বিজ্ঞাপন

৬৩ জেলায় জঙ্গি হামলার ১৫ বছর: ৪৭ মামলার বিচার হয়নি আজও

August 17, 2020 | 11:10 am

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট। সারাদেশ একযোগে কেঁপে ওঠে বোমার আঘাতে। মুন্সীগঞ্জ ছাড়া দেশের ৬৩ জেলায় সংঘটিত এই বোমা হামলায় তেমন কেউ হতাহত হয়নি। তবে নিজেদের উপস্থিতি সারাবিশ্বে জানান দেওয়ার যে লক্ষ্য ছিল জঙ্গিদের, তাদের সেই উদ্দেশ্য শতভাগ সফল হয়েছিল। তারা সারাবিশ্বে জানাতে পেরেছিল, জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) নামে একটি জঙ্গি সংগঠন বাংলাদেশে সক্রিয়। আর সে কারণেই পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলামের চোখে এই হামলা কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ‘সফলতম জঙ্গি হামলা’।

বিজ্ঞাপন

১৫ বছর আগের সেই ঘটনায় সারাদেশে দায়ের হয়েছিল ১৫৯টি মামলা। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, সিরিজ ওই বোমা হামলার ঘটনায় সারাদেশে ১৫৯টি মামলার মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটনে দায়ের হয় ১৮টি মামলা, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনে আটটি, রাজশাহী মেট্রোপলিটনে চারটি, খুলনা মেট্রোপলিটনে তিনটি, বরিশাল মেট্রোপলিটনে ১২টি ও সিলেট মেট্রোপলিটনে ১০টি মামলা। এর বাইরে ঢাকা রেঞ্জে ২৩টি, চট্টগ্রাম রেঞ্জে ১১টি, রাজশাহী রেঞ্জে সাতটি, খুলনা রেঞ্জে ২৩টি, বরিশাল রেঞ্জে সাতটি, সিলেট রেঞ্জে ১৬টি, রংপুর রেঞ্জে আটটি, ময়মনসিংহ রেঞ্জে ছয়টি ও রেলওয়ে রেঞ্জে তিনটি মামলা দায়ের হয়।

এসব মামলার মোট আসামি ছিলেন প্রায় এক হাজার আসামি। তবে এর মধ্যে ১৬টি মামলায় ঘটনার সত্যতা মিললেও কোনো আসামিকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। এসব মামলায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। বাকি ১৪৩টি মামলায় চার্জশিট বা অভিযোগপত্র দাখিল করা হয় আদালতে।

চার্জশিট দাখিল করা মামলাগুলোতে এজাহারনামীয় আসামি ছিলেন ১৩০ জন। তবে এসব মামলায় বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে মোট ৯৬১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযোগপত্রে নাম দেওয়া হয় এক হাজার ৭২ জনের। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়া ৯৬টি মামলায় ৩২২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জনকে দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ড। খালাস দেওয়া হয় ৩৫৮ জনকে, জামিনে রয়েছেন ১৩৩ জন আসামি। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া আসামিদের মধ্যে ছিলেন বাংলা ভাই, শায়খ আব্দুর রহমান।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, সিরিজ বোমা হামলায় ডিএমপিতে যে ১৮টি মামলা দায়ের হয়, এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে পাঁচটি মামলা। ছয়টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করায় সেগুলোর আনুষ্ঠানিকতাও শেষ হয়েছে। বাকি সাতটি মামলা ঢাকা জুডিশিয়াল কোর্টে চলছে।

ডিএমপি’র সাতটিসহ নিষ্পত্তি না হওয়া ৪৭টি মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আবু আব্দুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ওই ঘটনায় বেশকিছু মামলার বিচারকাজ শেষ হয়েছে। তবে সব মামলার বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি। এসব মামলা শেষ করতে চাইলে পুলিশকে বড় ভূমিকা রাখতে হবে। মামলাগুলোতে তারা যত দ্রুত সাক্ষীদের হাজির করতে পারবে, মামলাগুলো তত দ্রুত শেষ হবে।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) সোহেল রানা সারাবাংলাকে বলেন, বেশকিছু মামলার শুনানি শেষে রায় হয়েছে। অনেকগুলোর শুনানি শেষের দিকে। আবার কিছু মামলার শুনানি আটকে আছে। সাক্ষী পাওয়া যায় না। অনেক সময় সাক্ষীরা আসেন না। সবকিছু মিলে সাক্ষীদের হাজির করে মামলাগুলোর দ্রুত বিচারকাজ ত্বরান্বিত করতে পুলিশ সর্বাত্মক চেষ্টা করছে।

বিজ্ঞাপন

জঙ্গিদের চেয়ে পুলিশের শক্তিসামর্থ্য বেড়েছে

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ২০০৫ সালে যখন ওই হামলাটি হয়, তখন জেএমবির যে শক্তি-সামর্থ্য ছিল, তার চেয়ে জঙ্গিরা এখন অনেক বেশি কৌশলী হয়েছে। তবে একইসঙ্গে পুলিশের শক্তি-সামর্থ্যও কয়েকগুণ বেড়েছে। পুলিশের সরঞ্জামও অনেক বেড়েছে। ফলে জঙ্গিরা আধুনিক হলেও পুলিশ তার তুলনায় অনেক বেশি আধুনিক হয়েছে। সেই হিসাবে বরং বলা যায়, জঙ্গিরা ২০০৫ সালের ওই সময়েই বেশি শক্তিশালী ছিল। কারণ তারা হয়তো তখন চাইলেই হামলা করতে পারত। এখন কিন্তু সেটা চাইলেই পারবে না। হামলার অনেক আগেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়বে। তাছাড়া জঙ্গিরা এখনো হ্যান্ড মেড অস্ত্র দিয়েই হামলার চেষ্টা করে, যা কোনোভাবেই শক্তিশালী নয়।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে জেএমবি শক্তিও হারিয়েছে। জানা যায়, ১৯৯৮ সালে শায়খ আবদুর রহমানের গড়ে তোলা জেএমবি সারাদেশে কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৩ সাল থেকে তারা সক্রিয় হয়। আর ২০০৫ সালের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলার মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি ও শক্তিমত্তা জানান দেয়। ওই বছরেরই ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে বিচারককে হত্যার মধ্য দিয়ে তারা আরও বেশি আলোচনায় উঠে আসে।

তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে একে একে শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, খালেদ সাইফুল্লাহসহ জেএমবি’র শীর্ষ নেতারা ধরা পড়েন। এর মধ্যে শীর্ষ ছয় নেতার ফাঁসি কার্যকর হয় ২০০৭ সালে। ওই সময় থেকেই সংগঠনের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। পরে নেতৃত্ব সংকটে সংগঠন দুই ভাগে বিভক্ত হয়। এর মধ্যে নব্য জেএমবি ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে হলি আর্টিজান রেস্তোঁরা ও পরে শোলাকিয়ার ঈদগাহ ময়দানে হামলা চালায়। এরপর জঙ্গিদের বিভিন্ন ঘাঁটিতে সাঁড়াশি অভিযানে নামে পুলিশ, র‌্যাব, সিটিটিসি ইউনিট, র‌্যাব। তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করা হয় জেএমবি’র প্রথম ও দ্বিতীয় সারির সব নেতাকে। একের পর এক অভিযানে জঙ্গি নেতাদের কেউ নিহত হন, কেউ ধরা পড়ে বিচারের আওতায় আসেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য, জেএমবি বা নব্য জেএমবি’র কারও পক্ষেই এখন আর দেশে জঙ্গি তৎপরতা চালানোর মতো সক্ষমতা নেই। তারপরও তারা সতর্ক অবস্থানেই রয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

বিভিন্ন সময় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে যারা ধরা পড়েছেন, তাদের নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মতাদর্শিক পর্যায়েও কাজ করেছেন বলে জানান সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, যারা বিচারের সাজা খেটে বাসায় ফিরেছেন এবং যারা জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন, তাদের সবার সঙ্গেই আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। যে আইডিওলজিতে তারা বিশ্বাস করতেন, ওই পথে যেন আর তারা না যান, আমরা সবরকমভাবেই সেই চেষ্টা করছি। অনেককে অর্থ সহায়তা দিয়ে সমাজে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আবার অনেকে অর্থ সহায়তা নিতে রাজি হননি।

মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, সামাজিকভাবে জঙ্গিবাদকে না বলার জন্য আরও বেশি বেশি অ্যাওয়ারনেস চালাতে হবে। সমাজের সবাইকে একযোগে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে।

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন