহিতার মধ্যে নেই। কারণ তারাও জানে, কেউ কিছু বলবে না। এই যে দায়িত্বে অবহেলার একটা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সরকার প্রধানকে এই অবস্থানে দৃঢ় হতে হবে। এখন আর নির্দেশনার মধ্যে থাকলে হবে না। কেন বাস্তবায়ন হয়নি সে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই নির্দেশনা আলোর মুখ দেখবে।’

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে সারাদেশে ২৬ হাজার ৯০২টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৩৭ হাজার ৮৫৮ জন। আর এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে ৮২ হাজার ৭৫৮ জন। বেসরকারি সংস্থা গ্রিন ক্লাব অব বাংলাদেশের (জিসিবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু চলতি বছরের গত ৬ মাসে ২ হাজার ২২১টি দুর্ঘটনায় সড়ক-মহাসড়কে প্রাণ ঝরেছে ২ হাজার ৪৫৯ জনের। আর এতে আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৭৫৩ জন।

জিসিবির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী সড়ক ও মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার যান বেড়ে যাওয়া। ব্যস্ত সড়কে স্থানীয়ভাবে তৈরি ইঞ্জিনচালিত যান চলাচল, চালকদের বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো ও প্রতিযোগিতা, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে আইন প্রয়োগের অভাব, লাইসেন্স না থাকা চালক নিয়োগ এবং অদক্ষ চালক বা কন্ডাক্টরদের কাছে দৈনিক চুক্তি ভিত্তিক গাড়ি ভাড়া দেওয়াও সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। যদি এসব সমস্যা ঠেকানো যায় তবে নিরাপদ সড়ক অবশ্যই বাস্তবায়ন হবে।’

এদিকে দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের (নিসআ) যুগ্ম আহ্বায়ক শহীদুল আলম আপন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা ওইসময় যেসব দাবি জানিয়েছিলাম তার অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি। এটা সত্যিই দুঃখজনক। আমাদের আন্দোলনটা তো ছিল অহিংস এবং অরাজনৈতিক। আমাদের দাবি যদি বাস্তবায়ন হয় তবে এর সুফল তো সকলেই ভোগ করবে। তাই আমরা চাই, আর কালক্ষেপণ না করে দ্রুত দাবিগুলো বাস্তবায়ন করা হোক।’

সারাবাংলা/এসএইচ/টিএস/পিটিএম

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন