বিজ্ঞাপন

রাজসিক টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের ইতিহাস!

January 13, 2021 | 10:02 am

সাহাবার সাগর, নিউজরুম এডিটর

ভারতীয় দল সিডনিতে আজ যা করে দেখালো সেটির হিসেবে একটু পরেই না হয় আসছি। তার আগে দেখে নেওয়া যাক শেষবার ভারতীয় দল সবচেয়ে বেশি বল খেলে চতুর্থ ইনিংসে ম্যাচ ড্র করেছে। এমন পরিসংখ্যান খুঁজে পেতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৯০ সালে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতীয় দল চতুর্থ ইনিংসে  করতে উরকি রামান এবং মনোজ প্রভাকর উদ্বোধনী জুটিতে ২৭০ বল খেলে করেছিলেন মোট ১৪৯ রান। এরপর ওই বছরই ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে ৪০৮ রানের জয়ের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে চতুর্থ ইনিংসে শচিন টেন্ডুলকারের সঙ্গে ৭ম উইকেটে মনোজ প্রভাকর ২৪৮ বলে ১৬০ রানের জুটি গড়েন। এই দুই ঘটনার পর কেটে গেছে দীর্ঘ ৩০ বছর। এরপর অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে আবারও ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন এবং হনুমা বিহারি।

বিজ্ঞাপন

ক্রিকেট বিশ্লেষকরা অহরহই বলে থাকেন টেস্ট ক্রিকেটেই ক্রিকেটের আসল আনন্দ। ক্রিকেটের মাহাত্ম্য প্রকাশ পায় টেস্ট ক্রিকেটেই। ১১ জানুয়ারি ২০২১ সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে একটি অনবদ্য ক্রিকেট ম্যাচেরই উপহার দিলেন ভারতের লোয়ার অর্ডারের দুই ব্যাটসম্যান। এর মধ্যে একজন তো স্বীকৃত ব্যাটসম্যানই নন।

দলীয় ২৭২ রানে চেতেশ্বর পুজারা (৭৭) যখন আউট হয়ে ফিরছিলেন তখনও দিনের খেলার ৪৩ ওভার মতো বাকি। আর ভারত এর মধ্যেই হারিয়ে ফেলে পাঁচ টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানকে। তখন আর কে বা ভেবেছিল দিনের বাকি সময়টা বীরত্ব গাঁথা লিখবে হনুমা বিহারি আর অশ্বিন।

বিজ্ঞাপন

জশ হ্যাজেলউডের বলে পুজারা যখন বোল্ড হয়ে ফিরলেন সেই সময় উইকেটে আসলেন অশ্বিন। এসে দেখলেন হনুমা বিহারির পক্ষে দৌড়ে রান নেওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে গত দিন নিজেও ইনজুরিতে পড়েছিলেন অশ্বিন। আগের রাতে সারারাত বিছানায় পিঠ ঠিকভাবে দিতে পারেননি। স্ত্রী প্রীতি বলেছেন যে আশ্বিন নাকি জুতার ফিতা বাঁধার জন্য পিঠটা বাঁকা করতেও পারছিলেন না। ড্রেসিংরুমে বসতে পারছিলেন না। তবে মাঠে যখন নামছিলেন দেখে বোঝায় কোনো রাস্তাই ছিল না অশ্বিন আদৌ এমন ইনজুরিতে পড়েছেন। কারণ? দেশের জন্য নিজেকেই সবার আগে উজাড় করে দেওয়ার পণ করে রেখেছেন এই ভারতীয়। অশ্বিন-বিহারির এমন দৃঢ় ব্যাটিং দেখে উইকেটের পেছনে থাকা টিম পেইন আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না। এই দুইয়ের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে আশ্রয় নিলেন তাদের মহাস্ত্রের। টিম পেইন স্লেজ করেই যাচ্ছেন, এর ভেতর অশ্বিন পেছনে ফিরে ইংরেজিতেই জবাব দিচ্ছেন। আর হনুমা বিহারি মুখ ঘুরিয়ে তামিল ভাষায় কিছু একটা বলছেন। তবে না, তাতে দুইজনের এক ফোটা মনোযোগে ফাটল ধরাতে পারেনি অজিরা, আর নিজেরাও নিজেদের মনোযোগকে ভেঙ্গে পড়তে দেননি এই দুই ক্রিকেটার।

হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পাওয়া বিহারি শক্তিশালী পেইন কিলার খেয়েছেন। একেকবার পানির বোতল নিয়ে অতিরিক্ত খেলোয়াড়েরা এসে বিহারিকে একেকটা পেইন কিলার খাইয়ে গেছেন। একটা সময় দেখা গেলো তাঁর রান ১০০ বলে ৬, ১২৪ বলে ৭!

ব্যাথায় কাতর বিহারি উইকেটের এক প্রান্ত থেকে এক রান নিতে বারণ করছেন, অন্যদিকে আশ্বিন মানা দাঁড়িয়ে থাকেন ঠাই হয়ে। কামিন্স, স্টার্ক, হ্যাজেলউড কিংবা নাথান লায়নরা বল হাতে আসছেন আর একের পর এক মেইডেন দিয়ে চলে যাচ্ছেন। একের পর এক ওভার মেডেন যাচ্ছে। কামিন্স, স্টার্করা তাঁদের সব নিংড়ে দিচ্ছেন শরীর বরাবর। সংখ্যার হিসেব করলে দেখা যায় ভারতীয় ইনিংসের ১৩১টি ওভারের ভেতর ৪৩টি ওভার মেইডেন গেছে।

বিজ্ঞাপন

তবে তাতে কি? বিহারি-অশ্বিন যেন রাহুল দ্রাবিড়ের মতো ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ওয়াল’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ন্যূনতম ৪০টা সিঙ্গেলস তাঁরা নেননি, ডাবলসের সংখ্যাটাও হবে তেমনই। এই রানগুলো যদি নেওয়ার ঝুঁকি তারা নিতে তবে হয়তো ক্রিকেট বিশ্ব দেখতে পেতো না এমন উপভোগ্য একটি ম্যাচ। হয়তো হতো না সৃষ্টি ইতিহাসের! ও হ্যাঁ! আজই আবার ভারতের কিংবদন্তি ক্রিকেটার রাউল দ্রাবিড়ের জন্মদিন। তবে কি অশ্বিন-বিহারি তাকেই উৎসর্গ করলেন এই বীরত্ব?

অবশ্য কেবল মাঠে থাকা অশ্বিন-বিহারিই নয়, গতকাল চোট পেয়ে গোটা সিরিজের জন্য মাঠের বাইরে চলে যাওয়া রবিন্দ্র জাদেজাও বায়না ধরে বসেছিলেন প্রয়োজনে তিনিও ব্যাট হাতে নেমে পড়বেন ম্যাচ বাঁচাতে। না শুধু মুখের কথা নয়, প্যাড আপ করে তৈরিও ছিলেন ড্রেসিংরুমে। প্রথম ইনিংসে হাত ভেঙে যাওয়ায় দ্বিতীয় ইনিংসে বল করেননি তিনি। জাদেজার এই প্যাড আপ ব্যাটসম্যানদের যতটুকু না বার্তা দিলো তাঁর চেয়ে অনেক বেশী বার্তা দিলো প্রতিপক্ষকে। এরা ভাঙলেও মচকায় নাই!

ভারতীয় দলের এমন লড়াই দেখে জয় ভট্টাচার্য লিখেই ফেললেন, ‘এরা ক্রিকেট ইলেভেন থেকে হাসপাতালের ওয়ার্ড হয়ে গেছে! তবু লড়াই ছাড়ছে না!’

বিজ্ঞাপন

অথচ সিরিজের প্রথম টেস্ট যাচ্ছে না তাই ভাবে হেরে দমে গিয়েছিল ভারতীয়রা। তারও আগে সিরিজ শুরুর আগে কোহলি ও স্মিথের সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেখানে কোহলি দুইজনের কথা বললেন। প্রথম টেস্টের পরে তিনি থাকবেন না। তারপর তাঁর অনুপস্থিতিতে রাহানে কীভাবে অধিনায়কত্ব করেন সেটা আজিঙ্কের জন্য একটা বড় সুযোগ, আর তিনি অধীর আগ্রহে বসে আছেন যে হনুমা বিহারি কীভাবে এই সিরিজটা খেলেন। বিহারিকে নিয়ে তাঁর অনেক আশা। প্রথম টেস্টে ভারত পেলো ৩৬ রানের লজ্জা। সেখান থেকে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে অধিনায়কত্ব করতে হয়- তাঁর প্রায় সবটা দেখিয়ে ভারতীয় তথা ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম কামব্যাক লিখেছিলেন আজিঙ্কিয়া রাহানে আর তাঁর দল।

অজিদের মাটিতে টেস্ট সিরিজে এই ইনিংসের আগে মোট ৫টি ইনিংস খেলেছিলেন। কিন্তু ভারতীয় দলের ক্রিকেটার হিসেবে নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি তিনি। এমনকি সিডনি টেস্টের প্রথম ইনিংসেও আউট হয়েছিলেন মাত্র ৪ রানে। তাঁর জায়গায় ব্যাটিং অর্ডারে জায়গা পেয়েছেন রিশব পন্ত। তবে ইতিহাসে নাম লেখানোর থেকে মাত্র তিনটি রান দূরে থাকতে ফিরতে হয়েছে ড্রেসিংরুমে। এই পন্তকে নিয়েও কম কথা হয়নি। সমালোচনা উঠেছিল তাঁর দলে জায়গা পাওয়া নিয়েও।

গত কয়েক বছর ধরে ভারতের সেরা উইকেটরক্ষক ঋদ্ধিমান সাহার পরিবর্তে পন্ত দলে এসেছেন শুধু ব্যাটিংয়ে পারদর্শিতার কারণে। কিপিংটা যে যুতসই না সেটা জানেন নিজেও। প্রথম ইনিংসে দুটি নিশ্চিত ক্যাচ ছেড়েছেন। সাহার জায়গায় দলে আসা তাই প্রশ্নবিদ্ধই হয়েছিলো। প্রথম ইনিংসে ব্যাট করার সময় হাতে ব্যথা পেয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে কিপিং করতে পারেননি। ওই ব্যাথা নিয়েই ব্যাটিংয়ে নেমেছেন। পুরো ইনিংসে হাতে এমন ব্যথা ছিল যে হাত তুলে পানি খেতে পারছিলেন না। ড্রিংক্স ব্রেকে যখন অতিরিক্ত খেলোয়াড় পানি নিয়ে আসছিলো পন্তকে পানি খাইয়ে দিচ্ছিলো, যেন পন্ত পানির বোতল উঠানোর জন্যেও হাত নাড়াতে না হয়। যেন পন্ত তাঁর হাতটা শুধু ব্যাটিংয়ের জন্যই নাড়ান অনেক শক্তিশালী পেইন কিলার ট্যাবলেট খাচ্ছিলেন! প্রচণ্ড ব্যথা নিয়েই কামিন্স, হ্যাজলউডদের বাউন্স গুলো ঠেকাতে হাত তাকে বেশ ভালোভাবেই নাড়াতে হয়েছে। তবে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে রানের চাকাটাও ঘুরিয়েছেন বেশ। ১১৭ বলেই করেছেন ৯৭ রান। রানটা এমন দ্রুতগতিতে তুলেছেন যে তিনি যখন আউট হন তখন ভারতের ওভারপ্রতি রানের প্রয়োজনটা তিনে নামিয়ে দিয়ে গেছেন।

একদিনে যেমন পন্ত খেলছেন ঝড়ো ইনিংস। ঠিক অন্যদিকে চেতেশ্বর পুজারা দিচ্ছেলন চরম ধৈর্য্যের পরীক্ষা। টি-টোয়েন্টির এই রমরমা যুগে সবাই যখন গ্ল্যামারের ঝনঝনানিতে আছে তখন পুজারা একমনে তাঁর দিকের কাজটা করে যান।

সিডনি টেস্টে অজিদের তিন বিধ্বংসী পেসার কামিন্স, স্টার্ক আর হ্যাজলউড সঙ্গে লায়নকে নিয়ে বিশ্বসেরা বোলিং লাইনআপ। তাদের সকল প্রকার অস্ত্র ব্যবহার করলেন অশ্বিন-বিহারির ওপর। কখনও শর্ট বল না করে কয়েকটা বল গুড লেংথ বা ফুল লেংথ অন্যদিকে নাথান লায়ন কয়েকটা ফ্লাইট দিয়ে আশ্বিনকে প্রলুব্ধ করারও কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু না এদিন তাদের ওপর যেন ভিভিএস লক্ষণ আর রাহুল দ্রাবিড় ভর করেছিল। তাই তো প্রলুব্ধ হননি কিছুতেই। ব্যাট খুলে নয়, আটকে খেলেছেন দিনের ৪৩টি ওভার।

দিন শেষে সিডনির এই টেস্টের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নাম লেখা থাকবে স্টিভেন স্মিথের। কিন্তু তাতে কি? ক্রিকেট বিশ্ব ভুলবে না চেতেশ্বর পুজারের কঠিন ধৈর্য্যের পরীক্ষা। ব্যথানশক ঔষুধ খেয়ে রিশব পন্ত, হনুমা বিহারি কিংবা রবিচন্দ্রন অশ্বিনের বীরত্ব গাঁথা। কিংবা এও ভুলবে না ভাঙা হাত নিয়ে ড্রসিংরুমে প্যাডআপ করে বসে থাকা রবিন্দ্র জাদেজার কথা। শেষ পর্যন্ত ভারত সিডনি টেস্ট হারেনি। অশ্বিন-বিহারিতে ভর করে পার হয়ে গেছে সিডনির সেই মহারণ।

সারাবাংলা/এসএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন