বিজ্ঞাপন

‘বুদ্ধিজীবী তালিকার চেয়েও জরুরি তাদের চেতনার বাস্তবায়ন’

December 14, 2020 | 6:02 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৪টা। আল-বদরবাহিনী ডা. আবদুল আলীমকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। সারারাত নির্যাতনের পর ভোরে তাকে হত্যা করে বদরবাহিনী। তিনদিন পর ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে ডা. আবদুল আলীমের ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায়। তার বুকে অনেকগুলো গুলি এবং পুরো শরীরে ছিল নির্যাতনের চিহ্ন। কপালের বাম দিকে ও তলপেটে ছিল বেয়নেটের গভীর ক্ষত।

বিজ্ঞাপন

সেই শহিদ চিকিৎসক ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী। মাত্র দুই বছর বয়সে বাবাকে হারানো নুজহাত বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধ্যাপক। তিনি এখন তার বাবার আদর্শিক জায়গায় দাঁড়িয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন। শুধু তিনি নন, এরকম স্বপ্ন প্রায় সব শহিদ ‍বুদ্ধিজীবীর সন্তানদের।

২০২১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হবে। সম্প্রতি শহিদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে শহিদ পরিবারের সদস্যরা মনে করছেন, বর্তমান সময়ে বুদ্ধিজীবী তালিকা তৈরির পাশাপাশি জরুরি হলো সেই আদর্শ ও চেতনার বাস্তবায়ন, যার স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির সূর্যসন্তানেরা।

শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা. আবদুল আলীমের কন্যা ডা. নুজহাত চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সঙ্গে যদি বর্তমান সময়ের তুলনা করা হয় তাহলে আমরা আদর্শিক জায়গা থেকে অনেকটাই সরে এসেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়ে দেশে যেভাবে ইতিহাস বিকৃতি করা হয়েছে তার অনেক প্রভাবই পড়েছে। সেইসঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান অনেকাংশেই মদদ যুগিয়েছে মৌলবাদীদের। আমার বাবা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন সেই বাংলাদেশে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে চারটি মূলনীতির উপর পথ পাড়ি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে আমরা নেই। একজন বুদ্ধিজীবীর সন্তান হিসেবে আমি এখনও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়ে দেশে আসলে নেতৃত্বের অভাব ছিল। নানা রকম দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। এর পর থেকে আমরা পিছিয়েছি। বর্তমান সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যারর নেতৃত্বে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি- এটা ঠিক। কিন্তু এটা আসলে সবক্ষেত্রে হতে হবে। রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনীতি নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। আর এক্ষেত্রে আমাদের তরুণ সমাজের উপরেই নির্ভর করতে হবে। একমাত্র তরুণরাই পারে অসাম্প্রদায়িকতার মূল উৎপাটন করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। যে চেতনার স্বপ্ন আমার বাবা দেখেছিলেন। যার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন আমাদের দেশের বীর শহিদরা।’

শহিদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের সন্তান শমী কায়সার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে সংগ্রাম সেটা কিন্তু এক ধরণের সাংস্কৃতিক সংগ্রামও। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে নানাভাবে এখানে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে ভাটা পড়ে। রাষ্ট্রদ্রোহী, বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তি জামায়াত ইসলামকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়। বর্তমান সময়ে যখন আমরা দেখি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হচ্ছে তখন বুঝতে হবে সেই অপশক্তি কিন্তু থেমে নেই। কারণ বঙ্গবন্ধু মানেই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক। আর সেই প্রতীক ভাঙার সাহস একমাত্র জামাতের মতো অপশক্তির-ই রয়েছে। হয়তোবা তারা ভিন্ন নামে, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে করছে। সেই জায়গাটিতে আমাদের সংগঠিত হতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমি আশাবাদী একজন মানুষ। আমি মনে করি, তরুণদের একটি বড় অংশই এখন সচেতন। তা না হলে আদর্শিক জায়গা থেকে যদি বিবেচনা করি তবে আমরা অনেক আগেই হেরে যেতাম। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে সেই আদর্শের জায়গাতে এখনও টিকে আছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখন তৃণমূলে ছড়িয়ে দিতে হবে। তরুণ প্রজন্ম কিন্তু প্রযুক্তিনির্ভর। সেক্ষেত্রে প্রযুক্তির সাহায্যেই আমরা প্রান্তিক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে চেতনা ছড়িয়ে দিতে পারি।

বিজ্ঞাপন

শহিদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হানের ছেলে অনল রায়হান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মনে হয়, শহিদ বুদ্ধিজীবীদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়ার চাইতে অনেক বেশি জরুরি হলো- উনারা যে কারণে শহিদ হয়েছেন সেই চেতনার বাস্তবায়ন হওয়া। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি আমার কাছে এই স্বীকৃতি আসলে প্রথম প্রায়োরিটি না। আমার একমাত্র ভাবনার বিষয় হলো- শহিদ বুদ্ধিজীবীরা যে কারণে জীবন দিয়েছিলেন সেই কারণের জায়গায় ফিরে যাওয়া। দেশের জন্য সেই আদর্শ ও ভাবনার জায়গায় ফিরে যাওয়া। যেখান থেকে আমরা বর্তমানে যোজন-যোজন দূরে চলে এসেছি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু শুধুমাত্র পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধেই সীমাবদ্ধ ছিল না। একইসঙ্গে ছিল সেই আদর্শিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। যেখানে সাম্যবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন করা যাবে, যা হবে অসাম্প্রদায়িক। এজন্য কিন্তু আমাদের মূল চার নীতির দুটো হলো- ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা। সেই জায়গা থেকে অনেক দূরে এসে প্রায় ৫০ বছর পরে আমি দেখি যে, বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবকাঠামো সেই পাকিস্তান আমলের চেয়েও ভয়াবহ অবস্থার দিকে চলে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘৭৫ পরবর্তী সময়ে আমাদের আদর্শের জায়গায় অনেক বড় আঘাত এসেছে- এটা আমি বুঝি। এই সময়ে জিয়া ও এরশাদ এসে যাচ্ছেতাই করে গেছে। এই দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামগন্ধও ছিল না। একইসঙ্গে আমি এটাও বুঝতে পারছি যে, যারা বর্তমানে রাজনীতি করছেন তাদের মাঝে অনেকাংশেই একাত্তরের চেতনা অনুপস্থিত। এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে আসলে কিছু আশা করাও ভুল। সত্যি কথা বলতে আমাদের বর্তমানে আশার জায়গা শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিভিন্ন রকমের ঝুঁকি মোকাবিলা করেও উনি একক সিদ্ধান্তে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ বাস্তবায়ন করেছেন, যা এখনও চলছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে উনারও তো একটা সীমাবদ্ধতা আছে।’

অনল রায়হান বলেন, ‘আমি আশা করি না যে, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে রচিত সংবিধানের চার মূলনীতি তুড়ি মেরে বাস্তবায়ন করা যাবে বর্তমান পরিস্থিতিতে। কিন্তু আমার তো প্রক্রিয়াটা দেখতে পারা দরকার। যেমন নিজামি, মুজাহিদদের ফাঁসি হয়েছে। এর পরে আমার দেখতে পাওয়ার কথা ছিল জামায়াত ইসলামের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ হওয়া। এছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে এমন কিছু সিলেবাস অন্তভুর্ক্ত করা যেত যেখানে মান ধরে ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রতিস্থাপন করা যায়। একইসঙ্গে আমাদের দেখতে পারার কথা ছিল, দেশের বিভিন্ন থিয়েটার, সিনেমা হল থেকে শুরু করে দেশের বাইরের সিনেমা হলেও মুক্তিযুদ্ধের গল্প ছড়িয়ে পড়বে। সেভাবে হয়তো অনেকেই আগ্রহী হতো ইতিহাস নিয়ে, এগিয়ে যেত চেতনা বাস্তবায়নে।’

বিজ্ঞাপন

অনল বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু কোনো বায়বীয় বিষয় নয়। সাড়ে সাত কোটি জনগণের স্বপ্নের জায়গা। সেই জায়গাতে যদি বুদ্ধিজীবীদের চেতনা বাস্তবায়ন করা যায় তবে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হলো বা হলো না কেন?- তা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নাই। জহির রায়হানকে কেন মুক্তিযোদ্ধা বলা হলো না?- এটা যদি আজ থেকে ১০০ বছর পর কেউ কিছু নাও শুনে থাকে তবে সেও জহির রায়হানের নাম শুনলে বলবে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি। মূল কথা হলো আসলে চেতনার বাস্তবায়ন থেকে আমরা যোজন-যোজন দূরে চলে গেছি, এখনও যাচ্ছি।’

শহিদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দেশের মুক্তিযোদ্ধারা যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই জায়গা থেকে আমরা অনেকাংশেই পিছিয়ে রয়েছি। এছাড়াও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি শহিদদের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সরকার হয়তোবা চেষ্টা করছে। কিন্তু চেষ্টা ও প্রয়োগের মধ্যে ফারাক থেকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আর তাই আশা করছি, এমন পরিস্থিতিতে তরুণরাই এগিয়ে আসবে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধরে রেখে তারা সেই বাংলাদেশ গড়ে তুলবে, যার স্বপ্ন দেখেছিলেন আমার বাবাসহ সব মুক্তিযোদ্ধা।

উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা যে গণহত্যা ও নৃশংসতা চালিয়েছিল তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। ডিসেম্বরের শেষদিকে এসে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তান হানাদারবাহিনী পরিকল্পনা করে জাতির সূর্য-সন্তানদের হত্যা করার। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে হত্যা করা হয় দেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারেন এমন চিকিৎসক, লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলীসহ নানা শ্রেণিপেশার বুদ্ধিজীবীদের।

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন