বিজ্ঞাপন

লাশের আশায় স্বজনদের অপেক্ষা ফুরাচ্ছে না!

March 16, 2018 | 10:56 pm

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ইউএস-বাংলার বোমবার্ডিয়ার ড্যাশ ৮-কিউ ৪০০ মডেলের বিমানটি নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয় গত ১২ মার্চ। চলে গেছে চারটি দিন। কিন্তু এখনো স্বজনরা মরদেহের জন্য অপেক্ষা করছেন।

প্রথমে আগামীকাল শনিবার (১৭ মার্চ) মরদেহ হস্তান্তর করার কথা বলা হলেও ক্রমেই সেটি দীর্ঘ হচ্ছে। কোনো কোনো মরদেহ এখনও শনাক্ত করাও সম্ভব হয়নি।। স্বজনরা বলছেন, সেই কোন দূরের একটি হাসপাাতালে লাশগুলো পড়ে রয়েছে, ‘ডেডবডি’গুলো পাওয়ার আশা কেবল এখন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

এদিকে, আজ শুক্রবার (১৬ মার্চ) বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল নেপাল থেকে ফিরে মরদেহ দেখে চেনার উপায় নেই বলে জানিয়েছেন। বিমানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাকে নেপাল কর্তৃপক্ষ আটজনের লাশ দেখিয়েছে। বাকি ১৮ জনের লাশ বস্তাবন্দী। দেখে চেনার উপায় নেই। বস্তায় পোড়া মানুষের ছাই। ডিএনএ টেস্ট ছাড়া শনাক্তের উপায় নেই।’

বিজ্ঞাপন

মরদেহ‍গুলো রাখা হয়েছে নেপালের ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটি টিচিং হাসপাতলের মর্গে। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে থেকে নেপাল যাওয়া মেডিকেল টিমে রয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ।

ডা. সোহেল মাহমুদ নেপাল পৌঁছানোর পর আজ-কালের মধ্যে চিহ্নিত হওয়া মরদেহ হস্তান্তরের কথা বললেও আজ তিনি বলেছেন, আগামী সোমবার নাগাদ হস্তান্তর শুরু হবে বলে আমরা আশাবাদী।

মরদেহ শনাক্ত এবং হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশায় রয়েছেন দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা। কয়েকজন স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানে যারা মরদেহ শনাক্তের কাজে গিয়েছেন তাদেরকে যেতে হচ্ছে নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।

বিজ্ঞাপন

উড়োজাহাজটির কো-পাইলট পৃথুলা রশীদের খালু তৌফিকুর রহমান সুমন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মরদেহ পাওয়া নিয়ে একটু ক্ষোভের ভেতর রয়েছি, কিন্তু জানি ক্ষোভ থাকলেও কিছু করার নেই। নানাজন নানা কথা বলছেন। সব কথা মিলিয়ে বিভ্রান্তিতে রয়েছি আমরা।’

বিভ্রান্তির কারণ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেউ বলছেন সোমবার নাগাদ মরদেহ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হবে আবার কেউ বলছেন সেটি শুরু হতে মঙ্গলবার লেগে যেতে পারে।’

মরদেহ হস্তান্তের সব প্রক্রিয়া ঠিক রয়েছে মন্তব্য করে তৌফিকুর রহমান বলেন, “আমাদেরকে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে মরদেহ শনাক্ত করার জন্য কিন্তু বিষয়টি ‘লেংগথি’ করছে নেপাল প্রশাসন।”

তিনি বলেন, ‘ওরা দুর্ঘটনা ঘটার তিনদিন পর্যন্ত কিছুই করে নাই, আমাদের দেশের ফরেনসিক টিম যাবার পর যতটুকু যা হলো।’

বিজ্ঞাপন

এই যে প্রক্রিয়া দীর্ঘ হচ্ছে এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভেতরে ক্ষোভ থাকাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ক্ষোভ থেকেও লাভ নাই। দুর্ঘটনার প্রথম দিনেই আমাদের পৃথুলার মরদেহ শনাক্ত হয়েছিল, তারা তো পৃথুলাকে দিয়ে দিতে পারত— কিন্তু সেটাও সম্ভব হচ্ছে না ওদের প্রক্রিয়ার কারণে।’

পৃথুলার মরদেহ শনাক্ত করতে সেখানে গিয়েছিলেন তার নানা এম এ মান্নান। তিনি ফিরে এসেছেন গতকাল রাতে। তার বরাত দিয়ে তৌফিকুর রহমান বলেন, ‘যে আটজনের মরদেহ বেশি পুড়ে গিয়েছে তাদের শনাক্ত করা সম্ভব নয় ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া, তাদের মরদেহ শনাক্ত করতে আরও মাস খানেকের মতো সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে আমরা অনেকটা ভাগ্যবান যে ‘পৃথু’কে শনাক্ত করা গেছে।’ কিন্তু আমাদের ফরেনসিক টিম যদি না যেত তাহলে হয়তো দেড় থেকে দুই মাস পর্যন্ত লেগে যেত বলে এম এ মান্নান জানিয়েছেন পৃথুলার পরিবারকে।

অপরদিকে, রানার অটোমোবাইল কোম্পানিতে কাজ করা মতিউর রহমানের বড় ভাই মোকসুদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘অধিক শোকে পাথর হয়ে গিয়েছেন তার ৭০ বছরের মা, ফেনীর গ্রামের বাড়িতে তিনি থাকেন। দুর্ঘটনার প্রথমদিনেই জেনেছিলেন উড়োজাহাজে সমস্যা হয়েছে। গ্রামের কেউ টিভিতে দেখে কিছু না বুঝেই তাকে বলে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে তার দিন রাতের বেশির ভাগ সময় কাটছে জায়নামাজে। তারপর থেকেই তিনি ছোট ছেলেকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছেন।’

কিন্তু কবে নাগাদ ভাইকে নিয়ে মায়ের কাছে যেতে পারবেন মোকসুদ সে চিন্তায় তার দিন কাটছে। আর মায়ের এ প্রশ্নের ভয়ে তিনি তার সঙ্গে কথা বলাই ছেড়ে দিয়েছেন গত চারদিন ধরে।

“কারণ, কথা বললেই মায়ের প্রথম থাকে, ‘তোরা কবে আসবি? কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর তো আমার জানা নেই” মন্তব্য করে মোকসুদ বলেন, ‘উত্তর দেবার ভয়ে কথাই বলছি না তার সঙ্গে। যেদিন মরদেহ আসবে সেদিন একবারে নিয়ে গিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়াব।”

নেপালে মতিউরের মরদেহ শনাক্তের কাজে গিয়েছেন তাদের ভাগিনা আশরাফুল আলম জীবন। আশরাফুল শুক্রবার রাত নয়টার দিকে মোকসুদকে জানিয়েছেন কিছুক্ষণ আগে নেপাল দূতাবাস তাদেরকে ব্রিফ করেছে। সেখানে আজ ময়নাতদন্তের কাজ শেষ হয়েছে, আগামীকাল থেকে তাদের বর্ণনা অনুয়ায়ী শনাক্তকরণের কাজ শুরু হবে এবং তাদেরকে দেখতেও দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে স্বজনদের।

অপরদিকে, যাদের বর্ণনা অনুযায়ী শনাক্ত করা যাবে না— তাদের ক্ষেত্রে প্রথমে আঙ্গুলের ছাপ এবং তাতেও যদি শনাক্ত না করা হয় তাহলে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করতে হবে। সেক্ষেত্রে সেসব যাত্রীদের স্বজনদের অপেক্ষাটা আমাদের চেয়েও আরও দীর্ঘ হবে বলে মন্তব্য করেন মোকসুদুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব নিহতদের আনা গেলে আমরা শান্তি পেতাম, এ জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করা দরকার।’

সারাবাংলা/জেএ/আইজেকে

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন