বিজ্ঞাপন

বিকেলেই স্পষ্ট হয় রাতে রাজারবাগে অ্যাটাক হবে

March 25, 2018 | 8:21 am

।। উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা : ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া নিয়ে রাজারবাগের ভেতরে স্বাধীনতাকামী পুলিশ এবং পাকিস্তান পন্থী পুলিশ সদস্যদের মধ্যে বাক বিতণ্ডা লেগেই থাকত। কি খাবার টেবিল, কি আড্ডা খানা আর কি ওয়ারলেস রুম সবখানে তর্ক চলছিল।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দুপুরে বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া খানের বৈঠক ভন্ডুল হওয়ার পর রাজারবাগের স্বাধীনতাকামী পুলিশ সদস্যরা আঁচ করতে পেরেছিল আজ রাতে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ঢাকার মুক্তিকামী জনতা সহজেই বুঝতে পারছিল রাতে রাজারবাগ অ্যাটাক হতে পারে।

বিকেলের দিকে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা ব্যারাকে ফেরার আদেশ না আসতেই মুক্তিকামী পুলিশ সদস্যরা ব্যারাকে ফিরতে শুরু করেন। সবার মুখে একটা কথা কি হতে যাচ্ছে আজ রাতে। কেউ কেউ রাজারবাগের কেন্দ্রীয় ওয়ারলেস সেটের সামনে জড়ো হতে থাকে নির্দেশ শোনার জন্য।

বিজ্ঞাপন

রাত ৮টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক ছাত্র এসে জানিয়ে দিল যে, আজ রাতে রাজারবাগে অ্যাটাক হবে। এ খবর শোনামাত্র রাজারবাগের স্বাধীনতাকামী সকল পুলিশ সদস্যদের জানিয়ে দেওয়া হলো। তখন স্বাধীনতাকামী সকল পুলিশ সদস্য কেন্দ্রীয় অস্ত্রাগারের দিকে এগোতে থাকল। আর বাইরে খবর পেয়ে সাধারণ মুক্তিকামী জনতা রাজারবাগের চারপাশে ৫টি ব্যারিকেড দিলো যাতে পাক হানাদাররা সহজে রাজারবাগ অ্যাটাক করতে না পারে।

এদিকে রাত ১০টার দিকে সাধারণ মুক্তিকামী একদল যুবক রাজারবাগে এলেন অস্ত্র নিতে। সেই দলে ছিলেন শান্তি নগরের বাসিন্দা ফজলে এলাহী বাদশা। তিনি বলেন, আমরা অস্ত্র নিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ দিতে চাননি কারণ আমরা প্রশিক্ষিত নই। তখন আরেক পুলিশ এসে বললেন, যুদ্ধ আমরাই করব। আপনারা শুধু দেখিয়ে দেন পথগুলো। আর স্থানীয়রা আপনারা আমাদের আশ্রয় দেন। তখন স্থানীয় সকলেই বাসার সকল ছাদ উম্মুক্ত করে দেওয়া হলো। আর পুলিশ সদস্যদের সবাই সহায়তা করল।

হেড কনস্টবল (অব.) আব্দুর রউফ সেদিন রাতের বর্ণনা দিয়ে বলেন, রাত ১১টার দিকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তান আর্মির ট্যাংক ও গোলা বারুদের গাড়িবহর বের হতে শুরু করে। উদ্দেশ্য একটাই তা হলো রাজারবাগ অ্যাটাক। এ খবর পেয়ে রাজারবাগের কেন্দ্রীয় অস্ত্রাগারে যায় সবাই। কিন্তু অস্ত্রাগারের তালা লাগানো দেখে চাবি আনতে যাওয়া হয়। যার কাছে চাবি ছিল তার বাসাতেও তালা। এটা দেখার পর ফিরে এসে বন্দুক দিয়ে গুলি করে তালা ভাঙার চেষ্টা করা হয়। এতেও কাজ না হলে শাবল দিয়ে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে প্রয়োজনীয় অস্ত্র নিয়ে মাঠে জড়ো হয় সবাই। তিনি বলেন, অস্ত্র নিয়ে যখন সবাই মাঠে আসে তখন স্বাধীনতার স্লোগানে রাজারবাগের আকাশ বাতাস কাঁপছিল। এ সময় একটি পতাকা উত্তোলন করে সেলুট জানিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার দৃঢ় শপথ ব্যক্ত করা হয়।

বিজ্ঞাপন

আরেক কনস্টেবল আব্দুল আলী খান যিনি তৎকালীন আইজিপি তসলিম উদ্দিনের দেহরক্ষী ছিলেন। তিনি বলেন, আমি নিরুপায় হয়ে ওইদিন রাতে রাজারবাগের পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে দেই। এটা শুনে যে যেখানে ছিল সেখান থেকে ছুটে এসে অস্ত্র নিয়ে পজিশনে দাঁড়িয়ে যায়।

পাকিস্তান আর্মিরা তিন দিক থেকে রাজারবাগ অ্যাটাক করার পরিকল্পনা করে। সেই অনুযায়ী একটি ট্যাংক বহর শাহবাগ হয়ে শান্তিনগর দিয়ে ইস্টার্ন প্লাস শপিং কমপ্লেক্সের (তৎকালীন সময়ে এখানে একটি স্কুল ছিল) সামনে অবস্থান নেয়। তারা প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই স্বাধীনতাকামী এক পুলিশ সদস্যের বন্দুক থেকে গুলি চালানো হয়। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এক পাক সেনা। এটি ছিল প্রথম প্রতিরোধের গুলি। প্রথম গুলির সংবাদ ওয়ারলেসে শুনতে পেয়ে একজন কনস্টেবল সকলকে বার্তা পাঠান। ওয়ারলেস বার্তায় তিনি বলেন, ‘রাজারবাগের (বেইজ) থেকে সকল ইস্ট পাকিস্তান পুলিশকে বলছি, তোমরা শোন, পাকিস্তান আর্মি এরই মধ্যে আমাদের আক্রমণ করেছে, তোমরা নিজেদের রক্ষা করো।’

তৎকালীন এসআই শাহজাহান মিয়া বলেন, এই বার্তা শোনার পর ঢাকাসহ সমগ্র দেশে জানান দেওয়া হলো, আক্রান্ত ঠেকাও, আক্রান্ত ঠেকাও। এরপর প্রথম গুলি খেয়ে পাকিস্তান সেনারা বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে শুরু করে। গুলি পাল্টা গুলি চলতে থাকে। অন্ধকারে স্বাধীনতাকামী পুলিশ সদস্যদের খোজ পেতে হিমশিম খায় পাক আর্মিরা। তখন তারা আকাশে ট্রেসার বুলেট আর ম্যাগনেসিয়াম ছুড়ে আলোকিত করে। এরপর পুলিশদের একে একে গুলি করে হত্যা করতে থাকে।

প্রত্যক্ষদর্শী নাট্যকার আলী যাকের বলেন, খিলগাঁওয়ের রাস্তায় শত শত ট্যাংকের সারি দেখেছিলাম। সবগুলি ট্যাংক তাক করা ছিল রাজারবাগের দিকে। একটানা গোলা বর্ষণ শুরু হয়। সব পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল।

বিজ্ঞাপন

নিরাপদে আশ্রয় নেওয়া কনস্টেবল আবু শামা বলেন, মালিবাগের দিকে দেখছিলাম হাজার হাজার পাক সেনা রাজারবাগের দিকে গুলি ছুড়ছে। কামানের গোলা নিক্ষেপ করছে।
ওই সময়ে রাজারবাগে কর্মরত বাবুর্চি আনসার আলী গাজী বলেন, পুলিশ সদস্যদের অনেকে মারা যাওয়ার পর বাকিরা নিরাপদে সরিয়ে পড়েন। কারণ এখানে থাকা ততটা নিরাপদ নয়। বড় বড় গোলা বর্ষণ করে আর্মিরা। সবকিছু ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভোর হয়ে গেলে পাক সেনারা রাজারবাগের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। স্বাধীনতাকামী পুলিশ সদস্যদের খুঁজে বের করে ক্যান্টিনে জড়ো করা হয়। সেখানে ১৫০ জনের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। এরপর তাদের অনেককে গুলি করে মারা হয়।

এরপর তারা অস্ত্রাগার ও গোলা বারুদ দখলে নেয়। ৩টা ৩ টনের ট্রাকে করে ওইসব অস্ত্র নিয়ে যায় পাক সেনারা। আনসার আলী গাজী আরো বলেন, ভোরের দিকে নিহত অনেকের মরদেহ পাক সেনারা গাড়িতে করে নিয়ে যায়। শুনেছি তাদের বুড়ীগঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দেন। বুড়িগঙ্গায় যাদের লাশ পাওয়া যায় তাদের শরীরের পোশাকে ও বেল্টে পিআরএফ লেখা ছিল। কারণ পিআরএফ শুধুমাত্র রাজারবাগের পুলিশ সদস্যদেরই বলা হতো।

কনস্টেবল শেখ আশরাফ উদ্দিন বলেন, ২৬ মার্চ সকালে তৎকালীন আইজিপি তসলিম উদ্দিনকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মামুন মাহমুদ, রাজশাহীর এসপি এম এ মজিদ, চট্টগ্রামের এসপি সামসুল হকসহ পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মেরে ফেলা হয়। তবুও দমেনি মুক্তিকামী পুলিশ সদস্যরা। ১৩ হাজার পুলিশ সদস্য কর্মস্থল থেকে পালিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। এরপর তাদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপ কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, ২৫ মার্চ রাতে গোলা ও কামানের আগুনে নথিভান্ডারের সকল কাগজপত্র পুড়ে যাওয়ায় প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে কতজন পুলিশ সদস্য শহীদ হয়েছিলেন তার সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে যারা ওই মারা গিয়েছেন তারা চির স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবে। যুগ যুগ ধরে বাঙালির হৃদয়ে তারা বেঁচে থাকবে।

সারাবাংলা/ইউজে/একে

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন