বিজ্ঞাপন

সর্বোচ্চ সাজাতেও কমেনি ধর্ষণ, প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার

November 13, 2020 | 8:17 pm

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: সারাদেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী তীব্র জনমতের মুখে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করে সরকার। জরুরিভিত্তিতে এই সাজা কার্যকর করতে গত ১৩ অক্টোবর অধ্যাদেশ জারি করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তবে সর্বোচ্চ এই সাজার বিধান কার্যকরের পরও ধর্ষণের ঘটনা খুব একটা কমেছে— এমনটি বলা যাচ্ছে না। কেননা যে মাসে এই সাজা কার্যকর হয়েছে, সেই অক্টোবর মাসেও সারাদেশে ৩৭৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যা এ বছরের মধ্যে একমাসে সর্বোচ্চ ধর্ষণের ঘটনা। আবার চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম ১০ দিনেও ৫০ জনের বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাজা বাড়ানোর পর এর একটি প্রভাব ধীরে ধীরে পড়বে। তবে শুধু সাজা ধর্ষণ প্রতিরোধে যথেষ্ট নয়। সমাজে নারীর অবস্থান ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে না পারলে ধর্ষণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। পাশাপাশি ধর্ষণসহ নারী নির্যাতন ও যৌন হয়রানির ঘটনায় আইন প্রয়োগ সংক্রান্ত অবকাঠামোগত কিছু সংস্কার প্রয়োজন। পাশাপাশি ধর্ষক বা ধর্ষণচেষ্টায় জড়িতদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও কাজ করা উচিত।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, গত অক্টোবর মাসে সারাদেশে ৩৭৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬৯ জন। এই ঘটনাগুলোর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন তিন জন, আত্মহত্যা করেছেন একজন নারী। এর বাইরেও অক্টোবর মাসে ১১০ জন নারীর ওপর ধর্ষণচেষ্টা করা হয়েছে।

এ সংক্রান্ত আরও খবর-

এখন থেকে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড: অধ্যাদেশ জারি

বিজ্ঞাপন

আসকের তথ্য বলছে, অক্টোবর মাসের এই পরিসংখ্যানসহ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ মাসে সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ১ হাজার ৩৪৯ জন নারী। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৭৭ জন নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৬ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১৩ নারী।

আসক জানিয়েছে, গত ১০ মাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন আরও ২৭১ নারী। এর মধ্যে যৌন হয়রানির কারণে ১২ জন আত্মহত্যা করেছেন। আর যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন তিন জন নারী এবং ৯ জন পুরুষ।

বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত বলছে, চলতি নভেম্বর মাসেরও প্রথম দিনেও সারাদেশের বিভিন্ন থানায় ধর্ষণের অভিযোগে ৫২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সে হিসাবে প্রতিদিন পাঁচটিরও বেশি ধর্ষণের মামলা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পরও ধর্ষণ কমছে না কেন— জানতে চাইলে অনলাইন পোর্টাল ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের সম্পাদক মুনমুন শারমিন শামস সারাবাংলাকে বলেন, মৃত্যুদণ্ডের ভয় দেখিয়ে কোনোদিন ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে না। সবাই যতটুকু প্রত্যাশা করছে, তার কিছুই হবে না। বরং আইনটার অপপ্রয়োগ হবে। আমরা ধর্ষণের সংজ্ঞাটাই বুঝিনি। একটি লোক এই সমাজে যখন বেড়ে ওঠে, তখন তার বেড়ে ওঠাটাই তো ধর্ষক হয়ে বেড়ে ওঠা। সোসাইটির যে চিন্তাভাবনা, যে মানসিকতা, চিন্তার জগত, মেয়েদেরকে দেখার যে দৃষ্টি— এসব যদি বদলানো না যায়, তাহলে কঠোর আইন করেও কিছুই হবে না। কঠোর আইন করে তো খুন, ছিনতাই, রাহাজানি ও নানান অপকর্মও বন্ধ করা যায়নি। তাই ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে পুরো সোসাইটির আপাদমস্তক পরিবর্তন দরকার। সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।

তিনি আরও বলেন, এই আইনের ফলে যে ধর্ষণ কমবে না, তা নয়। অবশ্যই কমবে। সরকার যদি মনে করে একমাসে ১০০ জন ধর্ষণের শিকার হলো, আরেক মাসে তা থেকে কমে ৯০ হলো। তাহলে সংখ্যাগত দিক থেকে ধর্ষণ কমছে। কিন্তু তাতে কি আদৌ কোনো লাভ হলো? ধর্ষণ কি বন্ধ হলো? কিন্তু যদি সোসাইটিকে পরিবর্তন করা যায়, তাহলে কিন্তু ৯০ শতাংশ ধর্ষণ কমে যাবে।

আরও অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও ধর্ষককে চিহ্নিত করা এবং তাকে নজরদারির মধ্যে নিয়ে আর প্রক্রিয়াটি চালু করা প্রয়োজন বলে মনে করেন মুনমুন শারমিন। তিনি বলেন, যারা ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা চেয়ে আন্দোলন করেছে, তারা তাদের আবেগের জায়গা থেকে চেয়েছে। তাদের চাওয়ার জায়গাতেও দুর্বলতা ছিল। কিন্তু উন্নত বিশ্বে কী হচ্ছে, তা দেখতে হবে। যেমন বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকায় ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। তারা ফাঁসির দাবি করছে না। তারা চাইছে, ধর্ষককে যেন মনিটরিং করা হয়। উন্নত বিশ্বে একজন ধর্ষকের শরীরে মাইক্রোচিপ লাগিয়ে দেওয়া হয়। তাকে সবসময় মনিটরিং করা হয়। থানায় গিয়ে হাজিরা দিতে হয়।

মুনমুন শারমিন শামস আরও বলেন, উন্নত বিশ্বের আদলে আমাদের দেশে একজন ধর্ষককে চিহ্নিত করতে কোনো না কোনো পন্থা অবলম্বন করতে হবে। তাকে শাস্তির পাশাপাশি মনিটরিং করতে হবে। চাকরিতেও প্রভাব ফেলতে হবে, যেন তাকে দেখে অন্যরা ধর্ষণের মানসিকতা থেকে দূরে সরে আসতে পারে। আবার যে ধর্ষক, তাকেও কাউন্সিলিং করতে হবে। তাহলেই এ দেশে ধর্ষণের সংখ্যা কমে আসতে পারে।

বিজ্ঞাপন

জানতে চাইলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিষদের মহাসচিব মো. নুর খান সারাবাংলাকে বলেন, জনগণের দাবির মুখে সরকার আইন সংশাধনের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে জনঅসন্তোষ কমানোর কৌশল হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু আসক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, কেবল সাজা বাড়িয়ে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্যতম সামাজিক অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব নয়।

তবে ধর্ষণের মতো অপরাধ নির্মূল করতে হলে কী করণীয়— জানতে চাইলে নুর খান বলেন, এ জনমতকে কাজে লাগিয়ে বরং ধর্ষণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার আনার জন্য সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এক ধরনের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে নারীকে ধর্ষণ করা হয়, ধর্ষণের শিকার নারীকে সামাজিকভাবে দোষী সাব্যস্ত করে তার বেঁচে থাকা দুর্বিষহ করে তোলা হয়, ন্যায়বিচার চাইতে গিয়ে ভুক্তভোগীকে পদে পদে প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়— এসব বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। একজন মানুষ ধর্ষক হিসেবে জন্ম নেয় না। বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো তাকে ধর্ষক করে তোলে। এ কাঠামোর পরিবর্তন সম্ভব না হলে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সুদূর পরাহত।

আসক বলছে, ভুক্তভোগীর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আইনের সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু সেক্ষেত্রে শাস্তি বাড়ালেই মূল সমস্যার সমাধানে অগ্রগতি আসবে না। বিদ্যমান আইনের অধীনেই শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থাকলেও দেশজুড়ে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনার বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রসিকিউশন, তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার নানা ফাঁকফোকর দিয়ে অভিযুক্তরা পার পেয়ে যাচ্ছে। ভুক্তভোগীরা নানা ভোগান্তি আর হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তাই আসক মনে করে, আইনের অন্যান্য সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে এ সংক্রান্ত আইনগুলোকে যুগোপোযোগী করতে হবে। আইনের আশ্রয় ও বিচারলাভের ক্ষেত্রে কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা নিরসন করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে আইনি ও কাঠামোগত সংস্কারও করতে হবে।

আসক নির্বাহী পরিষদের মহাসচিব বলেন, আইনি সংস্কার আনার ক্ষেত্রে সরকারকে অবশ্যই ধর্ষণের সংজ্ঞাকে বিস্তৃত করতে হবে। সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য ধারা সংশোধন করতে হবে। দ্রুত সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, ভুক্তভোগীর জন্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত, শিক্ষা কারিকুলামে পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে।

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন