বিজ্ঞাপন

এমন ফুটবল রোমাঞ্চ ছড়ানো ইপিএল এক দশক পর

May 24, 2021 | 5:20 am

স্পোর্টস ডেস্ক

২৬ বছর পর আর্সেনাল ইউরোপের কোনো টুর্নামেন্টে খেলা হচ্ছে না। ২৬ টা বছর! ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে নিজের আজকের ম্যাচে জয় তারা ঠিকই পেয়েছে, কিন্তু গানার্সদের উল্লাসে পানি ঢেলে দিয়েছে নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী টটেনহাম হটস্পার্স। নিজেদের শেষ ম্যাচে দুইবার পিছিয়ে পড়েও শেষ পর্যন্ত লেস্টারকে ৪-২ গোলের ব্যবধানে জিতেছে স্পার্স। আর তাতেই কপাল পুড়ল আর্সেনালের।

বিজ্ঞাপন

জোসে মরিনহোকে মৌসুমের শেষ দিকে এসে বরখাস্ত করে স্পার্স। আর সেই সঙ্গে দলের সেরা তারকা হ্যারি কেইনও ঘোষণা দেন ক্লাব ছাড়ার। তাতেই লিগে গত চার রাউন্ডে ধুঁকছিল স্পার্স। মৌসুমের শেষ ম্যাচে স্পার্স আজ আতিথ্য নেয় লেস্টারের মাঠে। এদিকে মৌসুমে প্রথমবার ঘরের মাঠে সমর্থকদের সামনে খেলতে নামে লেস্টার। আর চ্যাম্পিয়নস লিগের আশা জিয়িয়ে রাখতে তাই তো প্রাণপণ করেছিল সদ্যই এফএ কাপ জয়ী দলটি।

ম্যাচে ঠিকই নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখে লেস্টার। কিন্ত লেস্টারের দাবার কোটের সেই সব অসম্ভব গুটি পাল্টে দিয়ে স্পার্স পিছিয়ে পড়েও ম্যাচ জিতে টিকে রইল ইউরোপায়। ইউরোপীয় টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করল আর্সেনালকে, সেই সঙ্গে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে লেস্টার সিটিকে। এদিকে মৌসুমের শেষ ম্যাচে এক গোল করে ২৩ গোল নিয়ে হ্যারি কেইন জিতেছেন প্রিমিয়ার লিগের গোল্ডেন বুট। সেই সঙ্গে এই ম্যাচেই আরও একটি অ্যাসিস্ট করে মৌসুমে মোট ১৪টি অ্যাসিস্ট নিয়ে সেরা প্লেমেকারের অ্যাওয়ার্ডও জিতেছেন এই ইংলিশ স্ট্রাইকারই।

বিজ্ঞাপন

এই লেস্টার সিটিই কদিন আগেই চেলসিকে হারিয়ে জিতেছিল এফএ কাপ। তৃতীয় বা অন্তত চতুর্থ হয়েও চ্যাম্পিয়নস লিগের টিকিট কাটতে পারলে ব্রেন্ডন রজার্সের জন্য রূপকথারই একটি বছর হতে পারত। অথচ মৌসুম শেষে লেস্টার বনে গেল প্রিমিয়ার লিগের চোকার্স। গতবারের মতোই শেষ রাউন্ডে এসে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বাদ পড়ে গেল তারা। বড় দল বা কথিত ‘বিগ সিক্স’ এর সমর্থকরা বলতেই পারে লেস্টার তাদের সমপর্যায়ের কোনো দল নয়। কিন্ত প্রিমিয়ার লিগের কথিত সেই ‘বিগ সিক্স’র তুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল এবং কম আর্থিক সমর্থন নিয়েও ব্রেন্ডন রজার্স ফক্সদের পয়েন্ট টেবিলের পাঁচ নম্বরে রেখেই মৌসুম শেষ করেছেন সেটিও কোনো অংশে কম বাহবা পাওয়ার মতো নয়।

প্রিমিয়ার লিগের ‘বিগ সিক্সের’ ভেতরে থাকা টটেনহাম হটস্পার্স কিংবা আর্সেনাল গত এক দশকে যেখানে একবারও প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা ছুঁয়ে দেখতে পারেনি সেখানে ওই লেস্টারই ‘বিগ সিক্স’র বাইরে থেকেও জয় করেছে প্রিমিয়ার লিগ। আজ খেলার শেষ পনের মিনিট পর্যন্তও এগিয়েই ছিল ফক্সরা। তখন ভিলা পার্কে পিছিয়ে ছিল চেলসি। অর্থাৎ মাত্র ১৫ মিনিট লিডটা ধরে রাখতে পারলেই নিশ্চিত চ্যাম্পিয়নস লিগের টিকিট। সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত ৪-২ গোলে হেরে কোয়ালিফাই-ই করতে পারল না তারা। স্পার্সের হয়ে শেষ ম্যাচে অসাধারণ খেলেছেন গ্যারেথ বেল এবং খুব সম্ভবত স্পার্সের জার্সিতে নিজের শেষ ম্যাচ খেলা হ্যারি কেইনও। এই দুইয়ে জাদুকরী পারফরম্যান্সে লেস্টারের সঙ্গে সঙ্গে কপাল পুড়েছে গানার্সদেরও।

বিজ্ঞাপন

এদিকে ভিলা পার্কে চেলসির ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে। স্বাগতিক অ্যাস্টন ভিলার কাছে ২-১ গোলে হেরেই বসে অল ব্লুজরা। অধিনায়ক আজপিলিকুয়েটাও ম্যাচের একদম অন্তিম মুহূর্তে দেখেন লাল কার্ড। ফিরে আসা অধিনায়ক জ্যাক গ্রিলিশের উপস্থিতিতে দূর্দান্ত খেলে ভিলা। যোগ্য দল হিসেবেই আজ জিতেছে তারা। পৌনে তিনশ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করা চেলসি, আর তাদের আকাশচুম্বী বেতনের কোচ থমাস টুখেল মুখ রাখতে পারেননি। কানের পাশ দিয়ে গুলি গেছে কেবল লেস্টার হেরে যাবার কারণে। আজ প্রিমিয়ার লিগের সেরা চার থেকে বাদ পড়ে গেলে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল ম্যাচের মহারণে মানসিকভাবে অনেক চাপে থাকত ব্লুজরা। দলেও আসত অস্বস্তি। সেটা আপাতত চাপা পড়বে। ২৯ তারিখে জিতলে আবারও উড়তে শুরু করবে ব্লুজরা। অবশ্য এছাড়া গতিও নেই টুখেলের দলের। কেননা কাড়ি কাড়ি অর্থ খরচ করেও এখনও ঘরে তুলতে পারেনি কোনো সিলভারওয়্যার। আবার লিগেও শেষটা টেনেছে চতুর্থ হয়ে…

চেলসি চতুর্থ, লেস্টার পঞ্চম! তাহলে তৃতীয় হল কে? শেষ নয় খেলার আটটিতে জিতে অসাধারণ পারফর্ম্যান্স দেখিয়ে লিগে তৃতীয় হবার পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলাটাও নিশ্চিত করেছে অল রেডসরা। এইতো কদিন আগেই সাত নম্বরে থাকা লিভারপুল দারুণ সংকল্প দেখিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা করে নিল আর শেষ করল শুধু ম্যানচেস্টারের দুই দলের পিছনে। রক্ষণভাগের তিন প্রধান সেনা ভার্জিল ভ্যান ডাইন, জো গোমজ, মাতিপকে হারিয়ে গোটা মৌসুম ভুগেছে ইয়্যুর্গেন ক্লপের দল। মৌসুমের অর্ধেকেরও বেশি সময় ধরে এই তিন রক্ষণসেনাকে দলেই পাননি ক্লপ। তাছাড়াও ফরোয়ার্ডরাও ছিলেন না ধারাবাহিক। মৌসুমের শেষাংশের আগেই শিরোপা হাতছাড়া হয়েছিল রেডসদের। সেই সঙ্গে অনেকেই তো আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলা নিয়েও ছিলেন সংশয়ে। তবে ভাঙ্গাচোরা রক্ষণ নিয়েও শেষ পর্যন্ত জাদু দেখালেন ইয়্যুর্গেন ক্লপ।

বিজ্ঞাপন

মৌসুমের শেষ ম্যাচে বড় দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নির্ভারভাবে খেলে নামে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। লিগের দ্বিতীয় স্থান নির্ধারিত হয়ে যায় আগেই। তাই তো ওলে গানার সোলশায়ারের সব মনোযোগ দিয়েছিলেন ২৬ তারিখ ইউরোপা লিগের ফাইনালের দিকে। নিয়মিত একাদশের ৮ খেলোয়াড়কে তাই তো এদিন বিশ্রামে রেখেছিলেন তিনি। উলভসের মাঠ থেকে ২-১ গোলের জয় নিয়ে গোটা মৌসুম জুড়ে প্রতিপক্ষের মাঠে অপরাজিত থাকার রেকর্ডটাই প্রিমিয়ার লিগ থেকে এবারে সোলশায়ারের দলের একমাত্র প্রাপ্তি। প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেছে মাত্র চারবার। ইংল্যান্ডের শীর্ষ লিগের দেড়শ বছরের ইতিহাসে মাত্র ছয়। আর অ্যাওয়ে ম্যাচে টানা অপরাজিত থাকার ২৭ ম্যাচে অপরাজিত রেকর্ড থেকে মাত্র এক ম্যাচ পিছিয়ে থেকেই ২০২০/২১ মৌসুমের ইতি টেনেছে রেড ডেভিলসরা।

এদিকে মৌসুমের শুরু থেকেই দুর্দান্ত দল নিয়ে শিরোপা পুনরুদ্ধারে নামেন পেপ গার্দিওলা। ক্লাব রেকর্ড পরিমাণ অর্থ দিয়ে বেনফিকা থেকে রুবেন দিয়াজকে উড়িয়ে আনেন গার্দিওলা। যার মর্যাদাও রেখেছেন দিয়াজ। নিজের প্রথম মৌসুমেই ক্রীড়া লেখকদের ভোটে প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জিতেছেন এই পর্তুগিজ ডিফেন্ডার। তিন ম্যাচ হাতে রেখে প্রিমিয়ার লিগের শিরোপাও নিশ্চিত করেছে সিটিজেনরা। ওয়েস্ট ব্রুমের সঙ্গে ১৬ ডিসেম্বর ২০২০ সালে ড্র করার পর ১৯ ডিসেম্বর সাউদাম্পটনের বিপক্ষে জয়ে শুরু এরপর উলভসের বিপক্ষে ৩ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত টানা ১৫টি প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ জিতেছে সিটি। এরপর নগরপ্রতিদ্বন্দ্বিদের কাছে হেরে এই ধারা থামে সিটির। তবে তাতে সিটির শিরোপা দৌড় থামেনি। বরংচ তিন ম্যাচ হাতে রেখেই প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা পুনরুদ্ধার করেন গার্দিওলা। গোটা মৌসুম জুড়ে ৩৮টি ম্যাচের মধ্যে ২৭টিতে জয়, ৫টি ড্র’র বিপরীতে হার মাত্র ৬ ম্যাচে। আর তাতেই নিজেদের ইতিহাসের সপ্তম ইংলিশ লিগ জয়। আর শেষ এক দশকে এটি ম্যানচেস্টার সিটির পঞ্চম প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা জয়।

ঘরের মাঠে লিগ শিরোপা হাতে পাওয়ার উল্লাসের সঙ্গে সঙ্গে এদিন সিটির আকাশ জুড়ে ছিল বেদনা ঘনঘটা। ম্যানচেস্টার সিটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা সার্জিও আগুয়েরো এদিন প্রিমিয়ার লিগে সিটির জার্সিতে নিজের শেষ ম্যাচটি খেলতে নামেন। ২০১১ সালে স্প্যানিশ ক্লাব অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ছেড়ে সিটিতে পাড়ি জমান আগুয়েরো। এরপর ম্যানচেস্টারের দলটির ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি তিনি উপভোগ করেছেন বহু ব্যক্তিগত ও দলীয় সাফল্য। সিটির সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতাও তিনি। সিটির হয়ে ৩৮৯ ম্যাচে প্রতিনিধিত্ব করতে নেমে আগুয়েরো করেছেন ২৬০টি গোল, নামের পাশে আরও আছে ৭৩টি অ্যাসিস্টও। সিটিজেনদের হয়ে পাঁচটি প্রিমিয়ার লিগ, একটি এফএ কাপ, ছয়টি ইংলিশ লিগ কাপ এবং তিনবার জিতেছেন ইংলিশ সুপার কাপও। তবে এবার বিদায় জানাবার পালা। সার্জিও কুন আগুয়েরো সিটি ছাড়ছেন তা নিশ্চিত করেছেন মৌসুমের মাঝপথেই। তাই তো ইতিহাদ স্টেডিয়ামে ম্যাচ মাঠে গড়ানোর আগেই আগুয়েরোকে গার্ড অব অনার প্রদান করে এভারটন এবং ম্যানচেস্টার সিটির খেলোয়াড়রা।

এমন উত্তেজনাময় ইপিএল’র দেখা মিলেছিল এক দশক আগে, সেই ২০১১-২০১২ মৌসুমে। সেবার সার্জিও আগুয়েরো শেষ মুহূর্তে গোল দিয়ে সিটিকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। এরপর লেস্টার সিটির রূপকথার মৌসুম বাদ রাখলে প্রিমিয়ার লিগের এমন উত্তেজনাপূর্ণ মৌসুমের দেখা আর মেলেনি। হ্যারি কেইন শেষ রাউন্ডের ম্যাচেই এক গোল করে মোহাম্মদ সালাহকে টপকে গোল্ডেন বুট জিতলেন। আর্সেনাল থেকে লিভারপুল পর্যন্ত মাঝের সাতটি দল নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে খেলেছে ইউরোপীয় টুর্নামেন্টে জায়গা করে নেওয়ার জন্য। আগেই দ্বিতীয় নিশ্চিত হওয়া ইউনাইটেড দ্বিতীয় সারির দল নিয়ে খেলেও জয়ে নিয়ে গোটা মৌসুম প্রতিপক্ষের মাঠে অপরাজিত রইল। চ্যাম্পিয়ন সিটিরও কোনো চাপ ছিল না। সেই খেলায় বিদায়ী আগুয়েরো বেঞ্চ থেকে এসে দুই গোল করে ইপিএল এর ইতিহাসে এক ক্লাবের হয়ে সর্বোচ্চ গোল করার রেকর্ড করেন মাত্র এক গোলের ব্যবধানে। এমন ফুটবল রোমাঞ্চে ভরপুর ইপিএল শেষ রাউন্ড হয়নি অনেকদিন।

সারাবাংলা/এসএস

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন