বিজ্ঞাপন

করোনায় মোড়ানো বিশের বিশ্ব ফুটবল

December 30, 2020 | 6:29 pm

সাহাবার সাগর, নিউজরুম এডিটর

২০২০ সালের অধিকাংশ সময়ই কেটে গেছে করোনাভাইরাস মহামারিতে থমকে থেকে। এতে সাধারণ মানুষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তেমনই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্বের ক্রীড়া জগতও। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্বফুটবলও! স্থগিত হয়েছে বড় বড় টুর্নামেন্ট থেকে শুরু করে বহুসংখ্যক ম্যাচও। এসেছে ফুটবলে নতুন নিয়ম। আর এই মহামারির বাইরের দিক বিবেচনা করলে লিভারপুলের ৩০ বছরের আক্ষেপ ঘুচানো, বায়ার্নের রেকর্ড গড়া যেমন আনন্দ দিয়েছে ফুটবল সমর্থকদের। ঠিক তেমনই ফুটবল ঈশ্বর ডিয়েগো ম্যারাডোনার বিদায়ে কেঁদেছে গোটা বিশ্ব। তবে দেখে নেওয়া যাক ২০২০ সালের বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলো।

বিজ্ঞাপন

শুরুটা বেশ সাবলীলই ছিল ২০২০’র। তবে সময় যত গড়িয়েছে লিপ ইয়ারটি ততবেশি ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্টের স্বপ্নে বিভোর ছিল গোটা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমিরা। গত জুন-জুলাইয়ে মাঠে গড়ানোর কথা ছিল ইউরোপিয়ান ফুটবলের সর্বোচ্চ সম্মানের টুর্নামেন্ট ইউয়েফা ইউরো আর ল্যাটিন আমেরিকার সর্বোচ্চ টুর্নামেন্ট কোপা আমেরিকা। তবে মহামারি আর তা হতে দিল কই?

গত ফেব্রুয়ারি থেকেই গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়তে থাকা ছোঁয়াচে কোভিড-১৯। ইউরোপেও ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়তে থাকে করোনাভাইরাস। দিনে দিনে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে আমেরিকা মহাদেশেও। গত ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে কোভিড-১৯ রোগকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

হুট করে মহামারির প্রাদুর্ভাবে মার্চের মাঝামাঝি সময়েই স্থগিত ঘোষণা করা হয় ইউরো। এরপর একই পথে হাঠে কোপা আমেরিকা। ইউরো ও কোপা আমেরিকা দুই টুর্নামেন্টই এক বছর পিছিয়ে ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত হবে বলেও জানান দেয় স্ব স্ব সংস্থা।

বিজ্ঞাপন

কেবল আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টই নয়, সেই সঙ্গে স্থগিত হয়ে যায় ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগগুলোও। ঘোরকাল অন্ধকার নেমে আসে বিশ্ব ফুটবলে। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আশঙ্কা বাড়তে থাকে ২০১৯-২০ মৌসুম পুরোটাই বাতিল হওয়ার।

ফ্রেঞ্চ লিগ ওয়ান বাতিল ও পিএসজি চ্যাম্পিয়ন:

বিজ্ঞাপন

মহামারির ভয়াবহতা ক্রমশ বাড়তে থাকায় নতুন সিদ্ধান্ত নেয় ফ্রান্স। আর অপেক্ষা না করে লিগ ওয়ানের ২০১৯/২০ মৌসুম বাতিল করে সেই সময়কার লিগ লিডার প্যারিস সেইন্ট জার্মেইকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে। ওই সময় পিএসজি দ্বিতীয় স্থানে থাকা অলিম্পিক মার্শেইর থেকে ১২ পয়েন্টে এগিয়ে ছিল। এরপর দেশটির সরকার সকল ধরনের ক্রীড়া ইভেন্ট সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করে।
পিএসজি’র প্রেসিডেন্ট নাসের আল-খেলাইফি সে সময় পিএসজির লিগ জয় উৎসর্গ করেন চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে।

ফুটবল ফেরার আলো:

“কথায় আছে না রাত যতই গভীর হয় সকাল তত নিকটে আসে?” বিশ্ব ফুটবলের জন্যও এই উক্তিটি যথার্থই বটে। করোনার কারণে ফুটবল স্থগিত হয়ে যাওয়ায় শত শত কোটি টাকার লোকসানের মুখে পড়া ইউরোপিয়ান লিগগুলো যেকোনো মূল্যে মাঠে খেলা ফেরানোর চেষ্টা করতে থাকে।

জার্মান বুন্দেস লিগা পথ প্রদর্শক:

বিজ্ঞাপন

মার্চে স্থগিত হয়ে যাওয়া ফুটবল পুনরায় মাঠে ফেরনোর সর্বপ্রথম প্রচেষ্টা করে জার্মানি। নিজেদের ঘরোয়া লিগ বুন্দেস লিগা দুই মাস পাঁচ দিন স্থগিত হয়ে থাকার পর ১৬ মে পুনরায় শুরু হয়। তবে সেখানে ছিল বহু শর্ত। সাধারণ মানুষের মাঝে করোনা ছড়ানোর ভয়ে মৌসুমের বাকি সময়টা বন্ধ স্টেডিয়ামেই হবে বলে ঘোষণা দেয় বুন্দেস লিগা কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও ফিফার নতুন নিয়মও মাঠে প্রয়োগ হয় বুন্দেস লিগাতে।
পুনরায় মাঠে গড়ানো ফুটবলে খেলোয়াড়দের প্রতি তিন দিনের ব্যবধানে দুটি করে ম্যাচ খেলতে হবে বিধায় ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা জানিয়ে দেয় এখন থেকে প্রত্যেকটি দল পাঁচজন করে ফুটবলার বদলি করতে পারবে। এমন কত শত নিয়ম নিয়ে দুই ম্যাচ হাতে রেখে টানা অষ্টমবারের মতো জার্মান বুন্দেস লিগা জয় করে বায়ার্ন মিউনিখ।

লিভারপুলের ৩০ বছরের আক্ষেপের সমাপ্তি:

অপেক্ষা ৩০ বছরের! সুনির্দিষ্টভাবে ৩০ বছর ২ মাস ৪ দিন। দিনের হিসাবে ভেঙে বললে ১১ হাজার দিনেরও বেশি! ২১ এপ্রিল ১৯৯০ থেকে শুরু। এরপর কেবলই যেন অপেক্ষার আগুনে পুড়ে পুড়ে ছাই হওয়া। তবে পুরান থেকে আমরা যে ফিনিক্স পাখির গল্প জানি, নিজের ছাই থেকেই সেই পাখি বারে বারে পুনর্জন্মের ইতিহাস গড়ে । ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ঠিক তেমনই ৩০ বছরের অপেক্ষার আগুনে পুড়ে যে ছাই জমেছিল, সেই ছাই থেকেই যেন পুনর্জন্মের ইতিহাস রচনা করল লিভারপুল। আর সেই পুনর্জন্মের কাণ্ডারি যিনি, তিনি জার্মান লৌহমানব ইয়্যুর্গেন ক্লপ।

শিরোপার ফুল হয়ে ফোটার আগে সম্ভাবনার কুঁড়ির দেখা মিলছিল গত কয়েক বছর ধরেই। শেষ পর্যন্ত এবার তার সফল অনুবাদ হলো শিরোপার হাত ধরে। এর মধ্যে অবশ্য মজার একটি বিষয় আছে— ৩০ বছর পর শিরোপা পুনরুদ্ধারের কথা বলা হলেও ‘প্রিমিয়ার লিগে’র শিরোপা কিন্তু অল রেডসদের এই প্রথম! কিভাবে সেটা?
এবারের আক্ষেপ ঘুচানোর শিরোপা জয়ের আগে ১৯৮৯/১৯৯০ মৌসুমে শেষবার ইংলিশ লিগ উঁচিয়ে ধরেছিল অল রেডরা। তখন প্রিমিয়ার লিগ নামটাই যে ছিল না। লিগের নাম তখন ছিল ফার্স্ট ডিভিশন।

লিভারপুলের শিরোপা জেতার পর আরও দুই মৌসুম ওই একই নামে ছিল লিগ। ১৯৯২/১৯৯৩ মৌসুমে নাম পাল্টে রাখা হয় প্রিমিয়ার লিগ। তার মানে, ইংলিশ লিগের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সফল দলটির ঝুলিতে প্রকৃতপক্ষে ‘প্রিমিয়ার লিগে’র শিরোপাই ছিল না! ক্লপের হাত ধরে সেই হলো সেই অপেক্ষার সমাপ্তি।

২০১৯/২০ মৌসুমে লিভারপুল ছিল দুর্বার। আর তাই তো লিগ শেষ হওয়ার ৭ ম্যাচ বাকি থাকতেই পয়েন্ট টেবিলের দ্বিতীয় স্থানে থাকা ম্যান সিটির চেয়ে ২৩ পয়েন্ট এগিয়ে লিভারপুল। অর্থাৎ ৭ ম্যাচ হাতে রেখেই এবার নিশ্চিত হয়েছে শিরোপা। এত বেশি ম্যাচ হাতে রেখে শিরোপা জয়ের ইতিহাস ইংলিশ লিগে আর নেই। লিভারপুলের এই যে পুনর্জাগরণ, এর পেছনে মূল অবদান কিন্তু সেই ইয়্যুর্গেন ক্লপের।

জিদানের হাতে রিয়ালের ৩৪তম লা লিগা:

এস্তাদিও সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর সংস্করণের কাজ চলছে আর তাই তো অনুশীলন স্টেডিয়াম আলফ্রেড ডি স্টেফানো খেলছে রিয়াল মাদ্রিদ। ঘরের মাঠ আলফ্রেড ডি স্টেফানো স্টেডিয়ামে ভিয়ারিয়ালকে ২-১ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে লা লিগায় নিজেদের ৩৪তম শিরোপা জয় করে রিয়াল মাদ্রিদ। বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) রাতটাই নিজেদের করে নেয় লস ব্ল্যাঙ্কোসরা, এর আগে অবশ্য ভুলবশত এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। স্প্যানিশ লা লিগার শিরোপা উদযাপনের জন্য বিশেষ জার্সি বানিয়েছিল মাদ্রিদের ক্লাবটি। তা বানাতেই পারে। কিন্তু কাগজে-কলমে শিরোপা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তো আর প্রকাশ করা যায় না। বৃহস্পতিবার সেটাই করেছিল গ্যালাক্টিকোরা।

নিজেদের ওয়েবসাইটে শিরোপা উদযাপনের জার্সির ছবি পোস্ট করে ক্রয়ের আহ্বান জানায় রিয়াল। মাদ্রিদের ক্লাবটির শিরোপা নিশ্চিতে তখনও দুই পয়েন্ট বাকি। ভুল বুঝতে পেরে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পোস্ট মুছে ফেলে লস ব্ল্যাঙ্কোসরা। তার কয়েক ঘণ্টা পরই লা লিগা শিরোপা নিশ্চিত করেছে জিনেদিন জিদানের দল। ছন্দ হারিয়ে বারবার হোঁচট খেতে থাকে বার্সেলোনা। সেই সুযোগে বাকি ১১ রাউন্ডকে ১১টি ফাইনাল হিসেবে দেখা জিনেদিন জিদানের দল টানা ১০ জয়ে শিরোপা উৎসব করে। আর পথ হারিয়ে দুইয়ে থেকেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় কাতালান দলটিকে।

রোনালদোর হাত ধরে জুভেন্টাসের টানা নবম শিরোপা:

ইউরোপিয়ান ফুটবল পুনরায় মাঠে যখন গড়ালো তখন ইতালিয়ান সিরি আ’র শীর্ষ দুই দলের মধ্যে পয়েন্ট ব্যবধান ছিল মাত্র ১। মৌসুমের শুরু থেকে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করছিল জুভেন্টাস। তবে ২০১৯’র সেপ্টেম্বর থেকে অপরাজিত লাৎসিও ফেরার লকডাউন পরবর্তী সময়ে মাঠে ফিরে আর ফর্ম ধরে রাখতে পারেনি। প্রতিপক্ষের ব্যর্থতার সুযোগে দুই ম্যাচ হাতে রেখেই টানা নবমবারের মতো লিগ শিরোপা ধরে রাখা নিশ্চিত করে তুরিনের দলটি।

চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিকথা:

করোনা পরবর্তী সময়ে নতুন নিয়ম নিয়ে আসে ইউয়েফা। নতুন নিয়ম অনুযায়ী কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমি ফাইনাল দুই লেগের পরিবর্তে অনুষ্ঠিত হয় নকআউটে। আর সেখানেই ঘটে বার্সেলোনার ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাজনক পরাজয়। আর ২০১৯/২০ মৌসুমের শিরোপা জিতে ইউরোপিয়ান ট্রেবল সম্পূর্ণ করে বায়ার্ন মিউনিখ।

এর আগে কোয়ার্টার ফাইনালে চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে বার্সেলোনা নিজেদের সবচেয়ে লজ্জার হারের সম্মুখীন হয়। দুঃস্বপ্নও যেন এমন ভয়ংকর হয় না যেমনটা ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা বায়ার্ন মিউনিখের বিরুদ্ধে প্রথম অর্ধেই দেখেছিল। ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালের লিসবনে মুখোমুখি বার্সেলোনা এবং বায়ার্ন মিউনিখ। যেখানে ম্যাচের প্রথমার্ধেই লিওনেল মেসিদের জালে গোলের হালি উৎসব পূর্ণ করেন থমাস মুলার-রবার্ট লেভান্ডোফস্কিরা। আর দ্বিতীয়ার্ধেও সেই ধারা অব্যাহত রেখে কাতালানদের ওপর চলে বাভারিয়ানদের টর্নেডো। শেষ বাঁশি বাজলেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে মেসিরা কেননা ম্যাচের সমাপ্তি যে হলো বায়ার্নের ৮-২ গোলের জয়ে। চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে নকআউট পর্বে এটিই আট গোলের প্রথম ইতিহাস।

বায়ার্নের মিউনিখের হয়ে এদিন যেন স্বংয় ফুটবল দেবতা ভর করেছিল থমাস মুলারের কাঁধে। ম্যাচের প্রথমার্ধে রীতিমত ছেলেখেলা করলেন লিওনেল মেসিদের নিয়ে। ম্যাচের তখন মাত্র ৪ মিনিট, রবার্ট লেভান্ডোফস্কির অ্যাসিস্ট থেকে প্রথম গোল করেন থমাস মুলার। এর ঠিক মিনিট সাতেক পর ডেভিড আলাবার আত্মঘাতি গোলে ম্যাচে সমতায় ফেরে বার্সা। তবে ওই শেষ। এরপর গুনে গুনে প্রথমার্ধেই আরও তিনবার টার স্টেগানকে বল খুটে আনতে গোলবারের ভেতরে পাঠায় মুলার-গ্ন্যাব্রিরা।

এদিন চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে বার্সেলোনা নিজেদের সবচেয়ে বুড়ো একাদশ নিয়ে মাঠে নেমেছিল। আর গতিময় বায়ার্নের সামনে তাই তো টিকতেই পারল না লিওনেল মেসি-লুইস সুয়ারেজরা। এদিন মেসিকে যেন বোতল বন্দি করে রেখেছিল বায়ার্নের মধ্যমাঠ। ঠিক খোলস বন্দি মেসি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন আর তাই তো তার দলকে টেনে তোলার ভারটা আর কেউই কাঁধে তুলে নেয়নি।

চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে বায়ার্নের ইউরোপিয়ান ট্রেবলপূর্ণ:

উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে পিএসজিকে ১-০ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে ষষ্ঠবারের মতো ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জয় বায়ার্ন মিউনিখের। রোববার (২৩ আগস্ট) বাংলাদেশ সময় রাত একটায় উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ২০১৯/২০ মৌসুমের ফাইনালে মুখোমুখি হয় বায়ার্ন মিউনিখ ও প্যারিস সেইন্ট জার্মেই। খেলার ৫৯ মিনিটে সাবেক পিএসজি খেলোয়াড় কিংসলে কোম্যানের করা একমাত্র গোলে ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট নিশ্চিত করে বায়ার্ন।

ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদার টুর্নামেন্ট উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ। ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্ব লাভের ফাইনালে প্যারিস সেইন্ট জার্মেই বধের হাতিয়ার তাদেরই ঘরের খেলোয়াড়। কিংসলে কোম্যানের করা একমাত্র গোলে নেইমার-এমবাপেদের হাতছাড়া হয়েছে ইউরোপের শেষ্ঠত্ব। নিজেদের ইতিহাসের প্রথম ফাইনাল খেলতে লিসবনে নেমেছিল পিএসজি।

ব্যুরোফ্যাক্স ও মেসি:

বাভারিয়ান ভূমিকম্পের পর থেকেই গুঞ্জন ডালপালা মেলেছিল। এবার সেই ‍গুঞ্জনই সত্যি হলো। একে একে ১৭টি পেশাদার মৌসুম কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন— অনেক হয়েছে, আর নয়। যে ক্লাবের নামের সঙ্গে সঙ্গে সমার্থক হয়ে পড়েছিলেন, সেই বার্সেলোনা এফসি’কে বিদায়ই বলে দিয়েছিলেন।

মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) বাংলাদেশ সময় মধ্যরাতে স্প্যানিশ সংবাদ মাধ্যম মার্কা এ খবর দিয়েছিল। পত্রিকাটি লেখে, মেসি ক্লাবকে একটি ফ্যাক্স বার্তায় জানিয়ে দিয়েছেন ক্লাব ছাড়ার এই খবর।
এর আগে মেসির সঙ্গে বার্সেলোনার চুক্তিতে শর্ত ছিল, ২০১৯/২০ মৌসুমের শেষে ইচ্ছা করলেই ক্লাব ছাড়তে পারবেন তিনি। এর জন্য কোনো পয়সা গুনতে হবে না। ক্লাবকে সেই শর্তের কথাই মনে করিয়ে দিয়ে নিজের ক্লাব ছাড়ার কথা জানিয়েছেন।

তবে এ যাত্রায় কোনোরকমে মেসিকে আটকাতে পেরেছিল কাতালান ক্লাবটি তবে এসবের জন্য পদত্যাগ করতে হয়েছিল ক্লাব প্রেসিডেন্ট জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউকে। এর আগে ব্যুরোফ্যাক্স দিয়ে ক্লাব ত্যাগের ঘোষণা দেওয়া মেসি ১০ দিন পর ইচ্ছার বিরুদ্ধে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানান মেসি। একই সঙ্গে জানিয়ে দেন সভাপতির আচরণে তিনি সন্তুষ্ট নন। ক্লাবের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়েও হতাশা ব্যক্ত করেন।

ব্যালন ডি অর বাতিল:

নিশ্চয়ই বায়ার্ন মিউনিখের পোলিশ স্ট্রাইকার রবার্ট লেভান্ডোফস্কি এবার নিজের ভাগ্যকে গালমন্দ করছেন। মেসি-রোনালদোর ডেরায় ২০১৮ সালে হামলা করেছিলেন লুকা মদ্রিচ আর জয়ীর বেশেও ফিরেছিলেন। তবে গত বছর আবারও নিজেদের রাজত্ব পুনরুদ্ধার করেন লিওনেল মেসি। বলছিলাম ব্যালন ডি অর এর কথা। শেষ ১২ বছরে ১১টি ব্যালন ডি অর জিতেছেন মেসি এবং রোনালদো। অতিমানবীয় পারফরম্যান্স দিয়ে অন্যদের যেন এসব শিরোপার কাছেই ভিড়তে দেননি এই দুই। তবে এবার ২০১৯/২০২০ মৌসুম শেষে ব্যালন ডি অর জয়ের সম্ভবনা ছিল রবার্ট লেভান্ডোফস্কির। কিন্তু তার সাজানো বাগানে যেন মই দিয়ে দিল মহামারি করোনাভাইরাস।

‘এবার ব্যালন ডি’অর পুরস্কারই দেওয়া হবে না।’-ফ্রান্স ফুটবল ফেডারেশনের এমন সিদ্ধান্তে নিশ্চয়ই হতাশ হয়ে পড়েছেন রবার্ট লেভান্ডোফস্কি। ১৯৫৬ সালের পর এই প্রথম ব্যালন ডি অর প্রদান করা হবে না বলে নিশ্চিত করেছে ‘ফ্রান্স ফুটবল’ সাময়িকী। করোনাভাইরাসের কারণে বিপদে পুরো পৃথিবী। ফুটবল বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। করোনাকালে নতুন করে ফুটবল শুরু হলেও বেশ কিছু নিয়মের পরিবর্তন আনা হয়েছে। কতোগুলো লিগ স্থগিত আগেভাগেই শেষ করা হয়েছে। সব কিছু বিবেচনা করে এবারের ব্যালন ডি’অর স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

সব প্রতিযোগিতা মিলে গত মৌসুমে ৪৭ ম্যাচে ৫৫ গোল করা ৩২ বছর বয়সী তারকা এই ফরোয়ার্ড জিতেছেন এ বছরের ইউয়েফা বর্ষসেরার পুরস্কারও। তবে ব্যালন ডি অর জিততে না পারলেও ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার ঘরে তুলেছেন এই পোলিশ স্ট্রাইকার। আর নারী ফুটবলে বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছেন ম্যানচেস্টার সিটি ও ইংল্যান্ডের ডিফেন্ডার লুসি ব্রোঞ্জ।

রোনালদোর আন্তর্জাতিক গোলের সেঞ্চুরি:

রেকর্ডটা যেন শেষের জন্য তুলে রেখেছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তাই তো নেশনস লিগে পর্তুগালের প্রথম ম্যাচে মাঠেই নামেননি তিনি। তবে আবারও ক্লাব ফুটবলের ফেরার আগে পর্তুগালের হয়ে সুইডেনের বিপক্ষে মাঠে নামেন রোনালদো। ম্যাচের আগেই কানাঘুষা চলছে আজই হয়ত হতে চলেছে রোনালদোর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শততম গোলটি। সংবাদমাধ্যমে বিশেষ ক্রোড়পত্র, রোনালদো ছুঁয়ে ফেলবেন গোলের শতক। তাই তো সুইডেনের বিপক্ষের পর্তুগালের ম্যাচটি ঘিরে ছিল বিশেষ উত্তেজনা।

ম্যাচের ৪৪তম মিনিটে জাও মোতিনহোকে ফাউল করে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখেন সুইডেনের গুস্তাভ সভেন্সন। আর তাতেই ডি বক্সের ২৫ গজ দূরে ফ্রিকিক পায় পর্তুগাল। এমন জায়গা থেকে কতবার লক্ষ্যভেদ করেছেন রোনালদো, তা জানতে দেখতে হবে পরিসংখ্যানের খাতা। রোনালদো চিরচারিত ভঙ্গিতে বলের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে, রেফারি বল শট নেওয়ার বাঁশি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের অক্সিজেনের ঘাটতিটা পূর্ণ করে দৌড়ে গিয়ে সজোরে বলে আঘাত করলেন রোনালদো।

আর এর ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যেই সতীর্থদের সঙ্গে বুনো উল্লাসে মেতে উঠলেন পর্তুগিজ সম্রাট। ইউরোপিয়ান ফুটবলারদের মধ্যে ইতিহাসে প্রথমবার আন্তর্জাতিক গোলের শতক পূর্ণ করলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। আর ইরানের কিংবদন্তি ফরোয়ার্ড আলী দাইয়ের পর দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে পূর্ণ করলেন গোলের শতক। আলী দাই ইরানের হয়ে ১০৯টি গোল করেছিলেন। তিনি অবসর নেওয়ায় এই রেকর্ডটা নিজের করে নেওয়ার হাতছানি সামনে রোনালদো।

মেসির পেলের রেকর্ড স্পর্শ:

গত শনিবার (১৯ ডিসেম্বর) জোড়া গোল করে পেলের রেকর্ড স্পর্শ করেছিলেন লিওনেল মেসি। আর রিয়াল ভায়োদোলিদের বিপক্ষে ম্যাচে গোল করে পেলেকে ছাড়িয়ে নিজেই এখন সিংহাসনের মালিক বনে গেছেন আর্জেন্টাইন এই জাদুকর। নির্দিষ্ট একটি ক্লাবের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন লিওনেল মেসি।

মঙ্গলবার (২২ ডিসেম্বর) রাতে লা লিগার ম্যাচে ভায়োদোলিদের বিপক্ষে ম্যাচের ৬৫তম মিনিটে পেদ্রির ব্যাক হিলে মেসি বল পেয়ে যান ডি বক্সের ভেতর। সেখান থেকে বাঁ পায়ের নিখুঁত শটে বল পাঠিয়ে দেন জালে। আর তাতেই পেলের সান্তোসের হয়ে করা ৬৪৩টি গোলের রেকর্ড ভেঙে নিজের নতুন রেকর্ড লিখলেন মেসি।

৩৬ বছর পর বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার মেসি সেই রেকর্ড ভাঙলেন। ২০০৫ সালে বার্সেলোনার হয়ে প্রথম গোল করেন মেসি। ২০২০’র শেষে এসে তিনি পেলের রেকর্ড ভাঙলেন।


বার্সেলোনার একাডেমি লা মাসিয়া থেকে শুরু, এরপর বয়সভিত্তিক দলগুলো পেরিয়ে অবশেষে বার্সার প্রধান দলে শুরু মেসির। তারপর আর থেমে থাকেননি মেসি। বার্সার প্রধান দলের জার্সি গায়ে মেসি এদিন দেখা পেয়েছেন ৬৪৪তম গোলের। পেলের রেকর্ড ভাঙতে মেসির সময় লেগেছে ১৭ মৌসুম আর ৭৪৯টি ম্যাচ।

পেলে নিজ দেশ ব্রাজিলের ক্লাব সান্তোসের হয়ে ১৯ মৌসুমে ৬৬৫ ম্যাচে ৬৪৩ গোল করেছিলেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত এই ক্লাবে খেলেছিলেন পেলে। বার্সেলোনার হয়ে ১৭ মৌসুমেই তার রেকর্ড ছাড়িয়ে গেলেন রেকর্ড ছয়বারের বর্ষসেরা ফুটবলার।

ফুটবল ঈশ্বরের চিরবিদায়:

আর্জেন্টাইন মহানায়ক। ফুটবল দক্ষতায় তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়। ফুটবল বিশ্বের কিংবদন্তী তিনি। কেবল খেলা নয়, খেলার বাইরেও নানা ঘটনা-অঘটনায় বারবার হয়েছেন সংবাদ শিরোনাম। এবার সব বিতর্ক-আলোচনা-শিরোনামের ঊর্ধ্বে উঠে গেলেন তিনি। ৬০ বছর বয়সে এসে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন ‘ফুটবল ঈশ্বর’ দিয়াগো ম্যারাডোনা।

বুধবার (২৫ নভেম্বর) হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হলে জীবনাবসান ঘটে বিশ্বকাঁপানো এই বর্ণিল চরিত্রের। আর্জেন্টাইন শীর্ষ গণমাধ্যম ক্ল্যারিনসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম তার মৃত্যুর খবর জানিয়েছে। আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনও (এএফএ) এক টুইটে তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। টুইটে বলা হয়েছে, ‘কিংবদন্তীর মৃত্যুতে ভীষণ শোকাহত। আপনি সবসময় আমাদের হৃদয়ে থাকবেন।’

খবরে প্রকাশ, কিছুদিন আগে মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল ম্যারাডোনাকে। অস্ত্রোপচারের পর সপ্তাহ দুয়েক আগে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন তিনি। পুরোপুরি সেই অসুস্থতা থেকে সেরে ওঠার আগেই হার্ট অ্যাটাক হয়েছে তার। তাতেই ফুটবল বিশ্বকে কাঁদিয়ে শেষ বিদায় জানিয়ে দিলেন ম্যারাডোনা।

মারাদোনার মৃত্যুর দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে গত ৮ ডিসেম্বর দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সার ও হৃদরোগের সমস্যায় ভুগে মারা যান তার সতীর্থ ও আর্জেন্টিনার সাবেক কোচ আলেহান্দ্রো সাবেইয়া। তার কোচিংয়েই ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।

আর গত ১০ ডিসেম্বর ফুটবল বিশ্ব হারায় আরেক কিংবদন্তি সাবেক ইতালিয়ান ফরোয়ার্ড পাওলো রস্সিকে। সর্বকালের সেরা ফরোয়ার্ডদের একজন হিসেবে বিবেচিত রস্সি ছিলেন ১৯৮২ সালে ইতালির বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক।

পাওয়া আর হারানোর মধ্য দিয়ে কেটেছে গোটা বিশ্বের ফুটবল। লিওনেল মেসি ছুঁয়েছেন পেলের রেকর্ড, রোনালদো স্পর্শ করেছেন আন্তর্জাতিক ফুটবলে গোলের সেঞ্চুরি। দ্বিতীয় ক্লাব হিসেবে দুইবার ইউরোপিয়ান ট্রেবল জিতেছে বায়ার্ন মিউনিখ। বার্সেলোনা ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জার হার দেখেছে আট গোল হজম করে। লিওনেল মেসি বার্সা ছাড়তে দিয়েছেন ব্যুরোফ্যাক্স। সব নিয়ে অবশেষে ২০২০’র অন্তিম মুহূর্তে এসে ফুটবল হারালো কিংবদন্তি ম্যারাডোনা, রসসি, সাবেয়াকে।

সারাবাংলা/এসএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন