বিজ্ঞাপন

ঘরময় পৃথুলা, শূন্য মায়ের চোখ

March 14, 2018 | 9:39 pm

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলে বাঁ দিকে কাঠের দরজা। ফ্ল্যাটটিতে অনেকগুলো কক্ষ। একটি কক্ষে বিছানায় শুয়ে মাঝ বয়সী এক নারী। পুরো ঘর, বাড়ি ভরা মানুষ- তবু তিনি কাকে যেন খুঁজছেন এত মুখের ভিড়ে। মাঝে মাঝে স্তব্ধতা ভাঙছে কেবল কান্নার রোল, বিলাপ।

ক’জন নারী কোরআন পড়ছেন। বাকি সবাই কোণার একটি ঘরে। বিছানায় শুয়ে বিলাপ করছেন রাফেজা বেগম। কেউ তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, কেউ চেষ্টা করছেন একটু পানি খাওয়াতে। গত তিনদিন ধরে তিনি কিছু মুখে তোলেননি। কিন্তু কোনো কিছুতেই তার মন ভরছে না। বুক চাপড়ে বিলাপ করছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। কিন্তু সব পরিচয় ছাপিয়ে রাফেজা বেগম এখন পৃথুলার মা, পাইলট পৃথুলা রশিদ ছিলেন রাফেজা বেগমের একমাত্র মেয়ে।

মিরপুর ডিওএইচএস-এ পৃথুলাদের বাসায় গিয়ে বুধবার (১৪ মার্চ) ছিল এই দৃশ্য। পৃথুলার বাবা আনিসুর রশীদ কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ। স্বজনরা জানান, পৃথুলার প্রতিটি কাজের সঙ্গী ছিলেন বাবা আর মা। স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে চাকরিতে ঢোকার পরও বাবা মেয়েকে একা বেরুতে দিতেন না। যদিও মা চাকরিজীবী আর বাবা ব্যবসায়ী।

বিজ্ঞাপন

পৃথুলার খালাতো বোন তানজিমুল অঙ্কুর সারাবাংলাকে বলেন, পৃথুলার পোশাক কোনোদিন বুয়া ধুয়ে দেয়নি। খালু তার মেয়ের পোশাক নিজের হাতে ধুতেন, আয়রন করতেন।

গত সোমবার ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকে আনিসুর রশিদ আর রাফেজা বেগমের দিনগুলো থমকে গেছে। তাদের গোসল নেই, খাওয়া নেই, ঘুম নেই। ডায়াবেটিক আর থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত রাফেজা বেগম মেয়ের শূন্য ঘরে বিলাপ করে চলেছেন। গত রাতে তাকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে, আজ চিকিৎসক বাসায় এসে তাকে দেখে গেছেন।

বিজ্ঞাপন

পৃথুলার ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে বাম দেয়ালে আটকানো একটি বিশাল আকারের পোস্টার। পোস্টারটির একেবারে উপরে বাঁয়ে লেখা ফ্লাইট সেফটিবোম্বার্বাডিয়ার কিউফোরজিরোজিরো। তার পাশে উড়োজাহাজটির ককপিট প্যানেলের ছবি। ঘর জুড়ে মেয়ের জিনিসপত্র। তাই রাফেজা বেগমকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে পৃথুলার দৃশ্যমান সবকিছু একটি আলমিরার ভেতরে তোলা হচ্ছে- চোখের আড়ালে। তবুও তিনি বলেই চলেছেন, ‘আমার মেয়ে ছিল আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। মেয়ের ফ্লাইটে দেরি হলে আমি অফিস থেকেও ফিরতে দেরি করতাম, মেয়েকে ছাড়া যে এই ঘরে আমার কিছু করার নেই, মেয়ে ছাড়া ঘর যে আমার শূন্য মনে হতো। সেই মেয়েকে রেখে কেমন করে এই শূন্য ঘরে আমরা থাকব।’

রাফেজা বেগম বলেন, আমার মেয়ে ছিল শ্রেষ্ঠ মেয়ে। রাতে আমার ঘুম না আসা পর্যন্ত সে নিজের ঘরে যেত না, আমাকে প্রতি রাতে সে গুড নাইট বলে নিজের ঘরে যেত। কে এখন আমাকে ঘুম পারাবে- বুক চাপড়ে আর্তনাদ করতে থাকেন রাফেজা বেগম।

চাকরি শুরুর পর থেকে বেতনের পুরো টাকা মায়ের হাতে তুলে দিত, জানালেন তিনি। রাফেজা বেগম বলেন, বেতনের পুরো টাকাটা আমার হাতে দিয়ে বলতো, তুমি অনেক কষ্ট করছ-এই টাকা দুই হাতে খরচ করো, আমি সেটা চোখে দেখতে চাই।

আর তানজিমুল অঙ্কুর বলেন, এই পুরো পরিবারের টেক কেয়ার করতো পৃথুলা। আমার ধারণা, মেয়েকে ছাড়া খালা বেশিদিন টিকে থাকবেন না, তিনিও চলে যাবেন।

পৃথুলার পাইলট হয়ে ওঠার পেছনে অনুপ্রেরণা কী ছিল জানতে চাইলে অঙ্কুর বলেন, সব ঘরে পাইলট থাকে না। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই পাইলটদের প্রতি ছিল পৃথুলার অনেক আগ্রহ, সে অনেক কৌতুহলী ছিল এ সেক্টর নিয়ে। আর এ সংসারে কেউ কারো ওপর কিছু চাপিয়ে দেয় না, সবাই সবার ইচ্ছেকে সম্মান করে। তাইতো নর্থ সাউথে পড়ার পর যখন পৃথুলা এ বিষয়ে পড়তে চাইলো তখন তাকে না করা হয়নি। ‘পাইলট হওয়াটা ছিল পৃথুলার চয়েস, সে কেবল পাইলটই হতে চেয়েছিল জীবনে।’

আর রাফেজা বেগম বলছিলেন, ‘পৃথুলা আমাকে আর ওর বাবাকে নিয়ে থাইল্যান্ড আর সিঙ্গাপুর যেতে চেয়েছিল। বলেছিল, তোমাদের দুনিয়া ঘোরাব, দুনিয়া ঘোরানোর কথা বলে মেয়েটা আমার কই গেল।’

সারাবাংলা/এটি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন