বিজ্ঞাপন

করোনা মোকাবিলায় সঠিক খাদ্য নির্বাচন

April 20, 2021 | 4:30 pm

ফারিয়া শারমিন অনন্যা

বিশ্বজুড়ে এখন সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম করোনা। করোনার ভয়াল থাবায় থমকে গেছ স্বাভাবিক জনজীবন। চারপাশে শুধু মৃত্যুর হিসাব, করোনা আক্রান্তের খবর আর টিকে থাকার লড়াইয়ের কাহিনী।

বিজ্ঞাপন

আমি, আপনি কিংবা আমরা- কেউই সুরক্ষিত নই মরণঘাতি এই করোনাভাইরাস থেকে। কিন্তু দেখা গেছে অপেক্ষাকৃত ভালো স্বাস্থ্যের অর্থাৎ কোন জটিল রোগ নাই বা রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা ভালো এমন ব্যক্তিরাই তুলনামূলক ভালো আছেন। তাছাড়া এখন সুস্থভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে প্রতি মুহূর্তে পরিবেশ, পরিস্থিতি কিংবা প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে যেতে হচ্ছে আমাদের।

নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হলে সবার আগে প্রয়োজন, এই ভাইরাসের সাথে লড়াইয়ের জন্য নিজের শরীরকে প্রস্তুত রাখা। অর্থাৎ আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিংবা ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে তোলা। আর ইমিউন রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরির প্রথম এবং অপরিহার্য শর্ত হল সঠিক খাদ্য নির্বাচন। কোনো ইলেকট্রিক ডিভাইসকে যেমন চার্জের মাধ্যমে পাওয়ারফুল করে তোলা যায় ঠিক তেমনি আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যাবস্থাও সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে শক্তিশালি করা যায়।

এবার আসুন জেনে নিই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য করার জন্য কোন খাবারগুলো অতি প্রয়োজনীয়।

বিজ্ঞাপন

ক. অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হল এমন এক উপাদান যা শরীরে আগত বিভিন্ন ক্ষতিকর মলিকিউল ও জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন এ, সি, ই, বিটা-ক্যারোটিন ও লাইকোপেনযুক্ত শাকসবজি, ফলমূল, বাদাম ও বিচিজাতীয় খাবার। আরও যেসব খাবারে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায় চলুন দেখে নেই তার তালিকা।

১. অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর সবজি: করলা, গাজর, টমেটো, মিষ্টিকুমড়া, আলু, মিষ্টিআলু, ফুলকপি, বাধাকপি, ব্রোকলি, মুলা, বিটরুট, ডাঁটা, লাউ, লেটুস পাতা ও ক্যাপসিকাম, ইত্যাদি। আর যেকোনো ধরনের এবং রঙের ধরনের শাকেও পাবেন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।

২. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফলমূল: সব ধরনের ফলেই মোটামুটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। তবে একটি কথা বিশেষ ভাবে বলতে চাই, আমরা যে, যে পরিবেশে থাকি সেই পরিবেশের ফলই আমাদের জন্য বিশেষ উপযোগী। অর্থাৎ আমাদের জন্য আমাদের দেশীয় ফলই সবচেয়ে যথোপযুক্ত। দেশীয় ফলের মধ্যে আম, কলা, পেপে, পেয়ারা, আনারস, জাম্বুরা, বাঙ্গি, বেল, তরমুজ, আতা, কমলা, জাম, বরই, সফেদা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সাইট্রাস ফ্রুটস যেমন- লেবু, কমলালেবু, মাল্টা, জলপাই, আমলকি, আমড়া, কামরাঙ্গা, কুল ইত্যাদি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।

বিজ্ঞাপন

এছাড়াও ফল নির্বাচনের ক্ষেত্রে মৌসুমী ফলকে প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা যে মৌসুমে যে ফলগুলো পাওয়া যায় সেগুলো পরিপূর্ণ পুষ্টিতে ভরপুর থাকে। সেই প্রেক্ষাপটে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় তরমুজ, বাঙ্গি, বেল, পেয়ারা, কাঁচা আম, বরই এবং আনারসের মত মৌসুমী ফল বেছে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

৩. ভিটামিন ‘ই’ জাতীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার: বাদামজাতীয় খাবারের মধ্যে কাঠবাদাম, চিনাবাদাম, পেস্তাবাদাম, কাজুবাদাম, আখরোট ও বিভিন্ন ধরনের বাদাম তেল ইত্যাদি গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রতিদিন অল্প পরিমাণ হলেও যেমন ৫-৬ টি বাদাম খেতে পারলে শরীরের জন্য তা ফলপ্রসূ হবে।

সামগ্রিকভাবে উদ্ভিজ্জ খাবারই হল অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের সবচেয়ে ভালো উৎস। তাই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালি করার জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন রঙের এবং ধরনের রঙিন শাকসবজি ও ফলমূল গ্রহণের কোন বিকল্প হতে পারে না।

এছাড়াও আরো কিছু উপাদান থেকে আমরা ভালো মানের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পেতে পারি। সেগুলো হল,

বিজ্ঞাপন

৪. মশলা: অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কিংবা ওষুধি গুণাগুণ যাই বলি না কেন, তার কারণেই করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকে এখন অব্দি রসুন, আদা, লবঙ্গ, গোলমরিচ, কালোজিরা ও দারুচিনির মত মশলাগুলো পুরো বিশ্বের সর্বত্রই সমান তালে সমাদৃত হয়েছে।

৫. চা: গ্রিন টি বা সবুজ চা এখন সকলের কাছেই অতি পরিচিত এবং পছন্দনীয় একটি পানীয়। কারণ এর উপকারিতা কমবশি সকলেরই জানা। ইজিসিজি ও ক্যাটেচিনের মত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায় এই গ্রিন টি থেকে। সুতরাং দিনে ২/১ বার হলেও গ্রিন টি পান করার অভ্যাস গড়ে তোলা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

খ. ভিটামিন ও মিনারেল
ভিটামিনকে খাদ্য প্রাণও বলা হয়। সুতরাং শরীরের জন্য ভিটামিন যে কতটা প্রয়োজন তা এ কথা থেকেই পরিষ্কার। তবে সব খাদ্যেই কমবেশি কিছু না কিছু ভিটামিন পাওয়া যায়। কিন্তুু বর্তমান এই প্রতিকূল পরিস্তিতিতে রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থা শক্তিশালি করতে এবং শরীরকে সুস্থ ও রোগমুক্ত রাখার জন্য যে ভিটামিনগুলো অবশ্যিক তা হল-

১. ভিটামিন সি: পেয়ারা, কলা, লেবু, মাল্টা, বরই, কামরাঙা, আমড়া, আমলকি, জাম্বুরা, আনারস ইত্যাদি ভিটামিন সি-এর সর্বোৎকৃষ্ট উৎস। তবে প্রয়োজনে ভিটামিন সি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা হলে তা ইমিউনিটিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

২. ভিটামিন ডি: ভিটামিন ডি এর সবচেয়ে ভাল উৎস্য হল সূর্যের আলো। ইমিউন সিস্টেম বুস্ট আপ এ ভিটামিন-ডি এর কোনো বিকল্প নেই। তাই দৈনিক কমপক্ষে ১০-১৫ মিনিট হলেও গায়ে রোদ লাগানো অপরিহার্য। তাছাড়াও ডিমের কুসুম, দুধ, মাখন, যকৃত, সামুদ্রিক মাছ কিংবা মাছের তেল থেকে উৎকৃষ্ট মানেরর কিছু পরিমাণ ডি ভিটামিন পাওয়া যেতে পারে।

৩. অন্যান্য ভিটামিন: নানারকম শস্য, ডাল, বাদাম, বিচি, মাছ, মাংস, যকৃত, কলিজা, ডিম, দুধ ইত্যাদি গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন বি১, বি২, বি৬, বি১২ ও ই সহ অন্যান্য ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

গ. মিনারেলস বা খনিজ উপাদান
করোনার এই বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলায় মানবদেহের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক মিনারেল বা ক্ষনিজের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। কমবেশি সব ধরনের মিনারেলস সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের কথা বলা হলেও করোনার প্রেক্ষাপটে জিংক-কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কেননা ভাইরাসের বিরুদ্ধে জিংকের ভূমিকা অপরিসীম। শ্বেত রক্তকনিকা ও লিম্ফোসাইট শরীরের দুটি মূল্যবান রোগ প্রতিরোধকারী কোষ। জিংক এগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি, পরিপক্কতা, বিস্তার ও কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, জিংক করোনা ভাইরাসকে নিজের প্রতিলিপি তৈরিতে বা বংশ বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। তাই এই পরিস্থিতিতে জিংক সমৃদ্ধ খাবার এবং পাশাপাশি জিংক সাপ্লিমেন্টও গ্রহণ করা উচিৎ।

ঘ. প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় খাবার
দেহ কোষের সুরক্ষা,গঠন এবং দেহের সার্বিক সুরক্ষার জন্য উচ্চ জৈব মূল্যের প্রোটিন জাতীয় খাবার যেমন, মাছ,মাংস,ডিম, দুধ-এই খাবারগুলো প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অবশ্যই রাখতে হবে।

ঙ. পানি
জীবন ধারণ কিংবা সুস্থতার জন্য পানির কোনো বিকল্প হতে পারে না। খাদ্যের প্রতিটি পুষ্টি উপাদান কিংবা অন্যান্য জৈবিক কনার পরিবহনে অথবা শরীর থেকে বর্জ্য অপসারণে পানির ভূমিকা অবর্ণনীয়। তাই প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা অত্যাবশকীয়। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি পান সবার জন্য আবশ্যক। আর এখন যেহেতু প্রচুর গরম পড়েছে তাই শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে পানির বিকল্প নেই। তবে পানি পানের সাথে সাথে তাজা ফলের রস, লেবুর শরবত, চা, পানীয়, সবজির স্যুপ, ঋতুভিত্তিক ফলমূল (যেগুলোতে প্রচুর পরিমাণ পানি থাকে) ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। এতে শরীরের পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির চাহিদার পূরণের মাধ্যমে শরীর সুস্থ, কর্মক্ষম ও রোগ প্রতিরোধী হয়ে উঠবে।

পরিশেষে সবার জন্য সাধারণ কিছু সতর্ক বার্তা
১. যতটা সম্ভব  তাজা ও টাটকা খাবার গ্রহণ করুন
২. ঘরের তৈরি খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন
৩. খাবার তালিকায় ফাইবার জাতীয় খাদ্য যেমন প্রচুর পরিমাণ ফল ও শাকসবজি রাখুন
৪. খাবার ভালো করে ধুয়ে তারপর রান্না করুন
৫. কাঁচা ফল ও শাকসবজি কমপক্ষে ১৫-২০ মিনিট পানিতে ভিজিয়ে রেখে, তারপর ভালো করে ধুয়ে খান
৬. প্রচুর পরিমাণ পানি ও তরল খাবার পান করুন
৭. চিনি, লবণ ও তেল যত সম্ভব পরিমিত আকারে গ্রহণ করুন
৮. সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছর থাকুন, বার বার সাবান পানি বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করুন
৯. প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হবেন না, প্রয়োজনে বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন। মাস্ক পরিধান ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া গাইডলাইন অনুসরণ করুন
১০. ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন ও সুস্থ থাকুন। নিজে সচেতনতা অবলম্বন করুন এবং অন্যকে সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করুন।

লেখক- বি.এস.সি. (অনার্স),খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান, হোম ইকোনোমিকস ইউনিট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/আরএফ

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন