বিজ্ঞাপন

শাহজাদপুর খাল: ‘পইড়া গেলে উঠনের সিস্টেম আছে’

March 28, 2018 | 9:23 am

।। মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: সম্প্রতি সিটি করপোরেশন এলাকার ভেতরে আসা রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় একটি খাল এখনো প্রবাহমান। তবে সে প্রবাহ একমুখী, নগরীর স্যুয়ারেজের পানি টেনে নিয়ে অনবরত সশব্দে পশ্চিম থেকে পূবে বয়ে চলেছে শাহজাদপুর খাল। দুই পাড়ে কংক্রিটের সরু রাস্তা ধরে হাঁটলে যে জনপদের দেখা মেলে, সেখানকার বাসিন্দারা এই খালের ময়লা পানি এবং দুর্গন্ধ মেনে নিয়েছে। চৈত্রের প্রখর রোদে খাল ধরে যে বাতাস আসে, তাতেই প্রশান্তি খুঁজে নেয় লোকজন।

চৈত্রের এমন এক দুপুরে খালের পাড়ে লোহার নিরাপত্তা রেলিং ঘেঁষে বেঞ্চে বসে আছেন পারুল বেগম। গত ৩৫ বছর যাবৎ খাল পাড়ের বাসিন্দা তিনি। তপ্ত রোদের মধ্যে টং দোকানের ছায়ায় প্রায়ই বসে থাকেন পারুল বেগম। তার সঙ্গে আলাপ হয় সারাবাংলা’র প্রতিবেদকের।

বিজ্ঞাপন

পারুল বেগম জানান, এক সময় এই খালে বড় বড় নৌকা চলতে দেখেছি। সাতারকুল নদী থেকে গুলশানের দিকে নৌকায় মালপত্র নিয়ে মানুষ যাতায়াত করত। পানিও ছিল পরিষ্কার। খালের সাথে বয়ে গেছে অনেক সময়। মাঝে একবারেই হারিয়ে গেয়েছিল খাল, বছর কয়েক হলো এইটুকু উদ্ধার হয়েছে। বছর তিনেক আগে শাহজাদপুর খালটি উদ্ধার করেছে প্রশাসন। এরপর দুই ধারে পাকা রাস্তা করা হয়েছে, তবে সরু হওয়ায় যান চলাচলের উপযোগী না।

তিনি বলেন, শুনতেছি খালপাড়ের রাস্তা নাকি বড় হবে। কিন্তু কেমনে করব, দুই ধারে এতো এতো ঘরবাড়ি কেমনে সরাইব, কই সরাইব?

পূর্ব দিকে যত যাওয়া যায়, চোখে পড়ে দুই পাড়ে অসংখ্য পাকা-আধাপাকা বাড়ি। যার বাসিন্দাদের অধিকাংশই নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। শাহজাদপুর খালটি কোথাও ১২, কোথাও ১৫ ফুট প্রশস্ত। পাড় থেকে প্রায় ১২ ফুট নিচে পানি। দুই পাড় যুক্ত করেছে বেশ দূরে দূরে কালভার্ট। চলাচলের সুবিধার জন্য এলাকাবাসী নিজেদের উদ্যোগে বানিয়ে নিয়েছে সংযোগ সেতু। কোনোটা বাঁশ-কাঠ আবার কোনোটা লোহার। ভাড়াটিয়াদের নিরাপত্তার জন্য সামর্থবান বাড়ির মালিকরা নিজের বাড়ির সামনের অংশে লোহার রেলিং করে দিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

বেলা তখন তিনটা ছাড়িয়েছে। খালের দক্ষিণ পাড় দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে চোখে পড়ে শিশু এবং বিভিন্ন বয়সী মানুষ। তাদের দুইজন সাকিব ও রমজান। বয়স ৭ কি ৮ হবে। খাল পাড়ের এমন সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে ভয় করে না- এমন প্রশ্নে এক বাক্যে জবাব দেয় সাকিব ‘না’। যদি পড়ে যাও- সমস্যা নাই, পইড়া গেলে উঠনের সিস্টেম আছে’।

দূরে একটি কালভার্ট দেখিয়ে তারা জানায়, ওইখানে একটা রশি ঝোলানো আছে। কেউ পড়ে গেলে ওটা ধরে উঠতে পারবে। একটু এগিয়ে গিয়ে তাদের কথার সত্যতাও পাওয়া গেল।

পশ্চিম পদরদিয়া মালেকের ব্রিজ। এখানে খাল নিয়ে কথা হয় সবজি বিক্রেতা বাচ্চু মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, মাঝে মাঝেই এই খালে কেউ না কেউ পড়ে যায়। এখন পর্যন্ত কেউ মারা যায়নি, কেউ পড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তোলা হয়। তিনি জানান, খালপাড়ের প্রতিটি বাড়িতেই মই রয়েছে। খালটি উন্মুক্ত, তাই কেউ পড়ে গেলে সহজে মানুষের চোখে পড়ে, সাহায্য করতে সবাই এগিয়ে আসে।

পশ্চিম পদরদিয়া ৬ নম্বর রোডের পাশে যে ব্রিজ, সেখানে যাত্রা শেষ হলো। এরপর আর বাড়িঘর নেই। তাই নেই ফুটপাতও। এখানে বসেই কথা হয় এলাকাবাসীর সঙ্গে। শেষ বিকেল। খালের প্রসঙ্গ আসতেই আয়নাল হক নামে ষাটোর্ধ বৃদ্ধ আঙুল উঁচিয়ে দূরে দেখিয়ে বলেন, ‘উই যে ব্রিজটা দেখছেন, তিন দিন আগে এক হুজুর পইড়া গ্যাছে দুধ লইয়া’। ওই ব্যক্তি সাইকেলে করে বাসায় বাসায় দুধ বিক্রি করেন। গত বুধবার রাতে তিনি ফিরছিলেন। ‘উই যে দেখছেন না একটা গাছ, ওইডার লগে ধাক্কা খাইয়া পইড়া গ্যাছে’। দুধ পইড়া, মাইক্কা-ঝুইক্কা গ্যাছে তয়, বেশি ব্যথা পায় নাই। মানষে মই দিয়া উডাই হ্যালাইছে ব্যাডারে।’

বিজ্ঞাপন

আয়নালের কাছে এমন আরও কয়েকটি ঘটনা জানা গেল। যারা অসতর্কতার কারণে খালে পড়ে গেছেন।

জানা গেছে, প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ এ খালটি সাতারকুলের সুতিভোলা খালের সঙ্গে মিলেছে। কাগজে-কলমে খালটি ৩০ ফুট চওড়া হলেও বাস্তবে তা নেই। বছর তিনেক আগে ঢাকা ওয়াসার তত্ত্ববধায়নে খালটি উদ্ধার করা হয়। এতে অর্থায়ন করে বিশ্বব্যাংক। প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সে সময় খাল উদ্ধার ও দুইপাড়ে পাঁচ ফুটের মতো কংক্রিটের রাস্তা করা হয়। ভবিষ্যতে দুইপাড় দখল মুক্ত করে রাস্তা আরও চওড়া করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এলাকাবাসী বলছেন, রাস্তা না থাকার কারণে বিশাল এলাকায় পরিবহনের কোনো ব্যবস্থা নেই। বাসা-বাড়ি পাল্টানো থেকে শুরু করে মানুষের জরুরি প্রয়োজনে ভোগান্তি পোহাতে হয়।

এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড্রেনেজ সার্কেল মো. জাকী মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ওয়াসার তত্ত্বাবধায়নে থাকা খালগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে আমরা তৎপর রয়েছি। প্রথম দফায় খালটি অনেকাংশে দখলমুক্ত করা হয়েছে। এখন দুই পাশে রাস্তার জন্য আবারও দখলমুক্ত করার অভিযান চালাতে হবে। এ জন্য সময় প্রয়োজন।

সারাবাংলা/এমএস/এটি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন