বিজ্ঞাপন

শেষ হচ্ছে না গ্রাম-পুলিশদের অপেক্ষার প্রহর  

December 26, 2020 | 11:29 am

কামরুল ইসলাম ফকির, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: দেশের ৪৭ হাজার গ্রাম পুলিশের বঞ্চনা আর কষ্টের প্রহর শেষ হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে তারা সরকারের কাছে জাতীয় বেতন স্কেলে বেতন-ভাতার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সরকার একাধিক সময়ে তাদের আশ্বাস দিলেও সেসব আশ্বাস আলোর মুখ দেখেনি।

বিজ্ঞাপন

অবশেষে ২০১৭ সালে সরকারি স্কেলে বেতন-ভাতা পেতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন তারা। ২০১৯ সালে উচ্চ আদালতের রায়ও তাদের পক্ষে আসে। তবে সে রায় বাস্তবায়ন না করে সরকার এর বিরুদ্ধে আপিল করায় তাদের অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৮ সালের ৯ জুলাই তৎকালীন সরকার গ্রাম পুলিশের একটি অংশের সঙ্গে সমঝোতা করে তাদের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর মর্যাদা দিতে রাজি হয়। ওই বছরই গ্রাম পুলিশ তাদের বেতন-ভাতার জন্য প্রস্তাব পাঠায় মন্ত্রণালয়ে। তিন-চারবার এই প্রস্তাব পাঠানো হলেও তা নাকচ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। পরে ২০১২ সালে মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, দফাদার ও মহল্লাদারদের চাকরি পাকিস্তান আমল থেকে একই নিয়মে চলে আসছে। নতুন করে তাদের চতুর্থ শ্রেণির চাকরির মর্যাদা দেয়ার প্রয়োজন নেই।

এরপর ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার ধামরাই উপজেলার দফাদার মো. লাল মিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ৩৫৫ জন গ্রাম পুলিশ সদস্য হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন।

বিজ্ঞাপন

একই বছরের ৩ ডিসেম্বর ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট একটি বেঞ্চ রুল জারি করেন। এতে ২০০৮ সালের সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রাম পুলিশ সদস্যদের চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। ওই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল যথাযথ ঘোষণা করে তাদেরকে জাতীয় বেতন স্কেলের ১৯তম এবং ২০তম গ্রেডে বেতন প্রদানের রায় প্রদান করেন। চলতি বছরের জুন মাসে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।

চূড়ান্ত রায়ে ২০১১ সালের জুন মাস থেকে দফাদারদের ১৯তম এবং মহল্লাদারদের ২০তম বেতন গ্রেড প্রদানের কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই রায়ে তাদেরকে চাকরিতে যোগদানের তারিখ থেকে সময়কাল গণনা করে অবসর ভাতা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়।

পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। রাষ্ট্রপক্ষের আপিল গ্রহণ করে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায় আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন। একইসঙ্গে রাষ্টপক্ষকে লিভ টু আপিল দায়ের করার জন্য নির্দেশ দেন।

বিজ্ঞাপন

পরে চলতি বছরের জুন মাসে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে রাষ্টপক্ষ ১৫ অক্টোবর লিভ টু আপিল দায়ের করে। পরে চেম্বার জজ আদালত মামলাটি ২০২১ সালের ২৬ জুলাই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন।

আদালতে রিটকারীদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী হ‌ুমায়ূন কবির পল্লব। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ওয়ায়েস আল হারুনী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহফুজুর রহমান।

রায়ের বিষয়টি উল্লেখ করে আইনজীবী হুমায়ূন কবির পল্লব সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১৭ সালে লাল মিয়াসহ ৩৫৫ জন গ্রাম পুলিশ সদস্য সরকারি স্কেলে বেতন-ভাতা দাবি করে রিট দায়ের করেন। রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে আদালত দফাদারকে ১৯তম গ্রেডে এবং মহল্লাদারকে ২০তম গ্রেডে বেতন প্রদানের রায় দেন।

তিনি আরও বলেন, ‘এ রায় বাস্তবায়ন হলে আবেদনকারী ৩৫৫ জন হলেও দেশের প্রায় ৪৭ হাজার গ্রাম পুলিশ সদস্য এর সুবিধা ভোগ করবেন। রায়ে ২০১১ সালের ২ জুন থেকে গ্রাম পুলিশ সদস্যদের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধ করা এবং অবসর ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের নিজ নিজ যোগদানের তারিখ হতে সময়কাল গণনা শুরু করতে বলা হয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

রায় আট সপ্তাহের স্থগিতের বিষয়টি উল্লেখ করে আইনজীবী হুমায়ূন কবির জানান, পরে গত বছর ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। রাষ্টপক্ষের আপিল গ্রহণ করে একই বছরের ৩০ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায় আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন। একইসঙ্গে লিভ টু আপিল দায়ের করার জন্য নির্দেশনা দেন।

চলতি বছরের জুন মাসে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। পরে রাষ্টপক্ষ ১৫ অক্টোবর লিভ টু আপিল দায়ের করলে আদালত মামলাটি ২০২১ সালের ২৬ জুলাই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন বলে জানান রিটকারীদের আইনজীবী।

রায়ের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দীর্ঘ সময় লাগার বিষয়ে এই আইনজীবী বলেন, ‘এমনিতেই গ্রাম-পুলিশ সদস্যদের সবাই অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বর্তমান বাজারে মাত্র ৬-৭ হাজার টাকায় একটি সংসার পরিচালনা করা অত্যন্ত কষ্টকর এবং দুরূহ। তারপরও তারা কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে সরকারের বিভিন্ন দফতরের ৭০ ধরনেরও বেশি কাজ করে থাকেন। তাদের কাজের জন্য কোনো নির্ধারিত সময়সীমা নেই। ২৪ ঘণ্টায় তাদেরকে কাজের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। মানবিক কারণে হলেও সরকার এ সব অসহায়, দরিদ্র ও বঞ্চিত গ্রাম পুলিশদের সহায়তা করা উচিত।’

গ্রাম পুলিশ বাহিনী রিট বাস্তবায়নকারী কমিটির সভাপতি দফাদার মো. উজ্জল খান বলেন, ‘আমরা যারা গ্রাম পুলিশের চাকরি করি তারা সবাই দরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়ে। সরকার আমাদের যে টাকা দেয় তা দিয়ে বর্তমান বাজারে কোনোভাবেই একটি সংসার চালানো সম্ভব না। তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি, আমাদের সরকারি স্কেলে বেতন-ভাতা দিয়ে পরিবার নিয়ে খেয়েপড়ে বাঁচার সুযোগ দিন।’

বর্তমানে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে একজন করে দফাদার ও ৯ জন করে মহল্লাদার রয়েছে। দফাদারেরা ৭ হাজার ও মহল্লাদাররা সাড়ে ৬ হাজার ৫০০ টাকা বেতন ভাতা পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া প্রতি মাসে ১২০০ টাকা যাতায়াত ভাতা পেয়ে থাকেন।

যেভাবে গ্রাম পুলিশের যাত্রা শুরু হয়: প্রাচীন বাংলায় জাগানিয়া (সতর্ককারী), প্রহরী, অষ্টপ্রহরী, (২৪ ঘণ্টা পাহারারত) ইত্যাদি নামে গ্রাম পুলিশের অস্তিত্ব ছিল। মোগল আমলে গ্রাম পুলিশ পাশবন, নিঘাবন ও চৌকিদার নামে পরিচিত ছিল। তারা গ্রামবাসীদের সেবক হিসেবে কাজ করতেন। গ্রামবাসীরা তাদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতেন। ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে ভারতবর্ষের অধিকাংশ গ্রামে পঞ্চায়েত প্রথা চালু ছিল। তাদের কাজ ছিল বিচারকার্য সম্পাদন ও গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা ব্রিটিশ আমলে জমিদার শ্রেণি সৃষ্টি করা হয় এবং রাজস্ব আদায় ও স্থানীয় শান্তি-শৃঙ্খলা দায়িত্ব তাদের উপরই (চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন ১৭৯৩) এতে কাজের পরিধি বেড়ে যায়। ফলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে পঞ্চায়েত গ্রামের শান্তি শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পৃথক লোক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।

এরই ধারাবাহিকতায় গ্রাম চৌকিদারি আইন-১৮৭০ জারি করা হয়। এ আইনের অধীনে ইউনিয়ন পর্যায়ে চৌকিদার পঞ্চায়েত গঠন করা হয়। এ পঞ্চায়েত গ্রামে চৌকিদার নিয়োগ করে পাহারার ব্যবস্থা নিতেন। এভাবেই মূলত গ্রামপুলিশের যাত্রা শুরু হয়।

যেভাবে আইনি ভিত্তি পেল গ্রাম পুলিশ বাহিনী: ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে তৎকালীন ভারতবর্ষের অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত প্রথা প্রচলিত ছিল। পঞ্চায়েতের সদস্য সংখ্যা ছিল ৫ জন তাদের কাজ ছিল বিচার কার্য সম্পাদন ও গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের জমিদার শ্রেণির সৃষ্টি করা হয়। জমিদাররা রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব লাভ করেন। কিন্তু এ সময়ে গ্রামীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। গ্রাম চৌকিদারি আইন ১৮৭০ প্রণয়নের মাধ্যমে চৌকিদারি পঞ্চায়েত চালু করে অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য চৌকিদার নিয়োগ করা হয়।

১৮৮৫ সালে বঙ্গীয় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আইনে ইউনিয়ন কমিটি গঠন করা হয় পাশাপাশি চৌকিদারি পঞ্চায়েত প্রধান ছিল চৌকিদারদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা। ১৯১৯ সালে বঙ্গীয় স্বায়ত্ব শাসন আইনের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে পাহারার ব্যবস্থা করা হতো। এই আইনের মাধ্যমে গ্রাম চৌকিদারী আইন ১৮৭০ ও বঙ্গীয় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আইন ১৮৮৫ বাতিল করা হয়। মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ, ১৯৫৯ অনুযায়ী ইউনিয়ন কাউন্সিলের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় পাহারা, টহল দান, করা আদায়  ইত্যাদি ক্ষেত্রে গ্রাম পুলিশ তথা চৌকিদাররা ভূমিকা পালন করতেন। মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ ১৯৫৯ এর পরিপ্রেক্ষিতে ইউনিয়ন পরিষদ (গ্রাম পুলিশ বাহিনী) বিধিমালা ১৯৬৮ জারি করা হয়।

এ বিধিমালায় গ্রাম পুলিশ বাহিনীর নাম পরিবর্তন করে যথাক্রমে দফাদার মহল্লাদার করা হয়। এই বিধিমালায় গ্রাম পুলিশের দায়িত্ব ও কার্যাবলী, নিয়োগ ও শৃঙ্খলা ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ রয়েছে। স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ এ ইউনিয়ন পরিষদের পুলিশ ও প্রতিরক্ষার দায়িত্ব বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ রহিত করে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯ জারি করা হয়। এই আইনেও ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম প্রতিরক্ষা বিষয়ক কার্যাবলি সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯ এর ধারা ৪৮ এর পঠিতব্য এবং ধারা ৯৬ এর ক্ষমতাবলে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) গ্রাম পুলিশ বাহিনীর গঠন, প্রশিক্ষণ, শৃঙ্খলা ও চাকরির শর্তাবলী সম্পর্কিত বিধিমালা, ২০১৫ জারি করা হয়েছে।

এ বিধিমালার বিধি ৩৭(১) এ Union Council (College Police Force) Rules, 1968 রহিত করা হয়েছে। বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম পুলিশগণের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, শৃঙ্খলা ও চাকরির শর্তাবলি স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) গ্রাম পুলিশ বাহিনীর গঠন, প্রশিক্ষণ, শৃঙ্খলা ও চাকরির শর্তাবলি সম্পর্কিত বিধিমালা, ২০১৫ অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে।

সারাবাংলা/কেআইএফ/একে

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন