বিজ্ঞাপন

করোনা ও বন্যার আঘাতেও গ্রামীণ অর্থনীতি টিকে আছে রেমিট্যান্সে

August 10, 2020 | 1:02 pm

গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে গ্রামের অকৃষি খাত। অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে গ্রামে ফিরে এসেছে। এতে করে গ্রামের শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতা বেড়েছে, কমে গেছে শ্রমের মূল্য। অন্যদিকে বন্যায় কৃষি ও অকৃষি— দুই খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার কারণে আমন ধান রোপণ করা সম্ভব হয়নি। আর করোনা ও বন্যায় পোল্ট্রি শিল্প, গবাদি পশু ও মৎস্য খাতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে করোনাভাইরাস ও বন্যায় গ্রামীণ অর্থনীতি বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে।

বিজ্ঞাপন

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা ও বন্যা— এ দুই দুর্যোগে গ্রামীণ অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপরও সেই ক্ষতি বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহের কারণে। গত কয়েক মাস ধরে রেমিট্যান্স প্রবাহে অব্যাহতভাবে ক্রমবর্ধমান প্রবণতাই টিকিয়ে রেখে গ্রামীণ অর্থনীতিকে।

গ্রামীণ অর্থনীতি প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, গ্রামীণ অর্থনীতি বর্তমানে বেশ দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে। একদিকে করোনাভাইরাস, অন্যদিকে দেশব্যাপী ভয়াবহ বন্যা— এই দুই দুর্যোগের কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে।

তিনি বলেন, করোনা ও বন্যায় দুই ধরনের ক্ষতি হয়েছে। যেমন— করোনায় অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অনেকে বিদেশ থেকে দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হয়েছেন। আবার অনেকে শহরে কর্মহীন হয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি চরম সংকটের মুখে পড়েছে। আবার বন্যার কারণে প্রান্তিক চাষিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারা অনেকে ঘরে ফসল তুলতে পারেননি ঘরে। অনেকের ঘরবাড়ি ও গবাদি পশু বন্যায় ভেসে গেছে। এ অবস্থায় বাড়তি রেমিট্যান্স প্রবাহ গ্রামীণ অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও টিকে থাকতে সহায়তা করছে।

বিজ্ঞাপন

করোনাভাইরাস যতটা না, গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য বন্যা তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

ড. সেলিম রায়হান সারাবাংলাকে বলেন, গ্রামীণ অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর হওয়ায় বন্যার আগ পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কারণে শস্য খাত তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তবে মৎস্য, গবাদি পশু ও পোল্ট্রি খাত কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে বন্যায় কৃষি খাতের শস্য ও অশস্য— উভয় খাত চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যা যদি আরও কিছুদিন থাকে, নতুন করে আবাদ করা নিয়েই সমস্যা হবে। এর বাইরে যারা নানা ধরনের দোকান চালায় বা ছোটখাটো ব্যবসা করে, তারা কিন্তু করোনা ও বন্যা— ‍দুইটির কারণেই ক্ষতির মুখে পড়েছে। আর গ্রামীণ অর্থনীতির কৃষি নির্ভরতার কারণেই কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অকৃষি খাতও ক্ষতির মুখে পড়েছে।

তিনি বলেন, করোনায় কর্মহীন হয়ে অনেক মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামমুখী হয়েছেন। এতে করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। যে মানুষগুলো শহরে কাজ হারিয়ে গ্রামে গেছেন, তাদের জন্য গ্রামেও কাজ পাওযা সহজ হবে না। ফলে গ্রামের শ্রমবাজারে শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মজুরি কমে যেতে পারে। গ্রামে যাওয়া মানুষগুলো যদি গ্রামে কাজ না পায়, তাহলে গ্রামের সামাজিক সংকট আরও বেড়ে যাবে।

বিজ্ঞাপন

রেমিট্যান্সের ভূমিকা তুলে ধরে ড. সেলিম বলেন, এমন একটি বিপর্যয়ের সময়েও গ্রামীণ অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে রেমিট্যান্স। কারণ করোনা আর বন্যার মধ্যেও রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেক বেড়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ না বাড়লে এই সময়ে গ্রামীণ অর্থনীতির অবস্থা আরও খারাপ হতে পারত।

পিআরআই নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের প্রধান যে শস্য, সেটা আমরা বন্যার আগেই তুলে ফেলেছি। তবে আউশ ধান বন্যায় ডুবে যাওয়ায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক কৃষক রবি ফসল তোলার পর জমিতে আমন ধান লাগানোর প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। বন্যা চলে আসায় সেটা পারেননি।

করোনার তুলনায় বন্যা বেশি ক্ষতি করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত করোনা গ্রামীণ জীবনে তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। যতটুকু ক্ষতি হয়েছে, তার বেশিরভাগেরেই কারণ বন্যা। তবে করোনার কারণে ডেইরি ও পোল্ট্রি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে বন্যায় আমাদের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে আবদ্ধ জলাশয় থেকে বন্যার কারণে মাছ ভেসে গেছে। আর ফসলের কথা তো বলেইছি। এতকিছুর পরও রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে গ্রামীণ অর্থনীতি একদম বিপর্যয়ের শেষ সীমায় পৌঁছেনি। তবে অনেকেই করোনার কারণে চাকরি হারিয়ে বিদেশ থেকে ফেরত আসছেন— এটি বড় সমস্যা।

প্রয়োজন সরকারি সহায়তা

বিজ্ঞাপন

গ্রামীণ অর্থনীতির বর্তমান এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তার কথাই বললেন তিন অর্থনীতিবিদ। সানেমের ড. সেলিম বলেন, সরকারি বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজে অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ এসেছে, নানা প্রশ্ন উঠেছে। তারপরও প্রণোদনা প্যাকেজ যতটুকুই বিতরণ করা হয়েছে, তা গ্রামীণ অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও সহায়তা করেছে। তাই করোনা ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আরও বেশি সরকারি সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি যে প্রণোদনা প্যাকেজ রয়েছে, সেগুলো বিতরণের সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারি সহায়তার কোনো বিকল্প নেই। বন্যায় যারা বাড়িঘর হারিয়েছেন, সরকারের উচিত তাদের সহায়তা করা। বর্তমান পরিস্থিতিতে ত্রাণ সহায়তার পরিমাণও আরও বাড়ানো উচিত।

এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে আগামী বেশ কিছুদিন ধরে গ্রামে ত্রাণ সরবরাহের পরামর্শ দিচ্ছেন মির্জ্জা আজিজও। প্রয়োজনে বাজেট ঘাটতি বাড়ানোর পক্ষেও মত তার। মির্জ্জা আজিজ সারাবাংলাকে বলেন, এই দুর্যোগের সময় গ্রামের মানুষগুলোতে বাঁচিয়ে রাখাই হবে সরকারের প্রধান কাজ। সে জন্য ত্রাণ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। তা করতে গিয়ে প্রয়োজন হলে বাজেট ঘাটতি ৫ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ছয় শতাংশও করা যেতে পারে।

রেমিট্যান্সের চিত্র

করোনা ও বন্যার আঘাত মোকাবিলা করেও গ্রামীণ অর্থনীতি টিকে থাকার পেছনে যে রেমিট্যান্সের প্রবাহের ভূমিকা দেখছেন অর্থনীতিবিদরা, তার প্রকৃত চিত্রটি কী?

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, মে-জুন-জুলাই— এই তিন মাস টানা রেমিট্যান্স পাঠানোর রেকর্ড গড়েছেন প্রবাসীরা। মে মাসে এর পরিমাণ ছিল ১৭৪ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, জুনে সেই রেকর্ড ভেঙে ১৮৩ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। এবার ৭৬ কোটি ৭০ লাখ ডলারের ব্যবধানে সেই রেকর্ডও ভাঙলো জুলাই মাসে। এ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ২৬০ কোটি মার্কিন ডলার।

রেমিট্যান্সের অব্যাহত এই রেকর্ডে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও গত দুই মাসে বেশ কয়েকবারই নতুন রেকর্ড গড়েছে। তাতেও অবশ্য স্বস্তি পাচ্ছেন না অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, অনেকেই বিদেশ থেকে একবারে ফিরে আসছেন। ফলে সব সঞ্চয় রেমিট্যান্স আকারে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সাময়িকভাবে তাই রেমিট্যান্সের সুফল ভোগ করা গেলেও দীর্ঘমেয়াদে তা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

সারাবাংলা/জিএস/টিআর

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন