বিজ্ঞাপন

‘নিম্ন আদালতে দ্বৈত শাসনই রয়ে গেল’

December 12, 2017 | 9:30 pm

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ  নিয়ে রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতা রেখে আইন মন্ত্রণালয় অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির যে গেজেট প্রকাশ করেছে তা নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা পক্ষে-বিপক্ষে মত দিয়েছেন।

তবে বেশিরভাগ আইনজীবীই বলছেন, প্রকাশিত গেজেটের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে, মাসদার হোসেন মামলার নির্দেশনা উপেক্ষা করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, এর মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে।

মঙ্গলবার গেজেট পরবর্তী প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা এসব মত দেন।

বিজ্ঞাপন

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘সুপ্রিমকোর্টের একটি আগ্রহ ছিল গেজেট প্রকাশে এত দেরি হচ্ছে কেন? আর এ কারণে বারে বারে আমাকে সময় নিতে হয়েছে। সেটা আমার জন্য নিশ্চয় বিব্রতকর ছিল। এই গেজেট প্রকাশের মধ্য দিয়ে আমার সেই বিব্রতকর অবস্থার পরিসমাপ্তি হলো।’

তিনি বলেন, `বিচার বিভাগীয় একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ আসে তখন তার বিচারের দরকার পড়ে। আর রাষ্ট্রপতি যদি নিজে নিজেই তা করে ফেলতেন তাহলে বলা যেত সেখানে বিচার বিভাগকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। তা তো করা হচ্ছে না।  যাই করা হোক না কেন, সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করেই করা হবে।’

অন্যদিকে বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির প্রকাশিত গেজেটের গোড়াতেই গলদ রয়েছে উল্লেখ করে সংবিধানপ্রণেতা  ও সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেছেন, ‘আমি অবাক হয়েছি, মাসদার হোসেন রায়ের আলোকে এবং সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে অধস্তন আদালতকে নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু এ গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে সে জায়গা থেকে সরে গেছে। এর মাধ্যমে অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকে গেছে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘যদিও এটা করা উচিত ছিল সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী। কিন্তু তা না করে ১৩৩ অনুযায়ী বিধি করা হয়েছে। এই ১৩৩বিধি প্রযোজ্য হয় প্রজাতন্ত্রের সরকারি কর্মচারীদের জন্য।’

‘বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের অধিনস্ত করে ফেলা হয়েছে এই গেজেটের মাধ্যমে’ এমন মন্তব্য করে প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, ‘তারা ১৩৩ অনুচ্ছেদের অধীনে জুডিশিয়াল সার্ভিসকে নিয়ে গেছে। কিন্তু করবার কথা ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে। রাষ্ট্রপতি ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এখানে (প্রকাশিত গেজেটে) কোনো কাজ সম্পাদন করেছেন বলে লেখা নেই।’

এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যখন সংবিধান তৈরি করেছিলাম তখন বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের বিষয়টাতে প্রধান্য দিয়েছিলাম। এ জন্য অধস্তন আদালতের উপরে ১১৪, ১১৫, ১১৬ পরিচ্ছেদ আমরা দিয়েছিলাম। অর্ধাৎ, অধস্তন আদালত কিন্তু আমাদের সংবিধানের একটি প্রতিষ্ঠান। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বলা যেতে পারে। এখন তাদের যদি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিধি-বিধানে অন্তর্ভূক্ত করা হয় সেটা হবে খুবই দুর্ভাগ্যজনক এবং এটি মাসদার হোসেন মামলার পরিপন্থী।’

হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, এটি ফলপ্রসূ হয়নি। নিম্ন আদালতে দ্বৈত শাসন রয়ে গেছে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি  আরও বলেন, ‘যতদিন ১১৬-এর এ থাকবে ততদিন দ্বৈত শাসন থাকবে।’ এটি ন্যায় বিচারের পরিপন্থী হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।

অনদিকে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘এ বিধিমালা প্রকাশের ফলে নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্দ্বের অবসান ঘটেছে।’

তিনি বলেন, ‘অনেক দিনের একটা দাবি ছিল নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি এবং আচরণবিধি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হোক। বিলম্ব হলেও এটা প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল, আমার মনে হয় বিধি প্রকাশের পর ভুল বোঝাবুঝির আর কোনো অবকাশ নেই।’

বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশে প্রক্রিয়াগত কোনো ত্রুটি ঘটেছে কিনা জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে আইনমন্ত্রীর কয়েক দফায় বৈঠক শেষেই সুপ্রিমকোর্ট একমত হয়েছে। এবং সে আলোকেই কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব এটা যখন তিনি অনুমতি দিয়েছেন এটা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।’

সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেছেন, ‘শৃঙ্খলাবিধির প্রকাশিত গেজেটের মাধ্যমে মাসদার হোসেন মামলার মূল স্পিরিটকে খর্ব করা হয়েছে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি সংক্রান্ত এই গেজেটের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কফিনের ওপর শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়েছে। আমরা এই গেজেট বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।’

সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘আমরা গত কয়েক মাস ধরে দেখছি সরকার এবং সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিচার বিভাগকে কুক্ষিতগত করার জন্য নানা রকম অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারই সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হলো নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকুরি শৃংখলা সংক্রান্ত বিধি গেজেট প্রকাশ। এই গেজেটের মধ্য দিয়ে সরকার আমাদের বিচার বিভাগকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিল। নিম্ন আদালতের বিচারকদের স্বাধীনভাবে, নিরপেক্ষভাবে বিচার করার ক্ষেত্রে তারা পদে পদে বাধার মুখে পড়বে।’ ভবিষ্যতে বিচার বিভাগের জন্য এটি একটা অশনিসংকেত বলে মনে করেন এ আইনজীবী।

১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ মাসদার হোসেন মামলায় ১২দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন। ওই রায়ের আলোকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল। কিন্তু গতবছর ২৮ আগস্ট শুনানিতে আপিল বিভাগ খসড়ার বিষয়ে বলেন, শৃঙ্খলা বিধিমালা সংক্রান্ত সরকারের খসড়াটি ছিল ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার হুবহু অনুরূপ। যা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থী। এরপর ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব আদালতে হাজির হয়ে রাষ্ট্রপতির একটি প্রজ্ঞাপন দাখিল করেন। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গেজেট জারির প্রয়োজন নেই। এরপরও আপিল বিভাগ ১৫ জানুয়ারির মধ্যে গেজেট জারির নির্দেশ দেন। কিন্তু গেজেট জারি না করে একের পর এক সময়ের আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। ২৫ দফায় সময় নিয়ে অবশেষে সোমবার সন্ধ্যায় গেজেট প্রকাশ করে আইন মন্ত্রণালয়।

সারাবাংলা/এজেডকে/আইজেকে/জেডএফ

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন