বিজ্ঞাপন

এ শুধু মাহমুদউল্লাহর রাত

March 17, 2018 | 1:53 pm

মোসতাকিম হোসেন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

বিজ্ঞাপন

১.
২০১২, মিরপুর। ২০১৬, বেঙ্গালুরু।

সেই অভিশপ্ত দুই রাতের দুঃস্বপ্ন দেখে কতবার ধড়মড় করে জেগে উঠতে হয়েছে মাঝরাতে? সেই পুরনো কথা, ‘এত কাছে তবুও এত দূরের’ আক্ষেপে পুড়তে হয়েছে কতবার? কালকের পর মাহমুদউল্লাহ হয়তো আশ্বস্ত হতে পারবেন, ঘাড় থেকে সিন্দাবাদের ভূতটা নেমে গেছে চিরতরে। মিরপুর বা বেঙ্গালুরু আর কখনো হয়তো ফিরবে না দুঃস্বপ্ন হয়ে।

২.
কাল জয়ের পর পরেই বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন, ‘অভিজ্ঞতা বাজারে কেনা যায় না।’ কাকে নিয়ে এই স্ট্যাটাস, সেটা না বলে দিলেও চলছে।

বিজ্ঞাপন

ছয় বছর আগে এশিয়া কাপ ফাইনালে শেষ ওভারে বাংলাদেশের দরকার ছিল ৯ রান। এক অর্থে সমীকরণ ছিল আজকের চেয়েও সহজ, কাজ হয়ে যেত হয়তো একটা বাউন্ডারি হলেই। মাহমুদউল্লাহ পারেননি। সেই ২ রানে হারের পর সাকিব-মুশফিকের সেই কান্না অশ্রু হয়ে নেমেছিল পুরো বাংলাদেশের নয়ন থেকে। নন স্ট্রাইক থেকে মাহমুদউল্লাহ দেখেছিলেন, কীভাবে মুঠো গলে বেরিয়ে যায় স্বপ্ন।

মিরপুর যদি মুঠোতে হয়, বেঙ্গালুরু তো ছিল হাতের তালুতে শক্ত করে ধরাই। দুই বলে দুই রান, সেখান থেকে ম্যাচ হেরে যাওয়ার জন্য নিজেদেরই করতে হতো অলৌকিক কিছু। মাহমুদউল্লাহ স্ট্রাইকে, মিরপুরের ভূত মাথা থেকে নামানোর সুযোগ। কিন্তু ওই অবস্থায় আউট হয়ে গেলেন পান্ডিয়ার বলে, বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে দেখলেন সেই ম্যাচটাই ১ রানে হেরে গেছে বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ওই ম্যাচের পর বাংলাদেশ দলের অনেকেই বলেছিলেন, বেঙ্গালুরুর সেই দুঃস্বপ্ন আরও এক বছর মাঠে নামার পর তাড়া করে বেরিয়েছে বাংলাদেশকে।

বিজ্ঞাপন

৩.
এমন নয় বাংলাদেশকে কখনো জেতাতে পারেননি আগে। দুই বছর আগে এশিয়া কাপেই পাকিস্তানের সঙ্গে সেই ম্যাচে প্রায় একই রকম হয়ে গিয়েছিল পরিস্থিতি। শেষ দুই ওভারে দরকার ১৮ রান, স্বীকৃত ব্যাটসম্যান বলতে শুধু মাহমুদউল্লাহ। শেষ পর্যন্ত মাশরাফি বিন মুর্তজাকে নিয়ে জয় নিয়েই ছেড়েছিলেন মাঠ। কিন্তু ১৫ বলে ২২ রানের ওই ইনিংসে শাপমোচনটা যেন ঠিক হয়নি। পরিস্থিতিটা সঙ্গীন ছিল বটে, তবে দলকে তো একা অন্তত জেতাতে হয়নি, পেয়েছিলেন মাশরাফির সাহায্যও।

৪.
কিন্তু কাল আক্ষরিক অর্থেই তাকে উত্তাল সমুদ্রে বৈঠা বাইতে হলো একাই। যখন ক্রিজে নামলেন, ৫ ওভারে বাংলাদেশের দরকার আর ৫০ রান। সঙ্গে সাকিব আল হাসান আছেন, জাহাজের ক্যাপ্টেন থাকতে তখনও ডুবে যাওয়ার শঙ্কাটা খুব প্রবল হয়নি। সাকিব পরে নিজেই বললেন, ৫ ওভারে ৫০ রান টি-টোয়েন্টিতে এমন বেশি কিছু নয়। মাহমুদউল্লাহ মুখোমুখি প্রথম বলেই মারলেন চার, তবে সেটা ছিল কেবল শুরু।

পরের চার ওভারেও দরকার ৪০ রান। একটি খুব ভালো ওভার করলে শ্রীলঙ্কার পক্ষে ম্যাচ হেলে যেতে পারে। আবার উল্টোটা হলে বাংলাদেশের কাছে লঙ্কানদের ম্যাচ ফস্কে যেতে পারে। জীবন মেন্ডিসের দ্বিতীয় বলটা বুঝতে না পেরে ছেড়ে দিলেন। ওই পর্যন্তই, সেই একবারই হয়েছিলেন বিভ্রান্ত। মেন্ডিসকে এক বল পরেই ছয় মেরে বাংলাদেশকে রাখলেন পথেই।

কিন্তু কে জানত, হুট করেই একটা অতিকায় ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ক্যাপ্টেনকে? খানিক পর মাহমুদউল্লাহ আবিষ্কার করলেন, সাকিব নেই। যা করতে হবে তাকেই। তখনো দুই ওভারে দরকার ২৩ রান, এমন পরিস্থিতিতে আগের সেই দুঃস্বপ্ন কি উঁকি দিয়েছিল? কিন্তু ওই যে মাশরাফির কথা, ‘অভিজ্ঞতা মানুষকে ঋদ্ধ করে’। মাহমুদউল্লাহ কাল জানতেন, তাকে কী করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

৫.
ভুল বলতে গেলে একটাই করেছিলেন। ১৯তম ওভারের শেষ বলে মিরাজ সিঙ্গেল নিতে দৌড়ালেন। মাহমুদউল্লাহ হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন, স্ট্রাইক তাকেই রাখতে হবে। শেষ পর্যন্ত দুই বল পরেই পেলেন তা। এরপর শুরু এমন এক নাটক, যেটা পরে হয়ে গেছে টক অব দ্য কান্ট্রি। নো বলের সংকেত নিয়ে প্রতিবাদের শুরুটাও করেছিলেন তিনি, আম্পায়ারের কাছে গিয়ে ব্যাখ্যা চাইছিলেন বার বার। এর মধ্যে সাকিব একবার সংকেত দিলেন চলে আসার জন্য, অনেক নাটকের পর শেষ পর্যন্ত মাহমুদউল্লাহ আবার শুরু করলেন ব্যাট। ঐ মুহূর্তে সেই বিরতিতেই কি নিজের মনযোগটা আবার ঠিক করেছিলেন? উত্তরটা মাহমুদউল্লাহই দিতে পারবেন।

আবার বল শুরু করলেন উদানা, তৃতীয় বলে ডিপ মিডউইকেটের দিকে ঠেলেই মাহমুদউল্লাহ দিলেন দৌড়। এমনিতে ঐ বলে দুই রান নেওয়ার কথা কোনো ব্যাটসম্যানই হয়তো কস্মিনকালে ভাববেন না। কিন্তু মাহমুদউল্লাহর ওপর কাল ভর করেছিল অন্য কিছু। প্রথম রানটা পড়িমড়ি করে নিয়ে দ্বিতীয় রানের জন্য ছুটলেন। শেষ মুহূর্তে যে প্রাণপণ ডাইভ দিলেন, তা না হলে হয়তো বাঁচতেও পারতেন না। কিন্তু কাল নিয়তিই যেন ঠিক করে রেখেছিল, বরমাল্য তার গলাতেই উঠবে। বেঁচে গেলেন মাহমুদউল্লাহ। উদানার পরের বলে ফ্লিক করে সেই ছয়, দুই হাত লাফিয়ে শূন্যে মুঠো ছুঁড়ে মাহমুদউল্লাহর হুংকার। ১৮ বলে ৪৩ রানের ইনিংসটাকে সাকিবই বলছেন, ‘সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে তার দেখা অন্যতম সেরা।’ পরে আরেকটু খোলাসা করে বললেন, ‘যেভাবে বল তার মাঝব্যাটে আসছিল, সেটা দারুণ।’

৬.
একাই জিতিয়েছেন, কথাটা হয়তো আপনার কাছে একটু ক্লিশে হতে পারে। কিন্তু কালকের ইনিংসটা দেখুন, মাহমুদউল্লাহ ক্রিজে নামার সময় বাংলাদেশের দরকার ছিল ৫১ রান। তার পর একাই ৪৩ রান নিয়েছেন। সাকিব আউট হওয়ার পর যে ২৩ রান, সেটাও পুরোটাই নিয়েছেন একাই। বাংলাদেশের হয়ে টি-টোয়েন্টিতে অন্তত ১৫ বলের ইনিংসে এটাই সবচেয়ে দ্রুততম। নিজেই পরে বললেন, ‘আমি শুধু চেয়েছিলাম বল যত জোরে সম্ভব মারতে।’

মাহমুদউল্লাহ যেদিন চান, সেদিন কী হয় তা তো শ্রীলঙ্কা দেখলই!

সারাবাংলা/এএম/এমআরপি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন