বিজ্ঞাপন

ফিরে দেখা: অ্যাডিলেডে যখন স্বপ্নলোকের চাবি

March 9, 2018 | 4:14 pm

মোসতাকিম হোসেন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

বিজ্ঞাপন

নাসের হুসেইনের কথাটা তখন স্লোগান হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে অ্যালিডেডের ইথারে, ‘বোল্ড, বোল্ড অ্যান্ড স্ট্রেইট। দ্য বাংলাদেশ টাইগারস হ্যাভ নকড দ্য ইংল্যান্ড লায়ন্স আউট অব দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ। ওয়ান অব দ্য গ্রেটেস্ট ডেইজ ইন বাংলাদেশ ক্রিকেট হিস্ট্রি…’। রুবেল হোসেন যেন অলিম্পাস পর্বতে ছুটছেন পুরাণের কোনো এক দেবতা হয়ে, আর জিউস মাশরাফি বিন মুর্তজার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে গোটা দল। ১১ জনের সঙ্গে ষোলো কোটি মানুষও যেন ঢুকে গেল ওই মানবস্তুপে।

দুই বছর আগে অ্যাডিলেডে ওই দৃশ্যটা এখনো নিশ্চয় অনেকের চোখে এখনো ভাসছে। রুবেল হোসেনের বলে জেমস অ্যান্ডারসনের স্টাম্প উপড়ে গেল, টানটান হয়ে থাকা স্নায়ুচাপের ধকলটা যেন গোটা বাংলাদেশ জুড়ে বের হয়ে এলো অশ্রু-আনন্দ আর উল্লাসের কোরাস হয়ে। অ্যাডিলেডের গ্যালারিই তো তখন একটুকরো বাংলাদেশ, আর ঢাকার রাজপথ থেকে বিজয়ের মিছিল একে একে মিলছে সবখানে। বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালের ওই স্বপ্নলোকের চাবিই যে এসে গিয়েছিল হাতে!

কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে বলে শুধু নয়, যেভাবে জয়টা এসেছে তাতেই তো উদযাপনটা এনে দিয়েছে আনন্দাশ্রুর। রুবেল হোসেন যখন ৪৮তম ওভারটা করতে যাচ্ছেন, ধারাভাষ্যকার নাসের হুসেইন তখনও বলছেন, ‘শেষ ওভারে গেলে যে কোনো কিছুই হতে পারে’। স্টুয়ার্ট ব্রড তখন ক্রিজে, শেষ দুই ওভারে ইংল্যান্ডের দরকার ১৬ রান, হাতে আছে ২ উইকেট। ব্রডের হয়ে গেছে ৫ বলে ৯ রান। আগের ওভারেই তাসকিনকে মেরেছেন ছয়। অন্য পাশে ক্রিস ওকসের জন্যই আশাটা রঙিন ছিল ইংল্যান্ডের, ৪০ বলে ৪২ রান হয়ে গিয়েছিল তার।

বিজ্ঞাপন

প্রথম বলেই রুবেলের গুড লেংথের বলে এলোমেলো হয়ে গেল স্টাম্প। পরের বলটা ইয়র্কারই দিলেন রুবেল, অ্যান্ডারসন ব্যাটও লাগালেন। স্লিপ না থাকলে নিশ্চিতভাবেই তা চার হয়ে যেত। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না অ্যান্ডারসনের, পরের বলটাই লেগ স্টাম্পের ওপর নিখুঁত এক ইয়র্কার, এরপর তো রুবেলের ওই পাগুলে দৌড়!

ওই মুহূর্তে তামিম ইকবাল নিশ্চয় নিজের বুকের ওপর থেকে পাষাণভার নেমে যাওয়ার স্বস্তি চেয়েছিলেন। ৪৭তম ওভারেই জয় অনেকটা নিশ্চিত করে ফেলতে পারত বাংলাদেশ। তাসকিনের বলে লং অনে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ওকস, তামিম ক্যাচটা হাতে নিয়েও ফেলে দিলেন। বিশ্বকাপ-স্বপ্নও ফেলে দিলেন কি না, সেই প্রশ্নও ভালোভাবেই উঠতে শুরু করেছে তখন।

ম্যাচ পেন্ডুলামটা দুলতে শুরু করেছিল আরও আগে। শেষ ৫ ওভারে যখন ৪৭ রান দরকার, ইংল্যান্ডের হাতে তখনও ৬ উইকেট। জস বাটলার আর ক্রিস ওকস মনে হচ্ছিল ম্যাচটা শেষ করেই মাঠ ছাড়বেন। কিন্তু তাসকিনের বলে মুশফিককে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গেলেন বাটলার। ম্যাচের সবচেয়ে বিতর্কিত মুহূর্তটা এলো এরপর। ক্রিস জর্ডান ক্রিজে ঢুকে পড়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সরাসরি থ্রোটা স্টাম্পে লাগার সময় ব্যাট মাটিতে ছিল কি না, সেটা নিয়েই ছিল প্রশ্ন। তৃতীয় আম্পায়ার শেষ পর্যন্ত লাল বাতিই জানালেন, বাংলাদেশ পর পর দুই বলে পেল দুই উইকেট।

বিজ্ঞাপন

অথচ ১৬৩ রানে ইংল্যান্ড যখন ষষ্ঠ উইকেট হারায়, বাংলাদেশের স্বপ্নটা সত্যিকার অর্থেই তখন বাস্তব মনে হচ্ছিল। ইংল্যান্ডের টপ অর্ডারের সবাই তখন ফিরে গেছেন, জো রুটই টিকে ছিলেন। তিনিও ২৯ রান করে ক্যাচ দিলেন মাশরাফির বলে, তার আগে ৬৩ রান করে ফিরে গেছেন সবচেয়ে বিপজ্জনক হতে থাকা ইয়ান বেলও। হেলস, মরগান, টেলররাও বেশিক্ষণ থাকেননি। কিন্তু কে জানত, এই ম্যাচে অপেক্ষা করছে আরও অনেক অনেক রোমাঞ্চ।

তবে বাংলাদেশকে এই কুরুক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থেই রেখেছিলেন মাহমুদউল্লাহ। তিনি যদি অর্জুন হন, ভীম হয়ে তার পাশে ছিলেন মুশফিকুর রহিম। ওই বিশ্বকাপ মাহমুদউল্লাহর জন্য ছিল নিজেকে চেনানোর মঞ্চ। বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি কী, তা জানা ছিল না বাংলাদেশের। সেই ইতিহাস মাহমুদউল্লাহ তো গড়লেনই, সেটার জন্য সময়টাও এর চেয়ে বোধ হয় উপযুক্ত ছিল না।

জেমস অ্যান্ডারসনের সুইংয়ে তামিমদের তখন নাভিশ্বাস উঠছে, ৮ রানের ভেতরেই দুই উইকেট হারিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ। সৌম্যর পালটা আক্রমণে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু। তবে ৯৯ রানেই মধ্যে সৌম্য-সাকিবকে হারিয়ে বাংলাদেশ আবার খায় জোড়া ধাক্কা। অন্য অনেকবার এমন অবস্থা থেকেই খাদের অতলে পড়ে গিয়েছে বাংলাদেশ, আর উঠতে পারেনি। তবে সেদিন হয়েছিল অন্য কিছু।

মুশফিককে নিয়ে এরপর শুরু ঘুরে দাঁড়ানোর দ্বিতীয় অধ্যায়ের। দুজন মিলে যোগ করলেন ১৪১ রান, বাংলাদেশের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ জুটি। মাহমুদউল্লাহ সেঞ্চুরিও পেয়ে গেছেন তখন, স্ত্রী-পুত্রের জন্য ছুঁড়ে দিলেন উড়ন্ত চুমুও। মুশফিকও মনে হচ্ছিল পেয়ে যাবেন সেঞ্চুরি, শেষ পর্যন্ত ৭৭ বলে ৮৯ রানেই থামতে হলো। তবে পরিস্থিতির বিচারে সেটা অনেক সেঞ্চুরির চেয়েও মূল্যবান, বাংলাদেশ তো ২৭৫ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারল ওই ইনিংসের জন্যই। দিন শেষে ওই ১৫টা রানই যে হয়ে গেছে মহামূল্যবান! তাতেই লেখা হয়েছে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ-এপিটাফ, আর বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো দেখে পেয়েছে কোয়ার্টার ফাইনালের দরজার। ওই বছরে যে দেশের মাটিতেও প্রায় অজেয় হয়ে উঠল বাংলাদেশ, সেই রাস্তাটাও কি দেখিয়ে দেয়নি সেই জয়টা?

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এএম/এমআরপি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন