বিজ্ঞাপন

‘করোনাভাইরাসের ৩২৪ টি নমুনায় ৪১৬০ টি মিউটেশন পাওয়া গেছে দেশে’

October 14, 2020 | 8:16 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ৩২৪ টি নমুনা পরীক্ষা করে চার হাজার ১৬০টি মিউটেশন পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সেন্টারের মেডিকেল বায়োটেকনোলজির গবেষণায় এই ফলাফল পাওয়া যায়৷ এই ফলাফল বায়োআর্কাইভে আপলোড সার্ভারে আপলোড হয়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক জার্নালে পাবলিকেশনের জন্য জমা দেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (১৪ অক্টোবর) সারাবাংলাকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সেন্ট্রাল ফর মেডিক্যাল বায়ো-টেকনোলজি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মারুফুর রহমান অপু।

মারুফুর রহমান অপু বলেন, ৩০ মার্চ থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে জিএইসএইডে জমা দেওয়া ৩২৪টি নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) জিনোম সিকোয়েন্স আমরা বিশ্লেষণ করেছি। সেখানে আমরা দেখেছি মোট চার হাজার ১৬০টি মিউটেশন ঘটেছে। এর মধ্যে অ্যামাইনো অ্যাসিড পরিবর্তনকারী মিউটেশন পাওয়া গেছে দুই হাজার ২৫৩টি। এছাড়াও মুছে যাওয়া/ডিলিশন ৩৮টি এবং সংযোজন/ইনসারশন ১০টি মিউটেশন পাওয়া গেছে। আমরা এই সিকোয়েন্সগুলো বিশ্লেষণ করে এর মিউটেশনগুলোর সম্ভাব্য প্রভাব সংক্রান্ত ব্যাখ্যা সম্বলিত গবেষণাপত্রটি ১২ অক্টোবর বায়ো-আর্কাইভে আপলোড করেছি এবং আন্তর্জাতিক জার্নালে পাবলিকেশনের জন্য জমা দেয়া হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এই বিশ্লেষণ ভবিষ্যতে কী হবে সেটার বিষয়ে না বরং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জমা হওয়া নমুনার উপরে ভিত্তি করে যেখানে আমরা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কী কী হয়েছে সেটার ব্যাখ্যা দিয়েছি বলে মন্তব্য করেন ডা. মারুফ।

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা দেখেছি ইউরোপে প্রভাব বিস্তার করা D614G মিউটেশনটি বর্তমানে সারা বিশ্বেই মূল ধরন যেটি প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে ভাইরাসটি ছড়াচ্ছে। যে কারণে D614G মিউটেশনটি সারা বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত। মূলত বাংলাদেশে ৯৭% নমুনাতেই এই মিউটেশনটি আছে। মিউটেশনটির কারণে ভাইরাসটির বংশবৃদ্ধির সক্ষমতা বেড়ে যায় তবে কিছু গবেষণা অনুসারে জানা যায় বংশবৃদ্ধির সক্ষমতা বাড়লে বিপরীতক্রমে রোগের তীব্রতাও কমে। D614G এর কারণে মৃত্যু হার বাড়ে না কমে এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোন প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে P323L মিউটেশন হলে ভাইরাসটিতে মিউটেশনের হার আরও বেড়ে যায়৷ এছাড়াও আমরা দেখেছি প্রায় ৮৬ শতাংশ নমুনাতে R203K, G204R মিউটেশন দুটি রয়েছে। এরা N প্রোটিনের স্ট্যাবিলিটি কমালেও সম্ভবত কোষ থেকে ভাইরাসের বের হওয়াতে সুবিধা তৈরি করে।

তিনি আরও বলেন, আমরা দেখেছি সবগুলো নমুনার মাঝে সবচেয়ে বেশি যে মিউটেশনগুলো হয়েছে সেগুলো হলো 241C>T (৯৬%), 3037C>T (৯৮%), 14408C>T (৯৮%) এবং 23403A>G (৯৭%)। এই মিউটেশনগুলো প্রায় একইসাথেই ঘটেছে এবং শেষের দুটি আমাইনো এসিড চেঞ্জিং মিউটেশন (RdRp জিনে P323L এবং স্পাইক প্রোটিনে D614G)।

বিজ্ঞাপন

ডা. মারুফ বলেন, অধিকাংশ মিউটেশনই C>T অর্থাৎ নিউক্লিওটাইড C থেকে পরিবর্তিত হয়েছে T তে (৪১%)। এটি সম্ভবত সিলেক্টিভ মিউটেশন প্রেশারের কারণে যেখানে ভাইরাসটি তার জিনোম থেকে CpG অংশগুলো সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে যেন এই অংশগুলোকে টার্গেট করে যেসব ইমিউন রিএকশন হতো ভাইরাসটিকে মেরে ফেলতে সেগুলো কম হয়। এর ফলে সম্ভবত ভাইরাসটির বংশবৃদ্ধির হার বেড়ে যায় তবে রোগ লক্ষণের তীব্রতাও কমে যায়।

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণ বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশে সম্ভবত কয়েকবার কয়েকটি ভিন্ন জায়গা থেকে ভাইরাসটি এসেছে। ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসটি মূলত ইউরোপিয়ান ভ্যারিয়েন্টগুলোর সাথে সম্পর্কযুক্ত যা সরাসরি ইউরোপিয়ান দেশ বা মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপিয়ান দেশের নমুনাগুলোর সঙ্গে ক্লাস্টার তৈরি করেছে। আমাদের নমুনাগুলোর প্রায় ৮৬% ই 20B ক্লেডভুক্ত যা ইউরোপে (ইউকে, বেলজিয়াম সুইডেন) প্রভাব বিস্তার করেছিলো। আশেপাশের দেশগুলোতে চিত্রটি এমন নয় (ইউরোপিয়ান ভ্যারিয়েন্ট এর আধিক্য এত বেশি না)।

চট্টগ্রামে পাওয়া ভাইরাসের ধরণ বিষয়ে ডা. মারুফ বলেন, 19B ক্লেডটি যেটি মূলত চায়নাতে প্রভাব বিস্তার করেছিলো সেটি আমরা শুধু চট্টগ্রামের ৫টি নমুনায় পেয়েছি। সম্ভবত চট্টগ্রামে চায়না থেকে ভাইরাসটি সরাসরি বা অন্য দেশ হয়ে কোনভাবে এসেছিলো।

তিনি বলেন, এন্টিবডির মূল টার্গেট স্পাইক প্রোটিনের রিসেপ্টর বাইন্ডিং অংশটি। এ জায়গাটিতে বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্ত নমুনার কোনটিতেই কোন মিউটেশন ঘটেনি তাই আশা করা যাচ্ছে যদি কোনো কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয় তবে তা যে দেশ থেকেই আসুক তা এদেশে কাজ করবে।

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, নমুনাতে আমরা দেখেছি ORF7a এবং ORF8 জিনের বড় অংশ মুছে গেছে। ORF7a প্রোটিন না থাকলে সম্ভবত ভাইরাসটি দ্বারা সৃষ্ট রোগের তীব্রতা কম হয় এবং ORF8 না থাকলে ভাইরাসটির আমাদের ইমিউনসিস্টেম দ্বারা চিহ্নিত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

ডা. মারুফ বলেন, আমরা দেখেছি অনেকগুলো মিউটেশন B-Cell ও T-Cell এপিটোপ রিজিওনে হয়েছে যার ফলে হয়তো ইমিউন রিএকশনে পরিবর্তন হতে পারে। এছাড়াও আমরা RT-PCR টার্গেট এরিয়াগুলোতেও কিছু মিউটেশন পেয়েছি। এগুলোর কারণে RT-PCR ভিত্তিক ডায়াগনোসিসে কোন পরিবর্তন হয় কিনা সেটি গবেষণা সাপেক্ষ।

গবেষণাপত্রটি এখনো পিয়ার রিভিউড হয়নি জানিয়ে ডা. মারুফ বলেন, পিয়ার রিভিউড না হওয়া পর্যন্ত এটিকে চূড়ান্ত বিবেচনা করা উচিত হবেনা। আমাদের এই ফলাফলগুলোর উপরে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত প্রদান করবেন। সেই মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে আমরা আমাদের গবেষণাপত্রটি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধন করবো।

ডা. মারুফ বলেন, গবেষণাটি সম্পাদন ও গবেষণাপত্রটি লেখায় দুজন কো-অথর হিসেবে দারুণভাবে সহায়তা করেছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর ডা. শারমিন বিনতে কাদের ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিডিসি বিভাগের ইভ্যালুয়েটর ডা. এস এম শাহরিয়ার রিজভি। গবেষণা কাজের পুরো অংশই স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমআইএস শাখাধীন সেন্টার ফর মেডিকেল বায়োটেকনোলজি বায়োইনফরমেটিক্স ল্যাবে সম্পন্ন হয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত ২১ লাখ ১২ হাজার ৪৪৮টি নমুনা পরীক্ষা করে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৯৫৯ জনের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৪৪৯ জন কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৫ হাজার ৫৯৩ জন।

সারাবাংলা/এসবি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন