বিজ্ঞাপন

জলবায়ু তহবিল প্রকল্প: নদীর পেটে ১০ কোটি টাকার সড়ক!

December 30, 2020 | 8:56 pm

সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: নির্মাণের এক বছরের মাথায় পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সড়ক নদীগর্ভে চলে গেছে। জলবায়ু তহবিলের অর্থায়নে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের গছানী বাজার থেকে দশমিনা ইউনিয়নের হাজিরহাট পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটারের একটি বেড়িবাঁধের ওপর সড়কটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নির্মাণের এক বছরের মধ্যেই সড়কটির একাংশ চলে গেছে নদীর পেটে।

বিজ্ঞাপন

দুই অংশে সড়কটির এখনও চিহ্ন থাকলেও মাঝখানের অংশ তেঁতুলিয়া নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়কটি এখন স্থানীয়দের কোনো কাজেই আসছে না।

স্থানীয়রা জানায়, সড়কটি নির্মাণের পর উপজেলা সদরের সঙ্গে স্থানীয়দের যাতায়াতে ছিল স্বস্তির আভাস। দ্রুত সময়ে দশমিনা শহরে যেতে পারতেন তারা। এমনকি বর্ষায় কাদামাটির দুর্ভোগ থেকেও পরিত্রাণ মিলেছিল। কিন্তু নির্মাণের কয়েকমাস পর সড়কটির এমন বেহাল দশায় এখন ফের চরম দুর্ভোগে তারা।

কোস্টাল ক্লাইমেট রেজিরিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার (সিসিআরআইপি) প্রকল্পের অধীনে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে সড়কটির নির্মাণকাজ শেষ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে সড়কটির পাকাকরণের কাজ শেষ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরকে (এলজিইডি) বুঝিয়ে দেয় জামাল হোসেন নামের পটুয়াখালীর এক ঠিকাদার।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয়দের অভিযোগ, সড়কটি নির্মাণে আগে এর লাভজনকতা, পরিবেশের প্রভাব, টিকে থাকা, এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কেমন হবে সেটি বিশ্লেষণ করা হয়নি। সেই সঙ্গে নির্মাণকাজে চরম অবহেলাও সড়কটির এ দশার জন্য দায়ী বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

তাদের অভিযোগ, সড়কটি নির্মাণকালে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির লিখিত অভিযোগ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে দিলেও কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। উল্টো ঠিকাদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং প্রতিবাদ করায় হয়রানির শিকার হতে হয়েছে অনেককে।

জলবায়ু গবেষকের মতে, টেকসই উন্নয়ন কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সড়ক নির্মাণ গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে টাকা ব্যয় করা হয়েছে সেটি দিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন কিংবা টেকসই উন্নয়নের জন্য সড়ক নির্মাণ না করেও দৃশ্যমান আরও অনেক কিছুই করা যেত। তারা বলছেন, সড়কটির বাস্তবায়ন দেখিয়ে একদিকে যেমন প্রকল্পের নামে অর্থের হরিলুট হয়েছে। তেমনি টেকসই উন্নয়নের নামে স্থানীয়দের সঙ্গেও উপহাস করেছে নির্মাণ সংশ্লিষ্টরা।

বিজ্ঞাপন

পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পাকা করা সড়কটি মূলত বেড়িবাঁধ। পানি উন্নয়ন বোর্ড ১০ বছর বছর আগে অর্থাৎ ২০১০ সালে নদীর প্লাবন থেকে ফসল ও আশপাশের কাউনিয়া, হাজিকান্দা, কাজীকান্দা, পূর্ব দশমিনা ও পূঁজাখোনাসহ পাঁচটি গ্রাম রক্ষায় এটি নির্মাণ করে। এর ফলে শুধু ফসল কিংবা গ্রাম রক্ষা নয়, আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের প্রায় ৫০ হাজার মানুষের উপজেলা সদরে যাতায়াতে অনেকটাই স্বস্তি ফিরে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে সৃষ্ট কাদামাটি দুর্ভোগ পোহাতে হয় বলে বেড়িবাঁধের ওপর সড়কের পিচ ঢালায় দিয়ে পাকা করা হয়।

স্থানীয়রা জানায়, বেড়িবাঁধের ওপর পাকা সড়ক নির্মাণের সময় নদীর দূরত্ব ছিল মাত্র ৩০০ মিটার। কিন্তু সে সময় বেড়িবাঁধটির প্রতিরক্ষা বাঁধ না তৈরি করেই অপরিকল্পিতভাবেই সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছে।

স্থানীয় কৃষক রমিজ হাওলাদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘যে জায়গায় এখন রাস্তার চিহ্ন রয়েছে সেটি মূলত নদীর জোয়ার থেকে গ্রামকে বাঁচাতে বেড়িবাঁধ হিসেবে বানানো হয়েছিল ১০ বছর আগে। কিন্তু ৮ বছর পর ২০১৮ সালে বেড়িবাঁধের ওপরই রাস্তার পিচ ঢালায় করে পাকা করা হয়। যখন এটি করা হয় তখন আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। আমরা দাবি করেছিলাম বেড়িবাঁধের কাছাকাছি যেহেতু নদী এসে গেছে। তাই আরও দূরে অন্য একটা রাস্তা বা বেড়িবাঁধ করে তারপর রাস্তা করার জন্য। এ জন্য আমরা প্রতিবাদ সমাবেশ, লিখিত অভিযোগও দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের কথা কেউ শোনেনি।’

অপর একজন বাসিন্দা শামছুল মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিবাদ কিংবা লিখিত অভিযোগ দেওয়ার কারণে রাস্তার নির্মাণ কাজ বন্ধ না করে উল্টো আমাদেরকে মামলার ভয় দেখিয়ে হয়রানি করা হয়েছিল।’

বিজ্ঞাপন

একই কথা বললেন দশমিনা উপজেলার জলবায়ু ফোরামের সভাপতি রায়হান বাদল। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই রাস্তাটি অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ হচ্ছে দেখে প্রতিবাদ করেছি। সেই সঙ্গে রাস্তা নির্মাণ সংশ্লিষ্ট এলজিইডিসহ সব দফতরে লিখিত অভিযোগও দিয়েছি। কিন্তু তারা কেউ বিষয়টি আমলে নেয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাস্তাটি নির্মাণের সময় যে নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করার কথা ছিল সেটিও মানা হয়নি। পাইলিং করা হয়েছিল বাঁশ দিয়ে। এসবের প্রতিবাদ করায় স্থানীয়দেরকে ঠিকাদার সংশ্লিষ্টরা হয়রানিও করেছিল। এমনকি এটা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে মামলা দেওয়ার হুমকিও দিয়েছিল।’

একই অভিযোগ করলেন দশমিনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ লিটন। তিনি জানান, সড়কটি নদীর তীর ঘেঁষে নির্মাণ না করার জন্য এলজিইডিকে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা সে কথা শোনেনি। যে কারণে এখন ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়কটি এলাকাবাসীর কোনো কাজে আসছে না।

বিষয়টি সম্পর্ক জানতে বর্তমানে উপজেলা প্রকৌশলী কর্মকর্তার দায়িত্বে নিয়োজিত মো. জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তিনি কোনো সাড়া দেন।

তবে প্রকৌশল অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটির অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয় খতিয়ে দেখতে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত জুনে তদন্তের দায়িত্ব পান পটুয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) জি এম সরফরাজ।

তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা জি এম সরফরাজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর আমি সড়কটির এলাকা পরিদর্শন করেছি। সেখানে দেখেছি রাস্তাটির একটি অংশ নদীতে ভেঙে গেছে। আবার কোথাও কোথাও বড় বড় গর্ত হয়ে আছে। সড়কটি বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলেছি। তবে কিছু টেকনিক্যাল বিষয় বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে বিধায় গণপূর্তকে লিখিত চিঠি দিয়ে জানিয়েছি, যেন তাদের প্রকৌশলীদের কেউ বিষয়গুলো এসে বুঝিয়ে দেয়। এটি শেষ হলেই হয়তো মাসখানেকের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।’

তবে পরিবেশবিদ ও স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ডিন ড. কামরুজ্জামান মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে সেটি একবছর পর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এটি যদি বাস্তবায়নকারীরা বুঝতে না পারে তবে অবশ্য তাদেরকে বলতে হবে অপরিপক্ক তারা। যেটি সাধারণ মানুষ বোঝেন সেটি কেন তারা বুঝবে না। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, এখানে প্রকল্পের নামে অর্থ হরিলুট হয়েছে এবং প্রকল্পটির যথেচ্ছাচার ব্যবহার করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সরকারকে কঠোর অবস্থানে থেকে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে যেন এমনটি না হয় সেদিকেও সংশ্লিষ্টদের নজর দিতে হবে।’

সারাবাংলা/এসএইচ/একে

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন