বিজ্ঞাপন

‘তখনও কেউ ধারণা করেনি— কতটা মেধাশূন্য হলো জাতি’

December 14, 2020 | 7:31 am

রাহাতুল ইসলাম রাফি, ঢাবি করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ‘গিয়াস সাহেব আমাকে এক প্রকার জোর করেই ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য করেন। তিনি খুব সাহসী লোক ছিলেন। ১৪ তারিখ তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তার মতো অনেককেই ধরে নিয়ে যায় পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরা। ধীরে ধীরে খবর পাওয়া যায়, অমুক শিক্ষককে পাওয়া যাচ্ছে না। অমুকে ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু তখনও কেউ ধারণা করেনি— কতটা মেধাশূন্য হলো জাতি। সময় গড়াতে থাকলে বোঝা যায় বীভৎস চিত্র। ১৮/১৯ দিন পর মিরপুরের বধ্যভূমিতে পাওয়া যায় গিয়াস সাহেবের লাশ।’— কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দকার বজলুল হক। যার কথা বলছিলেন, তিনি হলেন তারই এককালের সহকর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক শহিদ বুদ্ধিজীবী গিয়াসউদ্দিন আহমেদ।

বিজ্ঞাপন

শহিদ বুদ্ধিজীবী গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৭১ সালে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের হাউজ টিউটরের দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনি। থাকতেন হলের তিনতলায় পূর্বদিকের একটি বাসায়। অধ্যাপক বজলুল হক সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কনিষ্ঠ একজন শিক্ষক। পাশাপাশি তিনিও মুহসীন হলের হাউজ টিউওরের দায়িত্বে ছিলেন। যুদ্ধের মাঝপথেই মে মাসে নিজের স্ত্রী ও শ্বশুরকে হারান তিনি। এই পরিস্থিতিতে গিয়াসউদ্দিন তাকে ক্যাম্পাস ছেড়ে আরও নিরাপদ কোনো জায়গায় চলে যেতে জোর করেন। বলতে গেলে বাধ্য করেন। তবে ঢাবি শিক্ষক গিয়াসউদ্দিন নিজে কোথাও যাননি। থেকে গিয়েছিলেন মুহসীন হলের তিনতলার সেই বাসাতেই। ১৪ ডিসেম্বর সেখান থেকেই তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

শহিদ বুদ্ধিজীবী গিয়াসউদ্দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অধ্যাপক বজলুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডিসেম্বরের ১০ তারিখ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ত্যাগ করি। আর এক্ষেত্রে গিয়াসউদ্দিন সাহেবের ভূমিকা ছিল বেশি। ইতোমধ্যেই স্ত্রী-শ্বশুরসহ পরিবারের বেশ কয়েকজনকে হারিয়ে মানসিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত ছিলাম ‘

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর থেকে ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ পর্যন্ত গিয়াসউদ্দিন আহমেদসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত বিশজন শিক্ষককে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার চক্রান্ত সফল করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের টার্গেট করে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা। ১৪ ডিসেম্বর বেশ কয়েকজন গুণি শিক্ষককে তুলে নিয়ে যাওয়া পর তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তবে বেশ কয়েকদিন পেরিয়ে গেলে ধীরে ধীরে সেসব শিক্ষকদের লাশ পাওয়া যেতে থাকে।

বিজ্ঞাপন

অধ্যাপক বজলুল হক বলেন, ‘আমার জানা মতে, পরদিন ১৫ তারিখ তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। সেটা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সারাদেশের কোথাও দেখা যায়নি। ধীরে ধীরে সবাই জানতে শুরু করে অমুক শিক্ষককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে তো আরও পরে।’

মোটা দাগে, দুই পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের একদম শুরুর পর্যায়ে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ও ২৬ মার্চ বেশ অনেকজন শিক্ষককে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে ছিলেন- দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, আতাউর রহমান খান খাদিম, পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক এ এন এন এম মুনীরউজ্জামান, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের ফজলুর রহমান খান, ভূ-তত্ত্ব বিভাগের ঊর্ধ্বতন প্রভাষক মুহম্মদ আব্দুল মুকতাদির, গণিত বিভাগের প্রভাষক শরাফত আলী প্রমুখ।

পরে ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তিন অধ্যাপক ড. মুনীর চৌধুরী, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও ড. আনোয়ার পাশা, ইতিহাস বিভাগের তিন শিক্ষক ড. এম আবুল খায়ের, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ও সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য,  ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এস এম এ রাশীদুল হাসান, পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক সাইদুল হাসান, শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক ড. ন আ মফইজুল মহি ও সিরাজুল হক খানসহ বেশকয়েকজন শিক্ষককে নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়।

বিজ্ঞাপন

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন পাকিস্তানি মদদপুষ্ট সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন। অধ্যাপক বজলুর বলেন, ‘আমার ধারণা, সাজ্জাদ হোসায়েন এই হত্যাকাণ্ডগুলো সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি পাকবাহিনীর পুতুল ছিলেন এক প্রকার। সাজ্জাদ সাহেব মনেপ্রাণে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী লোক ছিলেন— এইটুকু তো সবাই জানি।’

শহিদ বুদ্ধিজীবী সিরাজুল হক খানকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে। তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের খ্যাতনামা শিক্ষক। তার পুত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ড. এনামুল হক খানের ভাষ্যে— ১৪ তারিখ ৫/৭ জন সশস্ত্র লোক এসে বাবাকে তুলে নিয়ে যায়। পরের বছর ৪ জানুয়ারি একটি গণকবর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। কোমরের বেল্ট, পরিহিত গ্যাবার্ডিন প্যান্ট, পকেটে থাকা পরিচয়পত্র দেখে তার লাশ শনাক্ত করা হয়।’

বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার সাক্ষ্যে সিরাজুল হক খানের পুত্র ড. এনামুল হক খান বলেন, ‘সেদিন কারফিউ ছিল। আমরা নিচে নেমে এসে কম্পাউন্ডের ভেতরে খোঁজখবর করছিলাম। আমরা জানতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা থেকে আরও বেশ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাদের ক্যাম্পাস থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের ডা. মর্তুজা এবং আরবি বিভাগের অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের শ্যালককে আগন্তুকেরা ধরে নিয়ে গেছে। সেদিন আমরা তেমন আর কোনো খোঁজখবর পাইনি। পরদিন ১৫ তারিখও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালীন এনএসআই কর্মকর্তা সামাদ তালুকদার, মিরপুর থানার ওসি ও একজন ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তার সহায়তায় বাবার লাশ শনাক্ত করতে সক্ষম হই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দীর্ঘ আট বছর দায়িত্বপালন করেন অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ সময় জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের আশেপাশে ছিলেন তিনি। সে সময়কার অবস্থা বর্ণনায় অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘তখন ক্যাম্পাস এক প্রকার জনশূন্য। আমরা শুনতে পাই ১৪ তারিখে অনেক শিক্ষককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে ঘটনা জানাজানি হতে একটু সময় লাগে। ধীরে ধীরে খবর আসতে থাকে চারদিক থেকে। পরে জানতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়েরই পাকিস্তানি মদদপুষ্ট কুলাঙ্গার কিছু শিক্ষার্থীর সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদাররা শিক্ষকদের তুলে নিয়ে গেছে।’

বিজ্ঞাপন

অধ্যাপক আরেফিন বলেন, ‘কোনো কোনো শিক্ষককে তারই কোনো শিক্ষার্থী এসে ডেকে নিয়ে গেছেন। নিজের ছাত্রকে অবিশ্বাস করতে পারেননি তারা। সরল মনে বেরিয়ে গেছেন।’

এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাপিডিয়ার তথ্যানুসারে, দীর্ঘ নয়মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকবাহিনী ও তার স্থানীয় সহযোগীরা সুপরিকল্পিতভাবে ৯৯১ জন শিক্ষক, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২জন আইনজীবী ও ১৬ জন লেখক-প্রকৌশলীকে হত্যা করে।

পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি। স্বাধীনতার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বঙ্গভবন থেকে তার নিজ হাতে লেখা ডায়েরি পাওয়া যায়। যেখানে অনেক নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া গেছে। আর পাকবাহিনীর এই নির্মম হত্যাযজ্ঞে সহায়তা করে তাদেরই দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী।

সারাবাংলা/পিটিএম

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন