বিজ্ঞাপন

সৌন্দর্যবর্ধন চলছে রমনায়, গাছ কাটার কৌশল বলছেন পার্কপ্রেমীরা

May 12, 2021 | 8:28 am

আজমল হক হেলাল, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: রাজধানী ঢাকার ফুসফুস বলা হয় একে। ইট-কাঠের এক শহরে একটুকরো সবুজের খনি যেন। পরিবেশবিদ ও প্রকৃতিপ্রেমীরা বলে থাকেন, এই একটুকরো রমনা পার্ক যেন বাঁচিয়ে রেখেছে ঢাকাকে। সেই রমনা পার্কে চলছে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ। আর সেই সৌন্দর্যবর্ধন করতে গিয়েই বেশকিছু গাছের ডালপালাসহ বেশকিছু গাছও কেটে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেসব গাছ অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর ও মরে যাচ্ছে, সেগুলোই কেটে ফেলা হবে। এ অবস্থায় সৌন্দর্যবর্ধনকে পার্কের গাছ কেটে ফেলার কৌশল হিসেবে অভিহিত করছেন রমনা পার্কপ্রেমীরা। আর পরিবেশবিদরা বলছেন, রাজধানীর ফুসফুস হলেও রমনা পার্ক অপরিকল্পনার শিকার।

রমনা পার্কের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই বলছেন, রমনা পার্ক নিয়ে কোনো ধরনের দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নেই। যখন যারা দায়িত্বে থাকেন, তারা নিজেদের খেয়ালখুশি অনুযায়ী সৌন্দর্যবর্ধনের নামে পার্কের চেহারা বদলে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এতে করে পরিবেশের ভারসাম্য যেমন নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তেমনি সরকারের কোষাগার থেকে বিপুল অর্থের অপচয় হয়। পার্কটিকে ঘিরে দীর্ঘ মেয়াদি কোনো মাস্টারপ্ল্যান থাকলে এমনটি ঘটত না।

রমনা পার্কের সৌন্দর্যবর্ধন কাজে নিয়োজিত গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সুপারিনটেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার জামিলুর রহমান সারাবাংলাকে জানান, রমনা পার্কের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য প্রায় ৪৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রকল্পটি এ বছরের জুনের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে দীর্ঘ সময় প্রকল্পটির কাজ বন্ধ থাকায় এটি শেষ করতে বাড়তি সময় চাওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে, প্রকল্পটির সময় বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

রমনায় চলমান এই সৌন্দর্যবর্ধনের আওতায় শিশু কর্নারের আধুনিকায়নসহ একটি উন্মুক্ত কফি কর্নার স্থাপন করা হবে। পাশাপাশি পার্কের চারপাশজুড়ে তৈরি হবে ওয়াকওয়ে। এছাড়া পার্কজুড়ে ক্যান্টিলিভার ডেকের দৈর্ঘ্য বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। আর সার্বিকভাবে পার্কের সৌন্দর্যবর্ধনের বিষয়টি তো রয়েছেই। রয়েছে পার্কে দুই হাজার লাইট স্থাপনের কাজ। পার্কের ভেতরে বড় সার্চলাইটও বসানো হবে কয়েকটি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রমনা পার্কের এক কর্মকর্তা জানালেন, বর্ষা মৌসুমে পার্কে দুই-তিন হাজার ঔষধি ও ফলের গাছ রোপণের পরিকল্পনা নিয়েছে গণপূর্ত বিভাগ। এসব গাছ বড় করতে বা বাঁচিয়ে রাখতে রমনার ভেতরে বড় বড় রেইনট্রি গাছের ডাল কেটে ফেলতে হবে। আর সেটি করলে ওই গাছগুলো ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। তখন মৃত গাছ দেখিয়ে সেগুলো কেটে ফেলা হবে। এর আগেও রমনায় কৌশল করে অশোক, কাঁঠাল, আম, জামসহ বেশকিছু গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। রাতের অন্ধকারেও অনেক গাছ কেটে ফেলার অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব বিষয় নিয়ে কেউ মুখ খুলতে চান না।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্ট কয়েকজন জানালেন, সৌন্দর্যবর্ধনের আওতায় বেশকিছু গাছ ও গাছের ডালপালা কেটে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুরনো বড় গাছের ডাল, যেসব গাছ মরে যাচ্ছে বা মরে গেছে এবং কাজে লাগে না, এমন গাছগুলো কেটে ফেলা হবে। এর আওতায় ১০ থেকে ১৫টি ইউক্যালিপটাস গাছ কেটে ফেলার বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত। ইউক্যালিপটাস গাছ পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর— এমন যুক্তিতেই গাছগুলো কাটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানাচ্ছে তারা।

আরেক সহকারী প্রকৌশলী জানান, রমনা পার্কে ভেতরে শিশু কর্নার ঢেলে সাজানো হবে। সেখানে শিশুদের খেলার জন্য স্থাপন করা হবে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম। এগুলো স্থাপন করার জন্য সেখানকার চাপাল গাছসহ বেশকিছু গাছ কেটে ফেলতে হবে।

গাছ কাটার বিষয়টি অবশ্য স্বীকার করলেন না রমনা পার্কের সৌন্দর্যবর্ধন কাজে নিয়োজিত গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সুপারিনটেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার জামিলুর রহমান। রমনা প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, রমনা পার্কের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য একটি গাছও কাটা হবে না। পার্কের লেকের দুই পাশে ওয়াকওয়ে করা হচ্ছে। লেকের দুই তীরে যেসব গাছ রয়েছে, সেসব গাছ এরকই থাকবে।

তবে রমনায় চলমান এই কর্মকাণ্ডের আওতায় গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্তের কথা স্বীকার করলেন গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সর্ম্পকিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, অপ্রোয়জনীয় অনেক গাছ রয়েছে রমনায়। সেগুলো কেটে ফেলার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এছাড়া শত বছর বয়সী অনেক গাছ আছে, যেগুলোর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ডান অন্য গাছের জন্য সমস্যার কারণে। এগুলোও কেটে ফেলার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকার ইউক্যালিপটাসের মতো গাছও রয়েছে। এসব গাছ কেটে ফেলা উচিত।

বিজ্ঞাপন

গাছ কেটে ফেলার বিষয়ে পরিবেশবিদদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে জানিয়ে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ বলেন, গাছ কেটে ফেলে পরিকল্পনা অনুযায়ী বৃক্ষরোপণ করতে হবে। এর জন্য অনেক পদক্ষেপ নিতে হবে। এ বিষয়ে আবার পরিবেশবিদদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। তবে পরিবেশবীদরা অনেক কিছু মানতে চান না। তারা তাদের মতো করে কথা বলেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে— কেবল সৌন্দর্যবর্ধন নয়, আমরাও কিন্তু পরিবেশ বাঁচাইতেই চাই।

রমনা পার্কের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই জানিয়েছেন, এরই মধ্যে মৃত ও অর্ধমৃত গাছ চিহ্নিত করা হয়েছে। সৌন্দর্যবর্ধনের কাজের স্থানগুলোতে যেসব গাছ পড়েছে, চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলোও। এসব গাছ অচিরেই কাটা পড়বে।

রমনা পার্কে সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত রয়েছে কুশলী নির্মাতা। এই কোম্পানির একজন কর্মকর্তা আবার জানালেন, লেকের চারপাশে ওয়াকওয়ে হওয়ার কথা থাকলেও সেটি আপাতত হচ্ছে না। চলমান প্রকল্পের আওতায় অর্ধেকেরও বেশি অংশে ওয়াকওয়ে নির্মাণের কাজ বাকি থাকবে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সুপারিনটেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার অবশ্য বললেন, রমনা লেকের পশ্চিম পাশে একটি বড় কালর্ভাট নির্মাণ হচ্ছে। এর নির্মাণকাজ শেষ হলে বাকি ওয়াকওয়ের কাজ করা হতে পারে।

রমনা পার্কের সৌন্দর্যবর্ধনের এই উদ্যোগকে ভালো চোখে দেখছেন না পার্কপ্রেমীদের অনেকেই। তারা বলছেন, পার্ককে সুন্দর করার নামে গাছপালা কেটে ফেলা হলে সেটি কখনোই ভালো হবে না। বরং বর্তমান গাছপালাসহ যা কিছু আছে, সবকিছু রেখে কিভাবে একে দৃষ্টিনন্দন করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত সংশ্লিষ্টদের।

প্রায় একদশক ধরে নিয়মিত রমনা পার্কে আসেন বেসরকারি চাকরিজীবী রাসেল আমিন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, খুব অসুস্থ না হলে আর ঢাকার বাইরে না থাকলে বলতে গেলে প্রতিদিনই এই পার্কে আসি। যতটুকু সময় থাকি, ততটুকু সময়ই স্বস্তির। কিন্তু মাঝে মাঝেই এই পার্কে নানা ধরনের কাজ করা হয়। সেগুলো কতটুকু পরিবেশবান্ধব, সেটি বুঝতে পারি না।

এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে পরিবেশবিদ মোকারম হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, রমনা পার্কের জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান থাকা উচিত। সেটি তো নেই। ফলে যার যখন যা খুশি, তাই করার চেষ্টা করে। এখন নাকি রাস্তা চওড়া করবে। কিন্তু সেটি করতে দেওয়া হবে না। কারণ রাস্তা চওড়া করতে হলে অনেক গাছ কাটতে হবে। কিন্তু গাছ কাটতে আমরা দেবো না।

গাছ কাটার জন্যই এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে এই পরিবেশবিদ বলেন, হতে পারে। কিন্তু রমনায় ক্ষতিকর গাছ থাকলে সেগুলোও রাখতে হবে। আর কাটতে হলে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করে তাদের মতামত নিয়ে তারপরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

মোকারম হোসেন আরও বলেন, আমরা তো এর আগে বলেছিলাম যে মেহগনি গাছ লাগানোর দরকার নেই। তারপরও সেই গাছ লাগিয়েছে। এখন কাটতে চায় কেন? এর আগে অশোক, কনকচাপা, কাঁঠাল, বরুণ গাছসহ অন্যান্য গাছ কৌশল করে কেটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু আমরা আর কোনো গাছ কাটা পড়তে দিতে চাই না।

ঢাকার এই উদ্যানটি ১৬১০ সালে মোঘল আমলে গড়ে তোলা হয়। ওই সময় রমনার পরিসীমা ছিল বিশাল এলাকাজুড়ে। মোঘলরাই এর নাম দেয় রমনা। ১৮২৫ সাল থেকে ব্রিটিশ কালেক্টর ডাউইজের সময় ঢাকা নগর উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়, এর অন্যতম ছিল রমনা এলাকার উন্নয়ন। ১৯ শতকে ব্রিটিশ শাসক ও ঢাকার নবাবদের সহায়তায় এর উন্নয়ন করা হয়।

ঢাকা শহরের নিসর্গ পরিকল্পনার কাজ শুরু হয়েছিল ১৯০৮ সালে লন্ডনের কিউই গার্ডেনের অন্যতম কর্মী আর এল প্রাউডলকের তত্ত্বাবধানে। শহরের সেই নিসর্গ পরিকল্পনার ফল ছিল রমনা পার্কের উন্নয়ন। ২০ বছর লেগেছিল সে কাজ শেষ হতে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পরও রমনা ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবেই থেকে যায়। শাহবাগ থেকে ইডেন বিল্ডিং (বর্তমান সচিবালয়) পর্যন্ত নতুন একটি রাস্তা করা হয়। এই রাস্তারই পূর্ব দিকের অংশ হয় বর্তমান রমনা পার্ক। আনুষ্ঠানিকভাবে রমনা পার্ক উদ্বোধন করা হয় ১৯৪৯ সালে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম রমনা পার্কের অবকাঠামো উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু করেন। ১৯৭৫ সালের পরের সরকারগুলো উদ্যানটির অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য তেমন কোনো দৃশ্যমান কার্যক্রম হাতে নেয়নি। এরশাদ আমলে কেবল লেকের খনন কাজ করা হয়। এবারই প্রথম উদ্যানের পুরাতন স্থাপনা ভেঙে সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করা হচ্ছে।

সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন