বিজ্ঞাপন

অসাম্প্রদায়িকতা চর্চায় শুধু সরকার নয়, সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে

October 26, 2020 | 10:09 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: দেশের সংবিধানেই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা আছে। সংবিধান যে মানবে না, সে এ দেশর নাগরিক নয়। আগামী প্রজন্মের মধ্যে এই ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে হবে। সে লক্ষ্যে লেখক-সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিককর্মীদের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। গ্রাম-গঞ্জ ও পাড়া-মহল্লার ক্লাবগুলোকে সচল করতে হবে। চাঙ্গা করতে হবে দেশের সব পাঠাগার। প্রতিটি ক্লাব ও পাঠাগারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন রাখতে হবে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনা অক্ষুণ্ন রাখতে সরকারকে যেমন দায়িত্বশীল হতে হবে, তেমনি প্রতিটি মানুষকে সামাজিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। ঘরে-বাইরে সবখানে অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

সোমবার (২৬ অক্টোবর) সারাবাংলা ডটনেটের নিয়মিত আয়োজন ‘সারাবাংলা ফোকাস’ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘সম্প্রীতির বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই ভার্চুয়াল আলোচনায় যুক্ত ছিলেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন; কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নাট্যগবেষক বিপ্লব বালা।

সারাবাংলা ফোকাস সঞ্চালনা করেন সারাবাংলা ডটনেটের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট এমএকে জিলানী। অনুষ্ঠানটি একযোগে সারাবাংলা ডটনেটের ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল ও বেসরকারি টেলিভিশন জিটিভি থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।

আলোচনায় কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, একটি শব্দে আমার প্রবল আপত্তি আছে— সংখ্যালঘু। আমাদের কেউ সংখ্যালঘু নয়। আমরা জাতিসত্তায় সবাই বাঙালি। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান— সব ধর্মের মানুষই আমরা জাতিসত্তায় বাঙালি। ধর্মের ভিত্তিতে কাউকে সংখ্যালঘু বলা যাবে না। ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আছেন, তারা জনসংখ্যায় একটু কম। তাই বলে তারা জনসংখ্যালঘু নয়। আমরা সবাইকে একভাবে দেখব।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, যারা অন্যের সম্পত্তি দখল করতে চায়, লোভ যাদের পিছু ছাড়ে না, তারা অনেকের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করেন। কারও বাড়ি দখল করা, কাউকে তাড়িয়ে দেওয়া— এ ধরনের আচরণ করেন। এটা মানবিক সত্যের কোনো জায়গা নয়। আমরা মনে করব, বাংলাদেশের মানবিক সত্যের জায়গাটা সেটি, যেখানে আমরা বয়সীরা যেভাবে দেখব, আমাদের তরুণ প্রজন্মের যারা ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে, তাদের মধ্যেও যেন চিন্তা-চেতনায় সম্প্রীতির জায়গাটা অক্ষুণ্ন থাকে।

এই কথাসাহিত্যিক বলেন, আমাদের দেশটি আমরা যদি ধর্মনিরপেক্ষতার অবয়বে বড় করে রাখি, মনুষ্যত্বের মূল্যবোধের জায়গাটিকে পরিচ্ছিন্ন রাখি, তাহলে সব মানুষের অধিকারকে সমানভাবে স্বীকৃতি দেবো। তিনি যেকোনো ধর্মেরই হতে পারেন, তাতে কিছুই যায়-আসে না। আমরা মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা জানি— সবকিছুকেই একভাবে দেখব। এর মধ্য দিয়ে আমরা সামাজিক মূল্যবোধের ভেতরটাকে আলোকিত করব।

সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত থাকার প্রসঙ্গ টেনে সেলিনা হোসেন বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানের চারটি মূলনীতির একটি করেছেন। ফলে সংবিধান অনুযায়ী চলতে হলেও আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতাকে মেনে চলতে হবে। আমরা যারা সাংস্কৃতিককর্মী বা লেখালেখি করি, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তারাও যে জোর দিয়ে আসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে কিছু করেছি, তা বলতে পারব না। আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সংবিধানের চার নীতির একটি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে পরবর্তী প্রজন্মকে তৈরি করতে পারতাম, কিন্তু সেটা হয়নি।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, সামাজিক মূল্যবোধের জায়গাটিকে তরুণ প্রজন্মের মাঝে আমরা ছড়িয়ে দিতে পারিনি। যদি আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সঠিকভাবে চর্চা করি, শুধু মুখের কথা দিয়ে নয়, যদি আমরা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শক্তিটা অর্জন করি, সামাজিক মূল্যবোধের জায়গায় হয়তো উত্তরণ ঘটবে। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পরও কিন্তু তা বন্ধ হচ্ছে না। মূল্যবোধের যে অবক্ষয়, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে হয়তো অবস্থার উত্তরণ ঘটবে। আমরা যারা রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরের মানুষ, জনগণের সঙ্গে প্রতিনিয়ত মিশছি, তারা কিন্তু সেভাবে বলছি না। বক্তৃতা দিয়ে শেষ করার পর আর তরুণ প্রজন্মকে সেটি আয়ত্ত করতে বলছি না।

সেলিনা হোসেন আরও বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনা অক্ষুণ্ন রাখতে সরকারকে যেমন দায়িত্বশীল হতে হবে, তেমনি প্রতিটি মানুষকে সামাজিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে। আমি আমার স্বাধীনতা পদকের তিন লাখ টাকা একটি স্কুলে দান করেছি। বলেছি, যেন একটি শিশু অর্থের অভাবে ড্রপ আউট না হয়। কিন্তু সেটুকুই যথেষ্ট নয়। আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশতে হবে। তাদের যদি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনা সম্পর্কে জানাই, তাহলে হয়তো শিক্ষার্থীরা এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবে।

সাংস্কৃতিক সংগঠক ও নাট্য গবেষক বিপ্লব বালা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে অস্থায়ী সরকারের প্রধান তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘কে সংখ্যালঘু? ওহ আচ্ছা, বাঙালি দেশে অবাঙালিরা তো সংখ্যালঘু। তাদের প্রতি আমাদের মানব মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখব। অবাঙালি সংখ্যালঘু হলেও তাদের মানবাধিকার ও মানব মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখব।’ সেটা তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন। কিন্তু পরে আর আমি এটি কারও কাছ থেকে শুনিনি। পাকিস্তান তো আমাদের সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরুই শিখিয়েছে। কাজেই বিষয়টি আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকে গেছে।

তিনি বলেন, আমরা কতগুলো কথা বলছি, নীতির কথা বলছি, অনুভবের কথা বলছি। কিন্তু ভেবে দেখতে হবে, এই কথাগুলোর মানে থাকছে কি না। একসময় ছিল। স্বাধীনতার ৯ মাসে এ দেশের যা কিছু মধুর, সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে পাকিস্তান। সেটা কখনোই আর মেরামত করা যাবে না। স্বাধীনতার পর দেশে যেভাবে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলার কথা ছিল, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তাতে ব্যর্থ হয়েছি।

বিজ্ঞাপন

বিপ্লব বালা আরও বলেন, নাটকের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িকতার বাংলাদেশের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। আমরা যা ভাবতাম, সেগুলো স্বপ্ন ছিল।

কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীকার আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছে। সেগুলোর অনেকটাই মঞ্চে হয়েছে। কিন্তু সেইসব আন্দোলনের মূল বিষয়টি আমাদের বাড়ির ভেতরে চর্চা হয়নি। আমরা যারা মঞ্চে একত্রিত হতাম— হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান— তাদের কিন্তু পারিবারিকভাবে যোগাযোগগুলো সেভাবে ছিল না।

তিনি বলেন, আমরা একাত্তরে নতুন একটি রাষ্ট্র গড়েছি, কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের কাজটায় আমরা হাত দিতেই পারিনি। সমাজ পরিবর্তন যদি না হয়, রাষ্ট্র পরিবর্তন করে আমরা মানুষের যে বৈশিষ্ট্যের কথা বলছি, সমাজ-সংস্কৃতির, সেই কাজগুলোকে সংস্কার বা পরিবর্তনের কাজটি আমরা অগোছালোভাবে রেখে দিয়েছি। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একটি জোরালো চেতনা ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ইত্যাদির জন্যে। কিন্তু সমাজের ভেতরে এই ধর্মনিরপেক্ষতাকে কিভাবে ধরব, এর অর্থ কী হবে— এসব নিয়ে আলোচনা হয়নি। এমনকি আমাদের একাডেমিয়াতে এগুলো নিয়ে খুব আলোচনা কিংবা তর্ক-বিতর্ক হয়নি। ফলে বাঙালি মুসলমান যে সংকটে ছিল তার আত্মপরিচয়ে, সেটা উত্তরোত্তর বেড়েছে।

আবুল মোমেন আরও বলেন, আমরা যারা দ্বিজাতি তত্ত্ব মানিনি, তারা নতুন রাষ্ট্র চেয়েছিলাম। কিন্তু একাত্তর কিংবা তারও আগে যারা ৪৭ (১৯৪৭, ভারত ভাগ) চেয়েছে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতের বিপক্ষে গিয়েছে, তারা হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করছিল। তারা সম্প্রতির বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি। এবং পঁচাত্তরের পর যখন জিয়াউর রহমান নিজে ক্ষমতা গ্রহণ করলেন, তার ক্ষমতাকে পোক্ত করার জন্য যেসব শক্তির ওপর নির্ভর করেছেন, তারা ছিল পাকিস্তানপন্থি, জামায়াতে ইসলামী ও বাংলাদেশবিরোধী শক্তি। এইখানে তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত হলেন। ধীরে ধীরে দেশের রাজনীতিতে আবারও ধর্মের ব্যবহার শুরু হলো। আমরা মুখে আসম্প্রাদায়িকতার কথা বলি, কিন্তু মুখে বা চেহারায় নিজের ধর্মীয় লেবাস প্রকাশ করি। কিন্তু আগে ধর্মের বিষয়টি ঘরের বাইরে আসত না।

তিনি আরও বলেন, আগে প্রচুর নাটক হতো। নাটক করে অনেকে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারের লোকেরা গ্রাম-গঞ্জের নাটককে ছোট করে দেখতেন। পরে আস্তে আস্তে নাটক উঠে যায়। সেই যায়গাট দখল করে নেয় মৌলবাদীরা। আজকের দিনে গ্রামে কিন্তু ওয়াজ মাহফিল ছাড়া কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নেই। ফলে সমাজ থেকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড উঠে যাচ্ছে। কোনো পাড়ার ক্লাব কার্যকর নেই। এলাকাভিত্তিক ক্লাবগুলো সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা করছে না। ফলে সমাজটা হঠাৎ করে সংস্কৃতিবিহীন হয়ে গেল। সেখানে বিনোদনের জন্য তারা ভোগের দিকে যাচ্ছে। পর্নোগ্রাফি, আজেবাজে সিনেমা দেখছে এবং ধর্মান্ধতা শিখছে। ধর্মান্ধতা ও ভোগবাদ— এ দু’টোর মধ্যে তাদের বিনোদনের জগতটা আটকে গেল। চূড়ান্ত অবক্ষয় এবার ঘটে গেল। সুস্থ সংস্কৃতির কথা বলছি, কিন্তু সেটার বিকাশ ঘটেনি। তাই গ্রামে গ্রামে কিংবা পাড়ায় পাড়ায় যে ক্লাবগুলো ছিল, সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। পাঠাগারগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা বাড়াতে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত আরও বেশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে।

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন