বিজ্ঞাপন

পৃথুলার বাবার ছুটি হয়েছে

March 20, 2018 | 12:11 pm

জান্নাতুল মাওয়া।।

বিজ্ঞাপন

যাবার দিন বাবা টাই এর নট বেঁধে  দিতে দিতে বলেছিলেন, মা আমি তো চিরকাল তোর পাশে থাকবোনা। তুই যে টাই বাঁধা শিখছিসনা টাই বাধা শিখছিসনা? মেয়ে হেসে বলেছিলো, না বাবা, তোমাকে কোনদিন ছুটি দিবোনা।

কর্মক্ষেত্রে মা ভীষন ব্যস্ত থাকতেন বলে বাবাই পৃথুলার  সাথে  সাথে থাকতেন সারাক্ষন। পৃথুর  জামা কাপড় ধুয়ে দেয়া, পৃথুকে খাওয়ানো, স্কুলে নিয়ে যাওয়া সব বাবাই করতেন। ছোটবেলা থেকেই বাবার কোলে পিঠেই মানুষ হয়েছে পৃথু। আর মায়ের সাথে ছিল  দারুন বন্ধুত্ব।

বিজ্ঞাপন

কথাগুলো বলছিলেন ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের বিধ্বস্ত প্লেনের নিহত কো পাইলট  পৃথুলা রশিদের ফুপু নুরুন্নাহার জলি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটিই ছিলো পৃথুলা রশিদের প্রথম ইন্টারন্যাশনাল কমার্শিয়াল ফ্লাইট। এর আগে তিনি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ট্রেইনি হিসেবে গিয়েছিলেন। জলি  জানালেন পৃথুলা তার একমাত্র ভাতিজি। তার ছয় ভাইয়ের মধ্যে আরেকজনের শুধু একটি পুত্রসন্তান আছে। বাকিদের কারো সন্তান নেই। তার কাছ থেকেই আরো জানা গেল, মেয়ের মৃত্যু সংবাদ পাবার পর থেকে পৃথুলার  বাবা  আনিসুর রশিদ একদমই কাঁদেননি। তবে দুইদিন আগে গভীর রাতে নাকি তিনি রান্নাঘরে ঢুকেছিলেন ডিম ভাজবেন। আদরের  মেয়ে পৃথুলা কয়দিন ধরে  কিছু খায়নি বলে গভীর রাতে  তিনি ডিম ভাজতে গিয়েছিলেন। স্বজনেরা তাকে বাধা দিতে গেলে  তিনি  জ্ঞান হারান।

 

বিজ্ঞাপন

 

বলতে বলতে শাড়ির আচলে চোখের জল মুছলেন পৃথুলার একমাত্র ফুপু জলি। কিছু পরেই পৃথুলার মা রাফেজা বেগমের  কর্মস্থল  শ্যামলীর  আশা টাওয়ার  এসে পৌঁছাবে  পৃথুলার বাক্স বন্দী শরীর। মায়ের কর্মস্থলে  হয়তো আরো এসেছেন কন্যা। কিন্তু  এই আসাটা একেবারেই  অন্যরকম।  তাকে বিদায় দিতে এসেছেন শত শত মানুষ।

ব্যস্ত সংবাদকর্মীদের  ক্যামেরার আলোয় ফিকে হয়ে আসছে  সন্ধ্যেটা। সন্ধ্যের আকাশে প্রতিদিন অনেক রঙ খেলা করলেও আজকের আকাশ ছিলো ছাই বর্ণের। ছাই রঙ্গা আকাশের নিচে আশা টাওয়ারের সামনে পৃথুলার মৃতদেহের জন্যে  অপেক্ষা করছিলেন সবাই।  কথা ছিল মাগরিবের নামাজের পরে জানাজা হবে। তবে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নামলে আসে পৃথুলার মৃতদেহ বহনকারী ফ্রিজিং গাড়িটি।

 

বিজ্ঞাপন

 

সোমবার আর্মি  স্টেডিয়ামে জানাজা শেষে  আনুমানিক সন্ধ্যা পৌনে সাতটায় পৃথুলা রশিদ শেষবারের মত মায়ের কর্মস্থলে আসেন। মৃতদেহ নামানোর পরে  আত্মীয় স্বজনদের বাঁধভাঙ্গা কান্নায় আশা টাওয়ারের গ্রাউন্ড ফ্লোরের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। পৃথুলার  খালা হাউমাউ করে কান্না  করতে করতে বলছিলেন, আমার মা আটদিন ধরে কিছু খায়নি, একটু পানিও তো খায়নি। কিছু না খেয়ে ক্যামনে আছে আমার মা!

পৃথুলাকে  দশ বছর বয়স থেকে যে আয়া দেখাশুনা করে রাখতেন  তিনিও এসেছেন আদরের পৃথুকে শেষবারের মত দেখতে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “কত লক্ষী ছিল পৃথু । কোনদিন আমারে উঁচু  গলায় কোন কিছু কয়নাই। কিছু লাগলেই খুব আস্তে কইরা কইতো, খালা এইটা কইরা দেন।”
এতসব আহাজারি, বিলাপ আর হইচই এর মধ্যে সবচেয়ে শান্ত  ছিলেন পৃথুলার বাবা। তিনি একবারো কাঁদেননি। বরং সবাইকে স্বান্তনা দিচ্ছিলেন।  কেউ একজন এসে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, পৃথুলার মুখ দেখেছেন কি না। তিনি  বললেন, এখনো দেখি নাই, একটু পরে দেখবো, কবর দেয়ার সময়।

জানাজা শেষে রাত সাড়ে সাতটায় পৃথুলার মৃতদেহ মিরপুর বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে দাফনের জন্যে আবার লাশবাহী গাড়িতে তোলা হল। লাশের গাড়ির চালকের পাশের আসনে বসলেন পৃথুলার বাবা। সবসময় তিনি মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যেতেন,  কর্মক্ষেত্রে নিয়ে যেতেন। আজ  আদরের  মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছেন কবরস্থানে।  আজ পৃথুলার বাবার ছুটি হয়েছে।

 

সারাবাংলা/জেএম/এসএস 

 

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন