বিজ্ঞাপন

প্রবাসীর মামলার আসামি রিজেন্সি হোটেলের এমডি, রামপুরার ওসি

November 2, 2020 | 12:54 pm

সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ‘ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে’র ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) বিরুদ্ধে বিনিয়োগের কথা বলে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ এনেছেন ‍যুক্তরাজ্য প্রবাসী এক বাংলাদেশি। তার অভিযোগ, প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে প্রতিবাদ করতে গিয়ে উল্টো হয়রানি ও শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। আর অর্থের বিনিময়ে রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং অন্য পুলিশ সদস্যরা এসব হয়রানি ও লাঞ্ছনায় জড়িত ছিলেন। এসব অভিযোগে রিজেন্সি হোটেলের এমডিসহ ওই হোটেলের ১৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন তিনি। রামপুরা থানার ওসিসহ আট পুলিশ সদস্যকেও ওই মামলার আসামি করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাজ্য প্রবাসী ব্যবসায়ী মো. মোহিদ আলী মিঠু গত ১৫ অক্টোবর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে মামলাটি দায়ের করেন। গতকাল রোববার (১ নভেম্বর) ঢাকার মহানগর হাকিম কনক বড়ুয়া মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)।

নির্দিষ্ট অর্থ বিনিয়োগে কোম্পানির পরিচালনা পর্যদে রাখা হবে— এমন প্রস্তাবে বিনিয়োগ করে প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে মামলায় অভিযোগ করেছেন মোহিদ আলী। এ ক্ষেত্রে রিজেন্সি হোটেলের এমডি, নির্বাহী পরিচালক, মহাব্যবস্থাপকসহ হোটেলের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অভিযুক্ত করেছেন তিনি। অন্যদিকে রামপুরা থানার ওসিসহ বাকি পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ, রিজেন্সি হোটেলের এসব অভিযুক্তদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাকে থানায় নিয়ে মারধর করেছেন। পুলিশ সদস্যরা এর জন্য ১১ লাখ টাকা নিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন মোহিদ।

রিজেন্সি হোটেলের যাদের মামলায় আসামি করা হয়েছে তারা হলেন— ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ, নির্বাহী পরিচালক আরিফ মোতাহার, কবীর রেজা, ফাহিম আরিফ মোতাহার, নাজমা আরিফ, রোকেয়া খাতুন, জেবুন নেছা, মহাব্যবস্থাপক সহীদুল হামিদ, কোম্পানি সচিব মিজানুর রহমান এবং নাঈম মর্তুজা, শুভ ওরপে শান্তনু ধর, নাজমু সিদ্দিকী সানি, লাভলু, ফারহানা ঐশী, আরমান, শাহীন, জয়নাল রাজা এবং নকিবুল ইসলাম।

বিজ্ঞাপন

মামলায় যেসব পুলিশ সদস্যদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন— রামপুরা থানার ওসি আব্দুল কুদ্দুস ফকির, এসআই তওফিকা ইয়াসমিন, এসআই সুলতানা আক্তার, এসআই মো. হানিফ, এএসআই আবুল হোসেন, এএসআই হাফিজ, এএসআই বিল্লাল ও এএসআই মো. আতোয়ার রহমান।

মামলার এজহারে বলা হয়েছে, রিজেন্সি হোটেলের এমডি মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ এবং নির্বাহী পরিচালক আরিফ মোতাহার ও কবীর রেজা দেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের অর্থায়নে ‘ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট’ নামে বাংলাদেশে একটি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণেরর জন্য বিনিয়োগ সংগ্রহে ২০০৫ সালে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার শুরু করেন। ওই প্রচারণায় উল্লেখ করা হয়, প্রবাসী বাংলাদেশিরা ২৫ হাজার পাউন্ড বা এর সমপরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করলে কোম্পানির পরিচালনা পদ দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে বিনিয়োগকারী প্রবাসীরা যুক্তরাজ্য থেকে আসার জন্য প্রতিবছর দুইটি বিজনেস ক্লাস এয়ার টিকিট এবং বাংলাদেশে অবস্থানের সময় হোটেলে থাকা-খাওয়ার সুযোগ পাবেন।

এজাহারে মোহিদ আলী মিঠু বলেন, এমন প্ররোচনায় আকৃষ্ট হয়ে তিনিসহ ১২০ জন ‘ঢাকা রিজেন্সি হোটেল’ নামের ওই প্রজেক্টে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। ব্যবসায়ী মিঠু নিজেই দুইটি শেয়ার বাবদ ৫০ হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড (৫৮ লাখ টাকা) বিনিয়োগ করেন। এ টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে কোম্পানির সঙ্গে ২০০৫ সালের ২০ নভেম্বর এবং ২০০৬ সালের ২০ জানুয়ারি দু’টি শেয়ারহোল্ডার সংক্রান্ত চুক্তি করেন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের গ্রুপ ‘বি’তে রাখা হয়, মামলার আসামিদের মধ্যে যারা পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক রয়েছেন, তাদের রাখা হয় গ্রুপ ‘এ’তে।

বিজ্ঞাপন

এজাহারে অভিযোগ, চুক্তি অনুযায়ী গ্রুপ ‘এ’ ও ‘বি’-এর সদস্যদের নিয়ে যৌথভাবে বোর্ড গঠন করার কথা থাকলেও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে এমডি মুসলেহ উদ্দিন ও তার স্ত্রী জেবুন নেছা; নির্বাহী পরিচালক আরিফ মোতাহার, তার স্ত্রী নাজমা আরিফ এবং ছেলে ফাহিম আরিফ মোতাহার এবং আরেক নির্বাহী পরিচালক কবীর রেজা ও তার স্ত্রী রোকেয়া খাতুন মোট সাত জন মিলে বোর্ড গঠন করেন। এরপর তারা গ্রুপ ‘বি’-এর পরিচালকদের না জানিয়ে কোম্পানির নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নিজেরাই আত্মসাৎ করেন। এক পর্যায়ে তারা ২০ কোটি টাকা কোম্পানির অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়ে গিয়ে নিজেদের অ্যাকাউন্টে রাখেন। এসব অর্থের কোনো হিসাব চাইলেও তারা হিসাব দিতে চরম অনীহা দেখান।

এজহারে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রায় ১২ বছর কোম্পানির আয়-ব্যয়ের হিসাব চেয়েও না পেয়ে ২০১৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগের কোম্পানি বেঞ্চে গ্রুপ এ তথা পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে ‘কোম্পানি ম্যাটার’ সংক্রান্ত তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলাগুলো শুনানির কার্যতালিকায় এলে মামলা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই ব্যবসায়ী মোহিদ আলী মিঠু যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে আসেন। এসময় মামলার আসামিরা মিঠুর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশে এলে মিঠুকে মেরে লাশ গুম করার হুমকিও দেওয়া হয়।

অভিযোগপত্রে বাদী অভিযোগ করে বলছেন, ২০১৯ সালের ৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মিঠু বনশ্রীতে তার এক আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াত খেতে যান। ওই সময় এমডি মুসলেহ উদ্দিন এবং নির্বাহী পরিচালক রেজা ও আরিফ মোতাহারের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে রামপুরা থানার এএসআই মো. আতোয়ার রহমান, বিল্লাল, হাফিজ ও আবুল হোসেন মিঠুর আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে তাকে বলেন, রামপুরা থানার ওসি তার সঙ্গে দেখা করতে চান। সেখান থেকে মিঠুকে রামপুরা থানায় নেওয়ার পর ওসি আব্দুল কুদ্দুস ফকিরের নির্দেশে ব্যবসায়ী মিঠুকে মারধর করে তার কাছে থাকা আইফোন ও নকিয়া ফোন নিয়ে নেওয়া হয়। এ সময় মিঠুর হাতে থাকা প্রায় ১০ লাখ টাকা দামের ওমেগা ব্র্যান্ডের একটি সোনার হাত ঘড়ি নিয়ে নেন এসআই তৌফিকা ইয়াসমিন। পরে মিঠুকে থানা হাজতে বন্দি রাখা হয়। কোনো আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গেও দেখা করতে দেওয়া হয় হয় না। পরদিন ১০ জুলাই তাকে আদালতে নেওয়ার সময় তার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া মোবাইল ও ঘড়ি ফেরত চাইলে এসআই সুলতানা আক্তার মিঠুকে জানান, জামিন পাওয়ার পর সেগুলো ফেরত নিতে পারবেন। রামপুরা থানার ভুয়া মামলায় দেড় মাস পর জামিনে মুক্তি পেলেও মিঠু তার ব্যক্তিগত জিনিসগুলো ফেরত পাননি। এ বিষয়ে ডিএমপি সদর দফতর তদন্ত শেষ করে চলতি বছরের ২০ জুন পুলিশ সদর দফতরে তদন্ত প্রতিবেদনও পাঠায়। তবু মালামালগুলো ফেরত পাননি বলে অভিযোগ মিঠুর।

বাদী মিঠু আরও অভিযোগ করেন, ঢাকা রিজেন্সি হোটেলের আসামিরা তাকে হেনস্থা করতে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ধানমন্ডি, আশুলিয়া, সূত্রাপুর, হরিনাকুন্ড, কালিয়াডাঙ্গা ও ফরিদপুর থানায় মামলা দিয়েছিল। সেসব মামলায় অব্যাহতি পেয়েছেন তিনি। ভুয়া মামলাগুলোয় আনা অভিযোগের কোনোটিই আদালতে প্রমাণিত না হওয়ায় হয়রানির শিকার মিঠু গত ২ সেপ্টেম্বর পাল্টা মামলা দায়ের করেন, যেটি বর্তমাসে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করছে।

বিজ্ঞাপন

বাদী মিঠুর অভিযোগ, গত ৭ সেপ্টেম্বর মামলা তুলে নিতে এবং শুনানিতে অংশ না নিয়ে যুক্তরাজ্যে চলে যেতে মিঠুকে আসামি কবির রেজা, নাইম মর্তুজা ও শুভ হুমকি দেন। তারা জানান, বিদেশে চলে না গেলে মিঠুকে ফের থানা পুলিশ দিয়ে হেনস্থা করা হবে এবং প্রয়োজনে খুন করে লাশ গোপন করে ফেলা হবে। এসব অভিযোগ নিয়ে গত ১৫ অক্টোবর রামপুরা থানায় মামলা দিতে গেলেও মামলা নেয়নি থানা। শেষ পর্যন্ত সিএমএম আদালতে গিয়ে মামলা করেছেন প্রবাসী ব্যবসায়ী মিঠু।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল কুদ্দুস সারাবাংলাকে বলেন, ঘটনা সত্য। অনেক পুরোনো ঘটনা। কিন্তু এটি তদন্তাধীন বিষয়। এটি নিয়ে এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারব না।

তবে মামলায় আসামি হিসেবে উল্লেখিত ‘ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুসলেহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে। রিজেন্সি হোটেলের অন্য পরিচালকদের সঙ্গে যোগাযোগ করাও সম্ভব হয়নি।

সারাবাংলা/এসএইচ/টিআর

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন