বিজ্ঞাপন

পুরনো হারমোনিয়ামে স্বর্ণালীর নতুন সুর

March 21, 2018 | 8:30 am

মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

বিজ্ঞাপন

বাগেরহাট থেকে ফিরে: ফাগুনের সন্ধ্যা নেমেছে চিতলমারির অজপাড়াগা কৃষ্ণনগরে। বলেশ্বরের বুক ছুঁয়ে আসা মৃদু বাতাস শরীরে মেখে চাঁদের আলোয় পথ চলছি। গন্তব্য পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাংগা ইউনিয়নের তারাবুনিয়া বাজার। সামনে যতোই এগোচ্ছি কানে এসে স্পর্শ করছে একটি মিহি সুরের মুর্ছনা। হারমোনিয়ামের তালে তালে কে যেনো গাইছে ‘মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা’।

সরু মাটির রাস্তার ধারে একটি বাড়ি। সারবাঁধা তিনটি টিনের ঘরের একটির সামনে গিয়ে দাড়ালাম। তখনো ঘরের মধ্য থেকে গানের সুর বেরিয়ে আসছে এই আলো-আধারিতে ছাওয়া উঠোনে। ঘরের সামনে একটি ছোট্ট ঘরে রান্না করছেন এক মাঝ বয়সী নারী। ঘরে গানের অনুশীলন করছে তারই মেয়ে স্বর্ণালী।

বিজ্ঞাপন

নিভৃত এ গায়ে সন্ধ্যার পর সৃষ্টিকর্তার অপার ভালবাসা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো কোলাহল নাই। পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় ভেসে যায় টিনের চাল। সে আলো উঠোনের সামনের লাউয়ের মাচা, গাঁদা ফুলের গাছ কিংবা পুকুরের পানিতে ঝলমল করতে থাকে। সন্ধ্যা রাতের সে সৌন্দর্যে স্বর্ণালীর সঙ্গীত অনুশীলন ভিন্নমাত্রা যোগ করে।

স্বর্ণালী মন্ডল। স্থানীয় চরবানিয়ারি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। পড়াশুনায় ভাল। ক্লাসে রোল নম্বর এক। তবে পড়াশুনায় ক্যারিয়ার যাই হোক, গান নিয়েই তার স্বপ্ন। গানেই সে বড় হতে চায়।

রাত তখন আটটা বেজে গেছে। বারান্দায় অপরিচিত তিন আগন্তুককে সামনে রেখে গান নিয়ে স্বপ্নের কথা বলে যায় সে। বলে, বড় শিল্পী হতে পারলে খুব ভাল লাগবে। এর চেয়ে বেশি স্বপ্ন এখনও দেখিনা।

বিজ্ঞাপন

স্বর্ণালীর গানের মাস্টার দূরের বইবুনিয়া গ্রামের করুন বিশ্বাস। প্রতি শুক্রবার বিকেলে এক ঘন্টা করে গানের তালিম দিয়ে যান তিনি। আর সপ্তাহ ধরে নিজের ঘরেই চলে অনুশীলন। ইতোমধ্যে উপজেলা পর্যায়ে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে সে। আর নিজ স্কুলেতো তার গানের সূচনা হয়েছে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়।

স্বার্ণালীর বাবার নাম কার্তিক মন্ডল। স্বর্ণালীর স্কুলেরই দপ্তরী। আর মা গৃহিনী লিপিকা মন্ডল। দুই ভাইবোনের মধ্যে সে বড়।

এবার ফিরে আসি ‘মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা’ গান বিষয়ে। দূর থেকে শোনা গানটি আবার শুনতে চাই আমরা। কিছুটা জড়তা নিয়েও গানটি গায় সে। তবে গানের কয়েকটি স্থানে সঠিক সুর ও শব্দ জানেনা সে। বলে, ‘ঘরে মোবাইল নেই। তাই অনেক খুঁজেছি কিন্তু আসল গানটি পাইনি। আমিও বুঝতে পারছি ভুল আছে। কিন্তু কোথায় সেটি ধরতে পারছি না ‘।

ঘরে স্বর্ণালীর বাবা নেই। ইতোমধ্যে দুয়েকজন পুরুষ-নারী এসে পড়েছেন নিম্ম মধ্যবিত্তরের ঘরের বারান্দায়। সোলারের টিমটিমে আলোয় সবগুলো মুখ খুব বেশি চেনা যায় না। তবে তাদের চোখ-মুখে যে নানান জিজ্ঞাসা আর কৌতূহল সেটি বোঝা যায়।

বিজ্ঞাপন

মা লিপিকা মন্ডল জানান, ওর বাবা চায় না এখনই ঘরে মোবাইল থাকুক। তাই এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে এর ওর মোবাইলে গান শুনে সেগুলো গায় মেয়েটা। কত করে বলেছি একটা মোবাইল কিনে দাও, ওর বাবা মোটে শোনে না।

স্বর্ণালী যে হারমোনিয়ামটা বাজাচ্ছে সেটি বেশ পুরনো। ওপরের রেক্সিন উঠে গেছে। সুরও ভাল আসে না। যা গান গাওয়ার সময় ওর মুখভঙ্গি দেখা বোঝা গেলো। বললো, হারমোনিয়াম টা আমার পিসির ছিলো। তার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর এখন আমি ব্যবহার করছি। অনেক পুরনো এটি।

বোঝা গেলো পুরনো হারমোনিয়ামে নতুন সুর তুলেছে স্বর্ণালী। তাই একটু এলোমেলো মনে হতে পারে। কিন্তু ও পারবে। যার স্বপ্ন গান নিয়ে সে তো একদিন শিল্পীই হবে।

স্বর্ণালীর মায়ের ভাষ্য- গ্রামের অনেকেই নতুন হারমোনিয়ামে গান গায়। মেয়েটাও মাঝে মাঝে হারমোনিয়ামের কথা বলে। কিন্তু একজনের ইনকামে যে সংসার চলে সেখানে একসঙ্গে প্রায় বিশ হাজার টাকা দিয়ে নতুন হারমোনিয়াম কেনা সহজ কথা নয়। তাইতো পুরনো হারমোনিয়ামেই নতুন নতুন সুর তুলতে হবে স্বর্ণালীকে। কেননা স্বর্ণালী বড় হয়ে কেবল একজন শিল্পীই হতে চেয়েছে। গানের মধ্যেই নিজেকে বড় দেখতে চেয়েছে স্বর্ণালী মন্ডল।

সারাবাংলা/এমএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন